Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক ১...

আজও লেখকের উষ্ণ সংরাগ বহন করে

রচনাসমগ্র ১, শম্ভু মিত্র। সম্পাদনা: শাঁওলী মিত্র। আনন্দ, ৭৫০.০০তাকিয়া আর শটকার নল। দুটো মাত্র প্রতীকে একটা অবসন্ন, মলিন থিয়েটারের ছবিকে ধরে দিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। ১৯৪৭-এর একেবারে শেষে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ছোট একটা প্রবন্ধ, ‘যুদ্ধোত্তর যুগে বাংলা মঞ্চে সংকট’। গণনাট্যের সূচনার সমকালীন সেই প্রবন্ধে শম্ভু মিত্র লিখেছিলেন, ‘‘একটা ভাঙা ফিউড্যালি আবহাওয়া যেন মাকড়সার জাল দিয়ে আমাদের প্রত্যেকটা মঞ্চকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

শম্ভু মিত্র। ‘রাজা অয়দিপাউস’ নাটকে।

শম্ভু মিত্র। ‘রাজা অয়দিপাউস’ নাটকে।

আশিস পাঠক
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৪ ২২:০৫
Share: Save:

তাকিয়া আর শটকার নল। দুটো মাত্র প্রতীকে একটা অবসন্ন, মলিন থিয়েটারের ছবিকে ধরে দিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। ১৯৪৭-এর একেবারে শেষে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ছোট একটা প্রবন্ধ, ‘যুদ্ধোত্তর যুগে বাংলা মঞ্চে সংকট’। গণনাট্যের সূচনার সমকালীন সেই প্রবন্ধে শম্ভু মিত্র লিখেছিলেন, ‘‘একটা ভাঙা ফিউড্যালি আবহাওয়া যেন মাকড়সার জাল দিয়ে আমাদের প্রত্যেকটা মঞ্চকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সেকালে ছিল তাকিয়া আর শটকার নল, এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত তার অবশেষ দেখতে পাওয়া যেত কোনো কোনো থিয়েটারে। সেখানে অভিনেতাদের ঘরে গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও রামকৃষ্ণ পরমহংসের ছবি। পরমহংস থিয়েটারের গার্জেন সেন্ট হয়ে গিয়েছিলেন কিনা!’’

সংকটের কথা দিয়েই শুরু শম্ভু মিত্রের রচনাসমগ্র ১-এর। এ হয়তো নিছক সমাপতন। কারণ কালানুক্রমে বিন্যস্ত এ সমগ্র। কিন্তু শম্ভু মিত্রের এই শতবর্ষ-সূচনায় আজকের বাংলা থিয়েটারের দিকে তাকালে বোঝা যায়, সংকটের ওই কথা শুধু তাঁর সমকালের নয়, উত্তরকালেরও।

একান্ত ভাবেই সমকালের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাঁচতে হয় যে শিল্প থিয়েটারকে তার এক প্রধান পুরুষ শম্ভু মিত্রের প্রবন্ধগুলি পড়তে পড়তে বার বার মনে হয় এর আবেদন শুধু সমসময়ে নয়। বেশির ভাগ প্রবন্ধই যেন অনাগত এক সমানধর্মার জন্য লেখা, যেন তার প্রতি এক সৎ নাট্যকারের কিছু কথা, অভিজ্ঞতার কিছু নিষ্ঠাবান উচ্চারণ। যেমন, ময়মনসিংহ জেলার এক গ্রাম্য কবি নিবারণ পণ্ডিতের কথা লিখেছেন ‘নিবারণ পণ্ডিত’ নাম দিয়েই। ময়মনসিংহে গণনাট্যকর্মীদের সঙ্গে সঙ্ঘের আলোচনার জন্য সাময়িক ‘ইস্কুল’ খোলা হয়। সেখানেই নিবারণ পণ্ডিতের সঙ্গে শম্ভু মিত্রের আলাপ। চায়ের বাটি হাতে শিল্প নিয়ে সেখানে ঘরোয়া আলোচনা চলছে মননে চূড়ান্ত পরিশীলিত এক নট, নাট্য ও আবৃত্তিকারের সঙ্গে এক নিতান্ত লোককবির। বিষয় গণরুচি। সেইখানে নিবারণ পণ্ডিতের বলা কথা লিখছেন শম্ভু মিত্র, ‘আপনার সুখ-দুঃখ যদি লোকের সুখ-দুঃখ হয় তবে আপনার কথা তারা শুনতে বাধ্য। তবু যদি না শোনে তা হলে আপনার মধ্যে নিশ্চয়ই কোথাও মিথ্যে আছে।’

শিল্পগত এই সত্যমিথ্যের ভাগ করা, সত্যকে চিনে নেওয়ার অবিরত চেষ্টা এই সংকলনের বেশির ভাগ প্রবন্ধে। মাহেশ, নাটুকে দলের সমস্যা, দর্শকদের দায়িত্ব, আন্দোলনের প্রয়োজন, ইতিকর্তব্য, ভেজালের ঐতিহ্য, কয়েকটি প্রশ্ন— ছোট ছোট নামের ছোট ছোট প্রবন্ধগুলিতে বোধের কী বিপুল আলো ছড়ানো!

তাঁর সমকালের সেই সব নাট্যসমস্যা আজ আর ঠিক একই প্রকরণে হয়তো নেই। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমস্যাকে বুঝতে চেয়ে শম্ভু মিত্র বেশি করে বুঝতে চেয়েছেন সমস্যার মূলের মনোভঙ্গিটিকে। সেখানে আজও তেমন কোনও বদল ঘটেনি বলেই প্রবন্ধের বিষয়গুলি আজও বহু ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। আর, নিজের শিল্পজীবন দিয়ে সমস্যাগুলি বুঝতে চেয়েছিলেন বলেই শম্ভু মিত্রের এই প্রবন্ধগুলি আজও লেখকের উষ্ণ সংরাগটুকু বহন করে চলেছে।

১৯৫২-য় লেখা মাত্র দেড় পৃষ্ঠার একটা প্রবন্ধ, হয়তো তাকে প্রবন্ধ বলাও চলে না, সেই সংরাগের এক আশ্চর্য প্রকাশ। প্রবন্ধটির নাম, ‘ক্ষণস্থায়ী। তবু--’। শম্ভু মিত্র লিখছেন, ‘কাল নিরবধি এবং পৃথ্বী বিপুলা— একথা বলতে পারেন লেখক, বলতে পারেন চিত্রকর। কিন্তু আমরা--অভিনেতারা তা পারি না। আমাদের জন্য নয় ভাবীকালের স্বীকৃতি।... নিজের নিজের যুগের খণ্ডকালের মধ্যেই আমাদের অস্তিত্ব। সেই কালকে আমরা প্রকাশ করবার চেষ্টা করি আমাদের দেহ দিয়ে, মন দিয়ে, আবেগ দিয়ে। আমাদের সমগ্র সত্তা দিয়ে। সমকালীন জীবনের আগুন আহরণ করে সেই আগুনে আমরা নিজেদের দগ্ধ করি। কেউ কেউ হাউইয়ের মতোই পারি আকাশের বিশালতায় উঠে যেতে। আর অনেকেই পারি না। সমস্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়েও মাটির ওপরেই জ্বলি। জ্বলি, আর একদিন ফুরিয়ে যাই।’ সাম্প্রতিক কালের মন্ত্র খোঁজার এই চ্যালেঞ্জটার পরেও একটা ‘তবু’ থাকে। তাই শম্ভু মিত্র আরও লেখেন, ‘আমাদের ক্ষমতার সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কিংবদন্তী হব। ছেলেমেয়েরা যার আবছায়া গল্প শুনবে বড়ো জোর।’

এই কথাটার সত্যতা মনে রেখেই সম্ভবত এই রচনাসমগ্রের ‘নাটক’ অংশে দেখতে পাচ্ছি ‘চার অধ্যায়’ আর ‘রক্তকরবী’। সম্পাদক তার কৈফিয়ত হিসেবে লিখেছেন, ‘প্রকাশকসহ আরো বহু মানুষের ইচ্ছে ছিল তিনি রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায়, রক্তকরবী, রাজা ইত্যাদি কেমন ভাবে মঞ্চস্থ করেছিলেন, কেমন ভাবে সে-নাটকগুলো সম্পাদিত হয়েছিল তা জানানো হলে ভালো হয়। বহুরূপী পত্রিকা সে প্রয়াস করেছিল, কিন্তু তাতে সম্পাদনা এবং মঞ্চায়নের রূপায়ণ সম্পর্কে সম্ভবত কোনো বিস্তারিত টীকা ছিল না।’ উদ্দেশ্য সাধু, এতে করে ছেলেমেয়েদের আবছায়া গল্পগুলো হয়তো একটু স্পষ্ট হবে। কিন্তু তাই বলে শম্ভু মিত্রের রচনাসমগ্রে রবীন্দ্রনাথের একটি নাটক আর একটি উপন্যাসের নাট্যরূপান্তরকে সরাসরি ঢুকিয়ে দেওয়া? অন্তত পরিশিষ্ট হিসেবেও রাখা যেত এদের, অথবা রচনাসমগ্রের কোনও একটি পরিপূরক খণ্ডও করা যেত এমন নাটকগুলিকে নিয়ে।

১৯৪৭ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত ৩১টি প্রবন্ধ, চল্লিশের দশক থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত ৪টি গল্প এবং ৫টি মৌলিক, ২টি সম্পাদিত রবীন্দ্রনাটক আর ১টি রূপান্তরিত বিদেশি নাটক নিয়ে এই যে সমগ্র তা আসলে এক মহৎ শিল্পীর অনুসন্ধানের বিবর্তনকেই বুঝে নিতে চায়।

কিন্তু আজ এই পুনঃপ্রকাশে সেই অনুসন্ধানের কোনও মানে থাকত না যদি না আমাদের এই সময়ের নাট্যচিত্রের গভীরেও শম্ভু মিত্রের দেখা সেই ছবিটা প্রচ্ছন্ন থাকত। যে-বাংলা থিয়েটারে এককালে শনি-রবিবার রাত্রে তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা বিক্রি হত, সেই থিয়েটারেই মাত্র আটাশ টাকা বিক্রি হওয়ার দরুণ মিথ্যা বলে শো বন্ধ করতে হওয়ার ছবিও দেখতে হয়েছিল শম্ভু মিত্রকে। এর কারণ, তাঁর মতে, ‘সাধারণ লোকে থিয়েটার দেখাটা জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ বলে মনে করে না। আর কেন-ই বা করবে? না শিল্প না চটক, কোনোটাই তো আমাদের থিয়েটার কোম্পানিরা পরিবেশন করতে পারেন না।’

আজ নতুন পরিভাষার কোম্পানি থিয়েটারে বিক্রির অঙ্কটা বেড়েছে অনেক। থিয়েটার দেখাটা জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ বলেও হয়তো সাধারণ মানুষ মনে করেন। কিন্তু কেন? শিল্প, না সেই শটকার নল আর তাকিয়ার গল্প?

শতবর্ষে শম্ভু মিত্রের এই রচনাসমগ্র এই প্রশ্নটার উত্তর সন্ধানে আজকের থিয়েটারকে নিশ্চয় উৎসাহিত করবে!

বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার, প্রোডাকশন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

asish pathak sambhu mitra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE