E-Paper

মানবগত সত্য ও সুন্দরের ধারণা মিশে আছে

শিবাজীপ্রতিম বসুর গ্রন্থে রবীন্দ্রচিন্তনের মূল কিছু শব্দবোধের সূত্রে তাঁর চিন্তনজগৎ ও সমকালীন বাস্তবের পর্যালোচনা রয়েছে।

অরবিন্দ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০২৫ ০৭:৪২

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বঙ্গজরা, বিশেষত ইংরেজি-শিক্ষিত কৃতবিদ্য বঙ্গজরা, খুবই বিপন্ন বোধ করেন। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব বলে প্রাচীন ভারতীয় প্রজ্ঞার আধার হিসেবে তুলে ধরে ও রবীন্দ্রদর্শন থেকে ‘সত্য’, ‘সুন্দর’, ‘মঙ্গল’, ‘কল্যাণ’জাতীয় শব্দ-ভাবনা সামনে এনে তাঁকে ‘চিরায়ত’ বলে চিহ্নিত করবেন, না কি সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ববিশ্বে ও সাহিত্যতত্ত্ব আর দর্শনচিন্তনের নিত্যনূতন বিভঙ্গে রবীন্দ্র-ভাবনাকে সাজিয়ে-বাজিয়ে নেবেন! সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্যতত্ত্ব ও দর্শনজগতের সাম্প্রতিক চিন্তনের সঙ্গে রবীন্দ্র-ভাবনাকে সাজিয়ে-বাজিয়ে নিতে পারলে বাঙালির রবিঠাকুর বেশ সাম্প্রতিকতার আবর্তে এসে পড়েন, তাঁকে আর শালগ্রামশিলা মনে হয় না।

শিবাজীপ্রতিম বসুর গ্রন্থে রবীন্দ্রচিন্তনের মূল কিছু শব্দবোধের সূত্রে তাঁর চিন্তনজগৎ ও সমকালীন বাস্তবের পর্যালোচনা রয়েছে। বইটির নামে আছে ‘অ্যাক্সিয়োলজি’ শব্দটি। গ্রিক ‘axios’ থেকে নিষ্পন্ন শব্দটির অনুষঙ্গে ভাল, যোগ্য ইত্যাদি শব্দ উঠে আসে। অর্থনৈতিক, নৈতিক, নান্দনিক, বিবিধ ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা গুরুত্বপূর্ণ, মাঙ্গলিকতালগ্ন জিজ্ঞাসাগুলিকে কোনও ভাবনার ঐক্যসূত্রে বিচার বা মূল্যায়নের দার্শনিক পদ্ধতিকে তাত্ত্বিক ভাবে অ্যাক্সিয়োলজি বলা চলে। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবন, যা মোটের উপরে আধাআধি ভাবে উনিশ ও বিশ শতকে অতিবাহিত, তার যাপনসূত্রে সামগ্রিক ভাবেই তিনি আত্মগত দৃষ্টিতে পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছেন। “মনেরে আজ কহ যে/ ভালো মন্দ যাহাই আসুক/ সত্যেরে লও সহজে।” মন্দকে সহজ ভাবে নিলে অপ্রসন্নতা ও তিক্ততা গ্রাস করে না।

আধুনিক তিক্ততার খণ্ড-বিষাদ রবীন্দ্রনাথের লেখার ভাব ও রূপকে গ্রাস করেনি। আধুনিক অনুজরা একেই মনে করতেন রবীন্দ্রনাথের সীমাবদ্ধতা। আবার আর এক ভাবে দেখলে একেই বলা যেতে পারে তাঁর দৃঢ়তা। এমনকি তাঁর কবিতায় যখন উচ্চারিত হয় এই আস্তিত্বিক জিজ্ঞাসা “দিবসের শেষ সূর্য/ শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল.../ নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়— কে তুমি”, তখনও তিনি বিক্ষুব্ধ নন। খুব সহজেই লেখেন, “পেল না উত্তর।” এই উত্তরের অপ্রাপ্তি তাঁকে নৈরাজ্যের আবাহনে উদ্দীপিত করেনি বলে তিনি খণ্ডিত বিধ্বংসী ‘আধুনিক’ নন, আর সে জন্যই হয়তো রবীন্দ্র-বিষয়ক বইয়ের আলোচনায় শিবাজীপ্রতিমের নিক্তি ‘অ্যাক্সিয়োলজি’। নৈতিক-নান্দনিক স্থানাঙ্ক থেকে রবীন্দ্রনাথ কখনও বিচ্যুত হন না যেন, আর এই নৈতিক-নান্দনিক স্থানাঙ্ক তাঁর সত্য-সুন্দর-কল্যাণ ভাবনা-নির্ভরশীল।

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেখক পল্লিপুনর্গঠন, পবিবেশভাবনা, লিঙ্গচিন্তা, জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে রবীন্দ্র-অভিমত, গান্ধী-রবীন্দ্র প্রসঙ্গ, আন্তর্জাতিকতাবাদের পর্যালোচনা করেছেন। গান্ধী-রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে তাঁর আগের বই, দ্য পোয়েট অ্যান্ড দ্য মহাত্মা-র কথা এই সূত্রে মনে পড়বে। বইটিতে অবাঙালি ও অভারতীয় পাঠকদের জন্য স্বল্পপরিচিত রবীন্দ্ররচনার সমাবেশ ও প্রয়োজনীয় নথির বিন্যাস প্রশংসার্হ। বস্তুত যে বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলি একটি অপরটির সঙ্গে গভীর সম্পর্কিত। অধ্যায়-বিভাজন নিতান্তই বাইরের সীমা, অন্তর্লীন যোগটি বুঝতে অসুবিধা হয় না। এখনকার উদার চিন্তকদের মতোই লেখক নির্ধারণবাদী নন, তাঁর লেখায় সর্বদাই পাঠকের প্রতি খোলা আহ্বান।

রবীন্দ্রনাথ টেগোর: অ্যাক্সিয়োলজি অব পলিটিক্স

শিবাজীপ্রতিম বসু

৫৯৫.০০

ফ্রন্টপেজ

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শন বুঝতে গেলে প্রাচ্য-প্রতীচ্য, জাত-পাত-শ্রেণি-কৌম, অহিংসা-হিংসা, শৃঙ্খলা-নান্দনিকতার ধারণা গুরুত্বপূর্ণ, লেখক তা জানিয়েছেন। এমনতর আরও কিছু ‘বিচার্য বিষয়/ভাবনা’ পাঠক ‘যোগ/অন্তর্ভুক্ত’ করতে পারেন বলে মত প্রকাশ করেছেন। লিখনশৈলীতে বিকল্প শব্দগুলিকে সর্বদা পাশাপাশি রেখে তাঁর অনির্ধারণবাদী মনোভঙ্গির সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়েছেন। এই সূত্রে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখায় ‘নেশন’ শব্দের বিপ্রতীপে যে ‘সমাজ’ শব্দটির প্রয়োগ ঘটান তার ইংরেজি রূপান্তর ‘সোসাইটি’ শব্দ দিয়ে না করলেই বুঝি ভাল ছিল, লেখক তা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলায় ‘নেশন’ শব্দটিই চালিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর লেখার ইংরেজি ভাষান্তরের সময় ‘সমাজ’ শব্দটিই রেখে দেওয়ার পক্ষপাতী অনেকে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রাবীন্দ্রিক সমাজের মধ্যে হিন্দু অনুষঙ্গ থাকলেও, পল্লিপুনর্গঠনের মাধ্যমে যে সময় গঠনমূলক স্বাদেশিকতার অনুশীলনে তিনি রত হয়েছিলেন তখন, তা ভারতবর্ষীয় সমাজের পরিপ্রেক্ষিতেই চর্চিত হচ্ছিল। বিশ শতকের তৃতীয় দশক তাঁর শিক্ষালয়ে আন্তর্জাতিকতা অনুশীলনের সময়, শ্রীনিকেতন ঘিরে পল্লিপুনর্গঠনের কাজও শুরু হয়েছে। স্বাদেশিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ঔপনিবেশিক স্বার্থের বিরোধিতা করে প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় বজায় রেখে আন্তর্জাতিকতায় উপনীত হওয়াই রবীন্দ্র-রাজনীতি।

রবীন্দ্রনাথের এই সব কাজে যে মানবগত সত্য ও সুন্দরের ধারণা মিশে আছে, লেখক তা ধরিয়ে দিয়েছেন। মানবগত সত্য ও সুন্দরের এই ধারণার মধ্যেই রয়েছে যান্ত্রিকতা-বিরোধী নৈতিকতা। সেই নৈতিকতার বোধে তিনি কেবল পরিবেশ ধ্বংসী বৃহৎ-যন্ত্রেরই সমালোচনা করেন না, গান্ধীবাদীরা যখন উপলব্ধিহীন যান্ত্রিকতায় চরকা কাটেন তারও বিরোধিতা করেন। এখানে একটি টিপ্পনী। উপনিষদের ‘শান্তম্‌ শিবম্‌ অদ্বৈতম্‌’ কী ভাবে রবীন্দ্রনাথের সুন্দরকে প্রভাবিত করে সে-প্রসঙ্গে একটি-দু’টি বাক্য থাকলে লাফ দিয়ে ‘সত্যম্‌ শিবম্‌ সুন্দরম্‌’-এ লেখককে আসতে হত না। ‘চিরনবীনতা’ লেখায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “প্রভাত এসে... প্রতিদিনই... একটি চিরন্তন কথা বলে, অথচ মনে হয় সে কথাটা নতুন।” রবীন্দ্রনাথের রাজনীতির আলোচনায় প্রতি দিনই ‘একটি চিরন্তন কথা’ বলা হচ্ছে, না কি ‘সে কথাটা নতুন’ বলে মনে হচ্ছে, লেখকে পাঠকে মিলে এ বার তা বিচার করতে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rabindranath Tagore

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy