Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

গত পাঁচ বৎসর রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার কখনও দশ শতাংশের নীচে নামে নাই। আর, সেই রাজ্যেই কৃষকরা ক্ষোভে ফাটিয়া প়ড়িতেছেন, কৃষিঋণ মকুবের দাবি করিতেছেন, সরকারের নিকট ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কিনিয়া লইবার দরবার করিতেছেন।

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ফসলে ক্ষেত উপচাইয়া পড়িয়াছে। গত পাঁচ বৎসর রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার কখনও দশ শতাংশের নীচে নামে নাই। আর, সেই রাজ্যেই কৃষকরা ক্ষোভে ফাটিয়া প়ড়িতেছেন, কৃষিঋণ মকুবের দাবি করিতেছেন, সরকারের নিকট ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কিনিয়া লইবার দরবার করিতেছেন। মধ্যপ্রদেশের কৃষকরা মারা পড়িয়াছেন প্রাচুর্যের হাতে। উৎপাদনের প্রাচুর্য। চাহিদার তুলনায় উৎপাদনের পরিমাণ এতই বেশি হইয়াছে যে ফসলের দাম মাটিতে মিশিয়াছে। ফসল বেচিলে যতটুকু টাকা মিলিবে, তাহাতে ঋণও শোধ হয় না, সংসারও চলে না— পরের বৎসর লগ্নির জন্য টাকা সরাইয়া রাখিবার কথা বুঝি স্বপ্নেও ভাবা যায় না। ফসল মার খাইলে কৃষক যে সমস্যার মুখে পড়েন, রেকর্ড পরিমাণ ফসল ফলাইয়াও ঠিক সেই বিপদই সার হইল। তাঁহাদের দাবিগুলিকে এই বাস্তবের প্রেক্ষিতে দেখাই, অতএব, বিধেয়। তবে, তাহার পূর্বে স্মরণে রাখা ভাল, কৃষক— গোটা দেশের, অথবা কোনও একটি রাজ্যের, বা তামিলনাড়ু ও মধ্যপ্রদেশের ন্যায় একাধিক রাজ্যের— একটি মোনোলিথিক বা একশৈলিক অস্তিত্ব নহে। তাঁহাদের সামান্য অংশের নিকটই সরকারি কৃষিঋণ পৌঁছায়। আরও কম কৃষক ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সুবিধা পান। এবং, সুবিধাগুলি যাঁহারা পাইয়া থাকেন, তাঁহাদের সিংহভাগই ধনী, বা নিদেনপক্ষে সম্পন্ন, কৃষক। কৃষি রাজনীতির ভাষাটি মূলত তাঁহারাই স্থির করিয়া দেন। ফলে, কৃষকদের দাবির কথা ভাবিলে শুধু এই দাবিগুলিকে লইয়া ভাবিলেই চলিবে না— কৃষির উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন স্তরের চরিত্রের কথা আলাদা করিয়া ভাবিতে হইবে। ঋণ মকুব করিলে কৃষিঋণের অর্থনীতির ক্ষতি হয় বিলক্ষণ, কিন্তু এই অজুহাতে যদি কিন্তু অন্য কোন পথে হাঁটিলে কৃষকের প্রকৃত উপকার হয়, তাহা ভাবা বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়, তবে তাহা অবিচার হইবে।

প্রথম কথা, কৃষির পরিকাঠামো প্রয়োজন। ফসল মজুত রাখিবার মতো হিমঘর না থাকিলে বাজারের অনিশ্চয়তা কৃষকের জন্য মর্মান্তিক হইবে তো বটেই, কৃত্রিম উপায়ে দাম চাপিয়া রাখিবার প্রবণতাটিও অপ্রতিরোধ্য হইবে। বিভিন্ন বাজারের মধ্যে সংযোগের ব্যবস্থা হইলেও কৃত্রিম ভাবে দাম চাপিয়া রাখিবার খেলাটি খানিক হইলেও কমিবে। দ্বিতীয় প্রয়োজনটির নাম বিমা। শুধু ফসল নষ্ট হইলেই নহে, কোনও কারণে যথেষ্ট দাম না পাওয়া গেলেও যাহাতে কৃষকরা ক্ষতিপূরণ পান, তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে। কৃষকের জন্য ভাবা মানে যে শুধু ঋণ মকুব করিয়া দেওয়া নহে— বস্তুত, তাহা যে কোনও সুস্থায়ী সমাধান হইতে পারে না— নীতিনির্ধারকরা এই কথাটি না বুঝিলে মুশকিল।

কৃষকের জন্য সরকারের অনেক কিছুই করণীয় আছে, যাহার খানিক টাকার অভাবে হয় না, খানিক বাদ পড়িয়া যায় চিন্তার দৈন্যে। কিন্তু, সরকার সহজেই একটি কাজ পারে— কৃষি বিপণনে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের দরজাটি খুলিয়া দিলেই অনেক সমস্যার সমাধান হইয়া যায়। তাহাতে কৃষকও দাম পাইবেন, ক্রেতারও সাশ্রয় হইবে। কিন্তু মার খাইবে মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি। দলনির্বিশেষে এই শ্রেণির এমনই প্রতিপত্তি যে কৃষিক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের কথা বলিতে কোনও দলই রাজি নহে। কৃষকের স্বার্থের দোহাই দিয়া এই বিনিয়োগের পথ রোধ করিয়া আসলে কৃষকের স্বার্থহানির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়। তাহার ফল কতখানি মারাত্মক, মধ্যপ্রদেশের কৃষকরা সেই সাক্ষ্য দিবেন। তাঁহাদের মাঠভরা ফসল, কিন্তু পেটে ভাত নাই। মাথায় ঋণের বোঝা। রাষ্ট্রের নিকট পুলিশের বুলেটের অধিক তাঁহারা আর কিছু পান নাই। বিক্ষোভের আঁচে বিরোধী রাজনীতি রুটি সেঁকিয়া লইবে, এই আশঙ্কায় হয়তো তাঁহাদের ঋণ মকুব হইবে, কিন্তু, তাহার পর? রাজনীতি কি কখনও কৃষকের কথা ভাবিবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Agriculture infrastructure
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE