Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
আজ শ্রীরামকৃষ্ণের ১৮৫তম জন্মতিথি
Ramakrishna Paramahansa

এক নতুন তীর্থের জন্ম

শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতিভা বর্ণনা করতে গিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী বিভিন্ন ভাবের, মতের, পথের সার্থক সমন্বয়কারী হিসাবে তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের সহচর আখ্যা দিয়েছেন।

স্বামী শিবার্চনানন্দ
শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

শ্রীরামকৃষ্ণের মতো মহামানবেরা যখন আসেন, তখন সেই যুগের সমস্ত সমস্যা নিরসনের জন্য একটা ছাঁচ রেখে যান। বুদ্ধের প্রদর্শিত ছাঁচে নিজেকে ঢেলে এক দিন ভারত উৎকর্ষের শিখরে উঠেছিল। খ্রিস্টের সময় পাশ্চাত্যও তাই। মহম্মদের কালে পশ্চিম এশিয়াও। স্বামী বিবেকানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে দেখেছেন বর্তমানের উপযোগী সেই ছাঁচ। যে ছাঁচ অবলম্বনে নির্মিত হবে অজস্র সর্বাঙ্গসুন্দর চরিত্র—যারা বিচারে তীক্ষ্ণ, ধ্যানে একাগ্র, ভালবাসায় সমুদ্র, কর্মে নিরলস। রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণের আগমনে পৃথিবীর বুকে ‘নতুনতীর্থ’-এর জন্ম হয়েছে।

শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতিভা বর্ণনা করতে গিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী বিভিন্ন ভাবের, মতের, পথের সার্থক সমন্বয়কারী হিসাবে তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের সহচর আখ্যা দিয়েছেন। তিনি আরও দেখেছেন, তথাগতের মতোই, এক যুগ-সঙ্কটকালে তাঁর আবির্ভাব। তিনি দেখিয়েছেন, বুদ্ধ যেমন তাঁর উপদেশগুলো পালি ভাষায় দিয়েছিলেন বা মহাবীর অর্ধ-মাগধী ভাষায়, তেমনই, শ্রীরামকৃষ্ণ ব্যবহার করেছেন সেই সব আটপৌরে ভাষা, যা বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ‍ও বোঝেন। এ ভাবে তিনি ভাষা দিয়ে গণদেবতার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছেন। আর তাঁর উপমা-চয়ন ঠিক খ্রিস্টের মতোই, দৈনন্দিন জীবন থেকে।

লোকশিক্ষক শ্রীরামকৃষ্ণ মানুষকে দিয়েছেন অসামান্য মর্যাদা! মন্দিরে যাওয়ার সমশ্রদ্ধা নিয়েই তিনি মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন। অতি প্রিয় নরেন্দ্রনাথকে যেমন বলেছেন, ‘‘তোর মধ্যে নারায়ণকে দেখতে পাই, তাই তোকে ভালবাসি’’, ঠিক তেমনই, সমাজের অপাঙ্‌ক্তেয় বারবনিতার মধ্যেও তিনি সীতাকে দেখেছেন। জানিয়েছেন তাঁকেও প্রণাম।

আধ্যাত্মিকতা তাঁর কাছে বই পড়া নয়। তিনি যা অনুভব করেছেন, উপদেশ দিয়েছেন, নিজের জীবনের পরতে পরতে তিনি প্রয়োগ করেছেন। তাই যখন তিনি মুখ খুলছেন, মহাপণ্ডিত বিদ্যাসাগর সসম্ভ্রমে তাঁর কথা শুনছেন। বঙ্কিমও তাই। বাগ্মী কেশবচন্দ্র তাঁর সামনে বক্তৃতার জন্য অনুরুদ্ধ হয়ে বলেছেন, শেষমেশ কি কামারের কাছে সুচ বেচতে আসব! আপাত দৃষ্টিতে ‘নিরক্ষর’ পূজারি ব্রাহ্মণের এই পরাক্রম আসে কোথা থেকে? আচরণে সত্য প্রতিষ্ঠিত হলে, কপটতা নির্মূল হলে পরাক্রম আসে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মনীষীরা তাঁর জীবনে গোটা পৃথিবীর ক্ষুধা মেটানোর রসদ পেয়েছেন।

আর লক্ষণীয় শ্রীরামকৃষ্ণের কৃতজ্ঞতাবোধ। যখন অন্যের কথা উপদেশে ব্যবহার করছেন, নির্দ্বিধায় বলছেন, এই কথাটি আমি উলোর বামনদাসের কাছে শুনেছিলাম বা এই কথাটি আসলে কৃষ্ণকিশোরের কথা— অন্যের কৃতিত্ব নিজের বলে কখনও তিনি চালান করেননি।

তিনি এমন এক জন গুরু-আচার্য-নেতা, যাঁকে প্রশ্ন করা যেত। দিনে-রাতে তাঁর উপর কত লোক কত পরীক্ষা করেছে! এই ভাবে পরবর্তী প্রজন্মকে তিনি তৈরি করেছেন, যারা গোটা বিশ্ব জয় করেছে খ্রিস্টের শিষ্যদের মতোই। গোপনীয়তা তিনি পছন্দ করতেন না। জীবনের প্রতিটি পর্যায় অকপটে শিষ্যদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। বলতেন, আমি এই এই করেছি, আর বর্তমানটা তো তোদের চোখের সামনে। ‘ভাবের ঘরে চুরি’ ছিল তাঁর অপছন্দের বিষয়। তাঁর হাত ভেঙে গিয়েছে, এক বালক ভক্ত সে হাত থেকে থেকে ঢেকে রাখছেন—‘অবতারের হাত ভাঙা’ দেখলে লোকে কী বলবে! তিনি সেই আবরণ সরিয়ে দিচ্ছেন। সবাইকে জিজ্ঞাসা করছেন, এটা কবে সারবে? পরিষ্কার করে জানিয়ে দিচ্ছেন: শরীর সাধু হয় না, মন সাধু হয়।

আবার, যারা স্তুতির যোগ্য নয়, অথচ স্তুতি আদায়ে সদা তৎপর, তাদের স্তুতি কখনও তিনি করেননি। ব্রিটিশ সরকার জনৈক বাবুকে খেতাব দিয়েছে ‘রাজা’। তিনি সেই রাজাকে অকপটে বলেছেন— আপনাকে রাজা বলতে পারব না। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন নির্ভীক। কিন্তু যারা ভাল হতে চায়, অথচ ভেতরের দোষগুলিকে দূর করতে পারছে না, তাদের প্রতি ছিল তাঁর অসীম অনুকম্পা। শুধু ভালবেসে তিনি অতি প্রবলস্বভাব গিরিশ, পানাসক্ত সুরেন্দ্র বা গুন্ডা মন্মথকে কোথায় তুলে নিয়ে গিয়েছেন।

এক প্রণম্য জনের লেখায় পেয়েছিলাম—সভ্যতা মানে মাধুর্যের বিকাশ, সৌন্দর্যের বিকাশ। সভ্যতা মানে ফুল দিয়ে ঢাকা শব নয়। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ছিল এই রকম ‘কাপুড়ে সভ্যতা’র সামনে মূর্তিমান প্রতিবাদ। কিন্তু সে প্রতিবাদ বড় মিষ্ট, শিশুর সারল্যে পরিপূর্ণ। বিদ্যাসাগর মশায়ের কাছে যাচ্ছেন, বালকের মতো বোতামে হাত দিয়ে ভক্তদের বলছেন, ‘‘জামার বোতাম খোলা রয়েছে— এতে কোনও দোষ হবে কি?’’ ভক্তেরা সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, ‘‘আপনি ওর জন্য ভাববেন না। আপনার কিছুতে দোষ হবে না।’’ যেন দেখাচ্ছেন, সভ্যতা কাপড়ে, এটিকেট-এ থাকে না। থাকে, সকল মানবীয় গুণের চরম বিকাশে। সৌন্দর্যের প্রকাশে। সেখানকার শৃঙ্খলা শৃঙ্খলিত নয়। সকলের প্রতি হৃদয়ের অকৃত্রিম প্রীতি সে শৃঙ্খলা নির্মাণ করেছে। যে সভ্যতায় কারও সুখ অপরের সুখকে ব্যাহত করেনি, বরং বহু গুণে বর্ধিত করেছে। এই শুভদিনে সেই সভ্যতাই আমাদের প্রার্থনীয় হোক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ramakrishna Paramahansa Birthday
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE