E-Paper

জলাভূমি থেকে উপনগরী

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যখন বর্তমান সার্কুলার রোড বরাবর ‘মরাঠা ডিচ’ কাটা হয়, তখন পূর্ব দিকে বিস্তীর্ণ এলাকা জলাভূমি।

কল্যাণ রুদ্র

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:২১

শহর কলকাতার ইতিহাস নিয়ে দেশে-বিদেশে গবেষণা কম হয়নি। ১৯০১ সালে জনগণনা রিপোর্টে শহর কলকাতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখেছিলেন অতুলকৃষ্ণ রায়; অন্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হল হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের কলিকাতা সেকালের ও একালের (১৯২১), পূর্ণেন্দু পত্রীর কী করে কলকাতা হলো (১৯৭২), হরপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ফ্রম মার্শ টু টাউনশিপ/ইস্ট অব কলকাতা (১৯৯০), পি টি নায়ারের ক্যালকাটা ইন দ্য সেভেন্টিনথ সেঞ্চুরি (১৯৮৬), দেবাশিস বসু সম্পাদিত কলকাতার পুরাকথা (১৯৯০) এবং দেবযানী ভট্টাচার্যের এম্পায়ার অ্যান্ড ইকোলজি ইন দ্য বেঙ্গল ডেল্টা/দ্য মেকিং অব ক্যালকাটা (২০১৮)। এই দীর্ঘ তালিকায় নবতম সংযোজন আলোচ্য বইটি: প্রথম খণ্ডে ইস্ট সুবার্বন ও সল্ট লেকের কথা, দ্বিতীয় খণ্ডে রাজারহাট ও নিউ টাউন।

১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে জিতে যখন ইংরেজরা বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করল, তখন গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল অপরিণত, বসবাসের অযোগ্য; সুন্দরবন বর্তমান কলকাতার দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। হুগলি নদীর পাড় ছিল আপেক্ষিক ভাবে কিছুটা উঁচু। ভূমির ঢাল অনুসারে বৃষ্টির জল বয়ে যেত পূর্বে অবস্থিত এক বিস্তীর্ণ জলাভূমির দিকে। আর ছিল তিনটি শাখানদী— একটি জোড়াসাঁকোর কাছে, দ্বিতীয়টি বর্তমান গণেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউ বরাবর আর তৃতীয়টি বর্তমান আদিগঙ্গা। দিনে দু’বার জোয়ারে ফুলে ওঠা হুগলি নদীর জল ওই পথেই পুবের জলাভূমির দিকে বয়ে যেত। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা তিনটি গঞ্জ— সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা থেকে এই মহানগরীর বেড়ে ওঠার ইতিহাস তিন শতাব্দী বিস্তৃত।

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যখন বর্তমান সার্কুলার রোড বরাবর ‘মরাঠা ডিচ’ কাটা হয়, তখন পূর্ব দিকে বিস্তীর্ণ এলাকা জলাভূমি। এমনকি বর্তমান চৌরঙ্গি-ধর্মতলা এলাকাতেও তখন কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর সমান জল, যেখানে বাস করত কুমির ও নানা জলজ প্রাণী। উত্তর থেকে বয়ে আসা বিদ্যাধরী, নোয়াই ও সুতি নদীর জল এসে জমত পুবের জলাভূমিতে; জোয়ারের সময় সাগরের নোনা জল বয়ে আনত মাতলা, পিয়ালি আর কুলটী গাঙ। সাহেবরা ‘সল্ট ওয়াটার লেক’ নাম দিলেও দুই ধরনের জল মিশে যেত জলাভূমিতে। ১৭৬৪-১৭৭৭ সালে মরাঠা ডিচ ভরাট করা হল। ঔপনিবেশিক রাজধানী কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি করা তখন এক বড় চ্যালেঞ্জ। শুরু হল একের পর এক খাল কাটা— বেলেঘাটা খাল (১৮১০), সার্কুলার খাল (১৮২৯), নিউ কাট খাল (১৮৫৯), ভাঙ্গর খাল (১৮৯৭) এবং কৃষ্ণপুর খাল (১৯১০) ইত্যাদি। আশা করা হয়েছিল, পূর্বমুখী এই খালগুলি নিকাশি পথ ছাড়াও পণ্য ও যাত্রী-পরিবহণের কাজে লাগবে। শহরের আয়তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতিও হয়ে উঠল একটি জরুরি কাজ; বর্জ্য জলের নালাগুলি মিশিয়ে দেওয়া হল নিকাশি খালে। নোংরা জল মিশে পূর্ব কলকাতার জলাভূমির চরিত্র বদলে দিল। বিদ্যাধরী, পিয়ালি, মাতলা ইত্যাদি নদীগুলি মজে যাওয়ার পর পূর্ব কলকাতা প্রাকৃতিক জলাভূমি রূপান্তরিত হল নোংরা জলের জলাভূমিতে।

ইস্ট সুবার্বন ও সল্টলেক/ রাজারহাট ও নিউ টাউন: নগর কলকাতার পুবমুখী সম্প্রসারণের ইতিবৃত্ত

গ্রন্থনা: মৌমিতা সাহা,

সম্পা: শ্যামলকুমার ঘোষ

৩০০০.০০ (২ খণ্ড একত্রে)

দেশকাল

এই শতাব্দীর প্রথমার্ধেও বর্তমান ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের পূর্ব দিকে ছিল বিস্তীর্ণ জলাভূমি। ১৯৩১ সালে ইম্পিরিয়াল গেজ়েটিয়ার-এ প্রকাশিত কলকাতার এক মানচিত্রে দেখা যায়, নিউ কাট ক্যানেল আর জি কর হাসপাতালের কিছুটা দক্ষিণে সার্কুলার খাল থেকে বেরিয়ে উল্টোডাঙা হয়ে বর্তমান ই এম বাইপাস বরাবর চিংড়িঘাটায় বেলেঘাটা খালে মিশছে। হুগলি নদীর পলি দিয়ে সল্ট লেক ভরাট করার সময় নিউ কাট ক্যানেল কেষ্টপুর খালের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। জলাভূমি ভরাটের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তুচ্যুত হন স্থানীয় ভূমিপুত্ররা, যাঁরা প্রথম এই পতিত জমিকে লাভজনক আবাদ ও মাছের ভেড়িতে রূপান্তরিত করেছিলেন। এই ভূমিপুত্রদের কথা ‘লবণহ্রদের উপকথা’ শিরোনামে লিখেছিলেন ওই এলাকার আরও এক ভূমিপুত্র, প্রয়াত ভূপেশকুমার প্রামাণিক।

কলকাতার পূর্বমুখী সম্প্রসারণ শুরু হয় ১৯১১ সাল থেকে; ‘সিটি ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’-এর পরিকল্পনায় নতুন গতি পায় মানিকতলা, বেলেঘাটা-কাঁকুড়গাছি, বাগমারি, মুরারিপুকুর-উল্টোডাঙা ইত্যাদি এলাকার নগরায়ণ। ১৯৪৭ সালের পর ও-পার বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন নবনিযুক্ত সরকারের কাছে তখন সবচেয়ে কঠিন কাজ। ঔপনিবেশিক কলকাতা বেড়ে উঠেছিল হুগলি নদীর পাড় ধরে উত্তর থেকে দক্ষিণে। এ বার শুরু হল পূর্ব দিকের জলাভূমি বুজিয়ে নগরায়ণের ঔপনিবেশিক দর্শনের রূপায়ণ। ১৯৬২-তে বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে শুরু হল ‘সল্ট লেক সিটি’ নির্মাণের কাজ, আরও তিন দশক পরে স্থাপিত হল রাজারহাট ও নিউ টাউনের ভিত্তিপ্রস্তর। এই দুই বসতি কলকাতা-সংলগ্ন অত্যাধুনিক উপনগরী হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৬০-এর দশকে ‘সল্ট লেক সিটি’ নির্মাণের সূচনায় কোনও পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ ছিল না, কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে নিউ টাউন তৈরির সময় জলাভূমি সংরক্ষণের নানা আইন বলবৎ থাকলেও উপনগরীর নীচে চাপা পড়েছে ধুপির বিল, ঘুনির বিল-সহ বিস্তীর্ণ নিচু এলাকা, যা ছিল এক প্রাকৃতিক জলাধার ও জীববৈচিত্রের খেলাঘর।

পশ্চিমে ২০৫ বর্গকিমি বিস্তৃত কলকাতা মহানগরীতে এখন ৪৫ লক্ষ মানুষের বাস; আর পূর্ব দিকে ১২৫ বর্গকিমি বিস্তৃত জলাভূমি অঞ্চলে বাস করেন ১.৫ লক্ষ মানুষ— এঁরাই বিধাননগর উপনগরী নির্মাণের সময় উচ্ছেদ হওয়া ভূমিপুত্রদের উত্তরপ্রজন্ম। নামে জলাভূমি হলেও ১২,৫০০ হেক্টর এলাকায় জলাভূমির ব্যাপ্তি হল ৩৫০০ হেক্টর, আর বাকি এলাকা ডাঙা। কলকাতা থেকে প্রতি দিন খালপথে ৯১ কোটি লিটার বর্জ্য জল পূর্ব কলকাতার জলভূমির দিকে বয়ে যায়, আর এই নোংরা জল ভেড়িতে জমিয়ে পরিশোধন করে মাছ চাষ ও সেচের কাজে ব্যবহার করেন স্থানীয় ভূমিপুত্রেরা। এই কারণেই পূর্ব কলকাতার জলাভূমি এক বিরল বাস্তুতন্ত্র। ২০০২ সালে ‘রামসার সাইট’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে, আর ২০০৬ সালে সংরক্ষিত জলাভূমি বলে ঘোষিত হয়। ১৯৮০-র দশকে বারুইপুর থেকে উল্টোডাঙা পর্যন্ত ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস নির্মাণের পর ওই রাজপথের দু’পাশের রূপ আমূল বদলে গেছে, গড়ে উঠেছে আকাশছোঁয়া বহুতল, হাসপাতাল, হোটেল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বহু বেআইনি নির্মাণ— কলকাতার বাণিজ্যলক্ষ্মী এখন পূর্বমুখী। এই ভূ-উষ্ণায়নের সময়ে যখন বৃষ্টিপাতের ছন্দও বদলে যাচ্ছে, বাড়ছে অল্প সময়ে অতিবৃষ্টির প্রবণতা, তখন প্রাকৃতিক জলাধার ও ‘কার্বন সিঙ্ক’ হিসেবে সংলগ্ন পূর্ব কলকাতার জলাভূমির গুরুত্ব স্বীকৃত।

কলকাতার পূর্ব প্রান্তের বিস্তীর্ণ জলাভূমি বুজিয়ে দুই অত্যাধুনিক উপনগরী গড়ে ওঠার ইতিহাস নিয়ে বহু সরকারি ও বেসরকারি রিপোর্ট অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছে পিপল’স গ্রিন সোসাইটি। এই বিপুল তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে উপনগরী দু’টির ভূগোল-ইতিহাস রচনা সহজ নয়। বই দু’টি পড়তে বসে গ্রন্থনা ও সম্পাদনার দক্ষতার অভাব পাঠকে কিছুটা বিভ্রান্ত করবে। সূচনায় একটি পরিচ্ছেদে সময়ের পারম্পর্য অনুসারে ঘটনাগুলি সাজিয়ে দিলে পাঠকদের বুঝতে সুবিধা হত, বিশেষত আমার মতো অলস কিন্তু উন্মুখ পাঠকের। তবু এ কথা অনস্বীকার্য, দুই দশক ধরে সংগ্রহ করা নানা রিপোর্ট, কিছু বিরল ছবি এবং মানচিত্র দুই মলাটের মধ্যে বেঁধে দিয়ে দেশকাল প্রকাশনা একটি জরুরি কাজ করল। এই তথ্যভান্ডার আগামী দিনে নবীন গবেষকদের তথ্য অনুসন্ধানের পরিশ্রম কিছুটা লাঘব করবে।


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review Rajarhat New Town

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy