Advertisement
২২ মে ২০২৪

অতিকেন্দ্রিকতার ধারণাতেই বৈচিত্র্য সহ্য না করার বীজ

৩৭০ অনুচ্ছেদই কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের সুতো, যা না থাকলে ভারতের সঙ্গে হরি সিংহের চুক্তিই খারিজ হয়ে যায়। ভারত কার্যত হয়ে পড়ে দখলদার। লিখছেন তাপস চক্রবর্তী ৩৭০ অনুচ্ছেদই কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের সুতো, যা না থাকলে ভারতের সঙ্গে হরি সিংহের চুক্তিই খারিজ হয়ে যায়।

ছবি এপি।

ছবি এপি।

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৯ ০২:৪৪
Share: Save:

জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজাধিরাজ হরি সিংহ ১৯৪৭-এর ২৬ অক্টোবর ভারতে অন্তর্ভুক্তির জন্য ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন’ দলিলে স্বাক্ষর করেন। ভারতে অন্তর্ভুক্তির দলিলে ন’টি ধারা ছিল। পরের দিন গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন অব বর্মা সেটিকে স্বীকৃতি দেন এবং দলিলের শর্ত মেনেই রচিত হয় সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫ (এ) অনুচ্ছেদ।

জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সংযোজন বিষয়ক দলিল শুরু হচ্ছে এইভাবে — যেহেতু ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট’ (ভারতের স্বাধীনতা আইন) এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে যে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট থেকে ভারত নামে স্বাধীন ডোমিনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সেখানে গভর্নর জেনারেলের আদেশ অনুসারে সম্ভাব্য বর্জন, সংযোজন, অভিযোজন এবং পরিমার্জন-সহ ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯৩৫’ (ভারত সরকার আইন) প্রযোজ্য হবে।

দলিলের ৫, ৬, ৭ ও ৮ নম্বর ধারা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। ৫ নম্বর ধারায় বলা হচ্ছে— এই দলিলের শর্তাদি ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের কোনও সংশোধন এই দলিলের অনুপূরক কোন দলিল আমি (হরি সিংহ) গ্রহণ করি না। ৭ নম্বর ধারায় বলা হচ্ছে— এই দলিলের কোনও কিছু আমায় ভারতের সংবিধান মেনে নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ করবে না অথবা ভবিষ্যতে যে কোনও সংবিধানাধীন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বিন্যাসের বিষয়ে আলোচনা করার ক্ষেত্রে আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা শৃঙ্খলিত বলে বিবেচিত হবে না।

৮ নম্বর ধারা বলছে— এই দলিলের কোনও কিছুই এই রাজ্যের উপরে আমার সার্বভৌম ক্ষমতার স্থায়িত্বকে, দলিলে নির্ধারিত সংস্থান ব্যতীত অন্য ক্ষেত্রে শাসক হিসাবে আমি যে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব এবং অধিকার উপভোগ করি সেগুলিকে অথবা এই রাজ্যে বর্তমান বলবৎ আইনগুলির বৈধতাকে প্রভাবিত করবে না।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তির পরে নৃপতিশাসিত রাজ্যগুলির ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে একটি দেশে যোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল। ১৫ অগস্টের আগেই হায়দরাবাদ, জুনাগড় এবং জম্মু ও কাশ্মীর— এই তিনটি বাদে সব নৃপতিশাসিত রাজ্যই ভারতে বা পাকিস্তানে সংযোজিত হয়।

নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগরও ভারতের ‘অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ ছিল না ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্টে। ১৯৪৯ সালের ১৯ জুন সেখানে গণভোট হয়। ৭৪৬৩ জন ভারতভুক্তির পক্ষে এবং ১১৪ জন বিপক্ষে ভোট দেন। ১৯৫০ সালের ২ মে থেকে সর্বার্থে ভারতের অংশ হয় একদা ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর। তার আগেই, ১৯৪৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি গণভোট হয় জুনাগড়ে। ৯১ শতাংশ মানুষ ভোট দেন ভারতভুক্তির পক্ষে। নিজামের প্রাথমিক বাধা এবং পাক তৎপরতা সত্ত্বেও হায়দরাবাদও ভারতভুক্ত হয়। জম্মু ও কাশ্মীরই শুধু এর ব্যতিক্রম।

মনে রাখা দরকার, ১৯৪৯ সালের ৫ জানুয়ারি ভারত ও পাকিস্তানের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের কমিশন ১০ দফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেখানে ৭ নম্বর প্রস্তাবে বলা হয়: জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত সমস্ত কর্তৃপক্ষকে গণভোট প্রশাসকের সঙ্গে একযোগে সুনিশ্চিত করতে হবে যাতে — ক) গণভোট দানের উপর ভীতি প্রদর্শন, আতঙ্ক সৃষ্টি, ঘুষদান বা অন্য কোনও অসংগত প্রভাব না থাকে। খ) রাজ্যের সমস্ত নাগরিক ভারত অথবা পাকিস্তান রাজ্যের সংযোজনের প্রশ্নে নিজ মতামত প্রকাশ করার ব্যাপারে নির্ভয় ও স্বাধীন থাকেন। গ) সব রাজনৈতিক বন্দি মুক্তি পান। ঘ) রাজ্যের সমস্ত অংশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়। ঙ) কোনও রকম প্রতিশোধমূলক পীড়ন না থাকে। ১৯৪৮-এর ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে জম্মু ও কাশ্মীরে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে গণভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত ‘রেজ়োলিউশন ৪৭’ নামে ইতিহাসে পরিচিত।

এর পরেও সংশয়াতীত ভাবে কাশ্মীরকে ‘ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ বলা যায় কি? অন্তত ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জে যাওয়ার সময়ে এই দাবি করেনি ভারত। কাশ্মীরকে ‘ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ বলার কথা ভাবেনি সংবিধান সভাও। ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবরের ভারতভুক্তির দলিলের বিশেষত্ব ও শর্তেই কাশ্মীরের বিশেষ চরিত্র ও বিশেষ অধিকার মেনেছিল সংবিধান সভা। তৈরি হয়েছিল ৩৭০ অনুচ্ছেদ (মণিপুর, মহীশূর, উদয়পুর ও তেহরি গাড়োয়াল বিশেষ চুক্তিতেই ভারতভুক্ত হয়েছিল)।

৩৭০ অনুচ্ছেদ কাশ্মীর সরকারের নিজের আইন তৈরির স্বাধীনতা মেনে নিয়েছিল। বিশেষ অধিকারও মানা হয়েছিল কাশ্মীরবাসীর। সেটা বিধৃত সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে গৃহীত ৩৫ (এ) অনুচ্ছেদে। ৩৭০ অনুচ্ছেদের খসড়া লিখেছিলেন গোপালস্বামী আয়েঙ্গার, যিনি হরি সিংহের একদা দেওয়ান ও ভারতের প্রথম মন্ত্রিসভায় দফতরবিহীন মন্ত্রী ছিলেন। এই ৩৭০ অনুচ্ছেদই কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের সুতো, যা না থাকলে ভারতের সঙ্গে হরি সিংহের চুক্তিই খারিজ হয়ে যায়। ভারত কার্যত হয়ে পড়ে দখলদার।

কেউ কেউ বলছেন, অনুচ্ছেদ ৩৭০ ছিল একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা, তা সরিয়ে দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করেছেন। বিজেপি বলছে, ৩৭০ ধারা ও ৩৫ (এ) ধারার অবলুপ্তিকরণই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এই ধারার অপব্যবহার করছে, পাকিস্তানকে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর সুযোগও করে দিচ্ছে।

বস্তুত, ৩৭০ ধারার উপরে যে কোনও আলোচনার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রবাদ। যাঁরা ৩৭০ ধারা অবলুপ্তিকরণের পক্ষে যুক্তি দেন তাঁরা আসলে সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছনো কেন্দ্রীকরণকেই সমর্থন করেন। যে কোনও গোষ্ঠী বা শক্তিই এই মডেল বিষয়ে প্রশ্ন তুলবেন এবং স্থানীয় ও আঞ্চলিক বৈষম্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন, তা জাতীয়তাবিরোধী— এই বিশ্বাসই এই মতবাদের ভিত্তি। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি সুষম হিন্দু, উচ্চবর্ণ, উচ্চশ্রেণি ও অভিজাতভিত্তিক জাতির সংজ্ঞা দেওয়া হয়, যার মূল মন্ত্র এক ধরনের উচ্চকিত জাতীয়তাবাদ।

স্বাভাবিক ভাবেই, যে কোনও সাংবিধানিক বিধান যখন ভারত গঠনকারী রাজ্যগুলির বৈচিত্র্য এবং বৈধতাকে মান্যতা দেয়, তখন তা এই দৃষ্টিভঙ্গির মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। ঠিক এই কারণেই ৩৭০ অনুচ্ছেদের প্রতি এঁদের বিরাগ, এর উপর মুসলিম বিদ্বেষ তো রয়েইছে। আসলে কিন্তু ৩৭০ অনুচ্ছেদ ‘প্রতীকী’ হয়ে উঠেছে। তার বাস্তবতা সন্দেহের মুখে। যাঁরা এটি বাতিলের জন্য সক্রিয় এবং ধারাবাহিক যুক্তির জাল বিস্তার করেন, তাঁরা কেউই ধারাটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।

৩৭০ ধারা কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের একটি ভিন্ন ধারণার কথা বলে, যা একটি ঐতিহাসিক বিকাশের ফল। কিন্তু এই বিকাশের ধারাকে ১৯৫৭ সালের পর নেহরু সরকার স্তব্ধ করে দেয় ‘ভারত প্রদত্ত গণভোটের অঙ্গীকার’ কমবেশি পরিত্যক্ত হওয়ার ফলে। দ্বিতীয় তফশিলে ১ ও ৩৭০ ধারা ব্যতিরেকে যে সব ধারা জম্মু ও কাশ্মীরে প্রযোজ্য ছিল তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য অংশ ৫, ১২, ১৫, ২০ ও ২৮।

সংবিধান সংশোধন সম্পর্কিত অংশ ১২ বলছে— কেবল মাত্র ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’ (পরে রাজ্য সরকার) সম্মত হলে তবেই সংবিধানের কোনও ধারার সংশোধন জম্মু ও কাশ্মীরে প্রযোজ্য। অর্থাৎ কোনও সংশোধন জম্মু ও কাশ্মীরে প্রযোজ্য হতে হলে ৩৭০(১) ধারা মতে রাজ্য সরকারের সম্মতিতে রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি প্রয়োজন। নির্বাচন সংক্রান্ত অংশ ১৫ বলছে— রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন রাজ্যের নিজস্ব আইন দ্বারা পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত হবে। ফলে ৩৭০ ধারা বাতিল বা রদ করতে হলে সংবিধান সভা বা বিধানসভার সম্মতি প্রয়োজন। জম্মু ও কাশ্মীরে রাজ্যসভা ভেঙে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি শাসনে রাজ্যপালই ‘স্থানীয় সরকার’, এটা সঙ্গত ভাবে বলা যায় কি? কেননা রাজ্যপাল জনপ্রতিনিধিত্বের প্রতীক নন। রীতি রেওয়াজের তোয়াক্কা না করেই রদ করা হল ৩৭০ ও ৩৫(এ) সাংবিধানিক ধারাকে।

এটাও স্মরণে রাখা দরকার, ৩৭০ অনুচ্ছেদের ‘বিশেষ অধিকার’ আদৌ ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। সংবিধানের ৩৭১ অনুচ্ছেদ অনুসারে নাগাল্যান্ড, অসম, মণিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম এমনকি মোদী- শাহের গুজরাত, মহারাষ্ট্র, গোয়ার মতো রাজ্যগুলি যে বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করে তার কথা উঠছে না কেন? যাঁরা ৩৭০ অনুচ্ছেদকে সাময়িক ‘অস্থায়ী ব্যবস্থা’ বলছেন তাঁদের বোধহয় জানা নেই যে দিল্লি হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আগেই স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে এটা আদৌ ‘অস্থায়ী ব্যবস্থা’ নয়।

যারা জম্মু ও কাশ্মীরের যন্ত্রণাবিদ্ধ ইতিহাস জানেন না, উপত্যকার করুণ কাহিনি তাঁরা বুঝবেন কী করে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jammu And Kashmir Article 370 Kashmir Pakistan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE