Advertisement
E-Paper

শহর কলকাতার নীলকণ্ঠ

ভবনাথ সেনের নাম আমরা ক’জন শুনেছি? কলকাতা শহরের পূর্ব প্রান্তে বিস্তীর্ণ জলাভূমির মধ্যে গড়ে ওঠা জঞ্জালের পাহাড় খুঁড়ে একদল মানুষ সম্পদ তৈরি করে জীবন ধারণ করেন।

শশাঙ্ক শেখর দেব

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৭ ১২:২০

ভবনাথ সেনের নাম আমরা ক’জন শুনেছি? কলকাতা শহরের পূর্ব প্রান্তে বিস্তীর্ণ জলাভূমির মধ্যে গড়ে ওঠা জঞ্জালের পাহাড় খুঁড়ে একদল মানুষ সম্পদ তৈরি করে জীবন ধারণ করেন। অন্য দল পড়ে থাকা জৈব অবশেষ দিয়ে মাটির উর্বরতা বাড়িয়ে শহরে শাকসবজির জোগান দেন। আরও এক দল এই এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া শহরের নোংরা জলের জৈব সম্পদ কাজে লাগিয়ে জলাশয়গুলিতে মাছ চাষের মাধ্যমে নিজেদের রুটি রুজির এবং শহরে সস্তায় পুষ্টি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। নোংরা জল পরিস্রুত হয়ে নদীতে চলে যায়। যে-কালে শহরে বা শহরের প্রান্তে আবর্জনা জমিয়ে রাখাই ছিল দস্তুর, যখন আধুনিক আবর্জনা ব্যবস্থাপনার জন্ম হয়নি, সেই সময়ে কলকাতা শহরের প্রান্তে কঠিন এবং তরল আবর্জনার এমন প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার বিকল্পহীন উদাহরণ তৈরি করা ভবনাথ সেনের বিশেষ অবদান। উনিশ শতকের শেষ ভাগে, পটনা এবং বাঁকিপুরে আবর্জনা থেকে সার তৈরি করে তাকে সফল ভাবে ব্যবহার করে ফসল ফলানোর জন্য ভবনাথ সেন তদানীন্তন কলকাতা কর্পোরেশনের আইসিএস অফিসার মেটকাফ সাহেবের নজরে আসেন। ১৮৭৯ সালে তাঁকে ধাপা এলাকায় ২০ বছরের জন্য এক বর্গমাইল জমি লিজ দেওয়া হয়। স্থানীয় চাষিরা প্রথম দিকে আবর্জনার মধ্যে চাষ করতে রাজি না হওয়ায় ভবনাথ সেন বিহার থেকে এই বিষয়ে অভিজ্ঞ চাষি নিয়ে আসেন। ক্রমে এই এলাকা মাছ চাষ, ফসল চাষ এবং জঞ্জালকুড়ানিদের সম্পদ আহরণের মাধ্যমে এক বিশেষ চরিত্র পায়।

ভবনাথ সেনকে চিনিয়ে দিচ্ছেন যে লেখক, তাঁর নামটিও এই এলাকার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে। ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ একদা রাজ্য সরকারের মুখ্য পরিবেশ অধিকর্তা ছিলেন। অভিজ্ঞ গবেষক, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার-এর উপদেষ্টা এবং একাধিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছাড়াও যে কাজের জন্য তিনি বিশেষ পরিচিত তা হল পূর্ব কলকাতার জলাভূমিকে রামসার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত। জলাভূমি সংরক্ষণের লক্ষ্যে ১৯৭১-এ ইরানের রামসার শহরে রামসার কনভেনশন নামে যে আন্তর্জাতিক সমঝোতাটির জন্ম হয়েছিল, আজ ভারত-সহ বিশ্বের ৯০ শতাংশ দেশ তার অংশীদার। তবে পূর্ব কলকাতার এই অনন্য প্রাকৃতিক ব্যবস্থা সহ জলাভূমিটি সংরক্ষিত হোক ও রামসার স্বীকৃতি পাক, তা সবাই চাননি। বহু বাধা ছিল। এখন তো আরও আছে। লেখকের কৃতিত্ব, এই জলাভূমি সংরক্ষণের লক্ষ্যে গবেষণা করে ক্ষান্ত থাকেননি, এলাকার মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছেন, তাদের বেঁচে থাকার অধিকারের কথা বলেছেন, নাগরিক সমাজকে ক্রমাগত উসকে গেছেন।

এ-বার তিনি সেই এলাকার আবর্জনা খুঁড়ে বেঁচে থাকা মানুষের জীবনের দলিল তৈরি করছেন। এই বিচিত্র দলিলটিকে ‘ছবিতে গল্প’ বললে অত্যুক্তি হবে না। উপক্রমণিকা ছাড়া, কোনও একটি বিষয়ে কোথাও টানা এক পাতার বেশি লেখা নেই। লেখাও প্রায়শই লিখিত ভাষায় চিত্রাঙ্কন। পাতায় পাতায় এই আবর্জনা খুঁড়ে খাওয়া মানুষদের জীবনের নানা মুহূর্ত প্রকাশিত। আবর্জনার পাহাড়, আবর্জনা বয়ে নিয়ে আসা ট্রাক ও ডাম্পার, আবর্জনা খুঁটে তোলা মানুষ, অসংখ্য গবাদি পশু, আশপাশের গ্রামজীবন, মহিলাদের কাজের শেষে জ্বালানি নিয়ে বাড়ি ফেরা, বাচ্চারা, তাদের খেলাধুলো, স্নান করা, আবর্জনার বাজার, চাষ আবাদ, ফসল বিক্রি, আরও অনেক কিছু। পরিবেশবিদ্যায় ‘ফুটপ্রিন্ট’ শব্দটির তাৎপর্য নেতিধর্মী। এই বিদ্যার বিচারে আমাদের অনেকের শুধু জীবন যাপনই প্রকৃতি-পরিবেশে গভীর ক্ষত (ফুটপ্রিন্ট) তৈরি করছে। প্রায়-বৃদ্ধ এক আবর্জনাকুড়ানির ছবি দেখতে দেখতে আমরা পড়ি লেখকের মন্তব্য। এই মানুষটির মূল ভূমিকাই তো ফেলে দেওয়া সম্পদ পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা করে ক্ষতের সম্ভাবনা কমিয়ে সম্পদের মোট জোগান বাড়ানো। তা হলে তো এঁর ফুটপ্রিন্ট নেতিবাচক নয়, তা ‘পজিটিভ’!

সরকারি পৃষ্ঠপোষণায় ব্যবসায়িক লোভের থাবা বিরলতম এই জলাভূমিকে বাঁচতে দেবে কি না, সে প্রশ্ন বারবার তুলেছেন ধ্রুবজ্যোতি। ২০০৫ এবং ২০১৫-র দুটি উপগ্রহ চিত্র পাশাপাশি পেশ করে দেখিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী যে এলাকার জমি ব্যবহারের চরিত্র কোনও মতেই পরিবর্তন করা যায় না, সেখানে কী বিপুল দখলদারি চলছে!

একটা ছবি কিন্তু খুঁজে পাওয়া গেল না— কমপ্যাক্টর মেশিন। শহর জুড়ে এর ব্যবহার এবং ধাপা এলাকায় এর আনাগোনা শুরু হয়েছে সম্প্রতি— দুই তিন বছর। এই মেশিন শহরের কোনও ভ্যাটে আবর্জনা জমতে না দিয়ে, প্লাস্টিক থেকে খাবারের উচ্ছিষ্ট, সব কিছু মিশে থাকা আবর্জনাকে ছোটো করে মণ্ড বানিয়ে ধাপায় ফেলে আসছে। আপাতদৃষ্টিতে নগরবাসী খুশি— জঞ্জাল পরিবহণের সময় রাস্তায় ময়লা ছড়াচ্ছে না, নোংরা তরল চুঁইয়ে পড়ছে না। কিন্তু এই আবর্জনা-মণ্ড থেকে কুড়ানিরা সম্পদ খুঁজে নিতে পারবে না। এর থেকে পচনশীল অংশ চাষের মাঠে ছড়িয়ে যে-ভাবে কৃষকেরা জমি উর্বর করত, তা-ও হবে না।

দ্য ট্র্যাশ ডিগার্স, ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস

Bhabanath Sen Garbage
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy