বয়স বাইশ, দেখতে বাহান্ন। জীবনে তিরিশটা বছর যোগ হল না বিয়োগ হল, তা হিসাব করার সামর্থ্যও তার ছিল না। অথচ তার, মল্লিকা মুর্মু-র, সাধ ছিল, আকাঙ্ক্ষা ছিল, ভাইটা একটু বড় হয়ে গেলে নিজের সংসার পাতবে। খেতমজুর বাবা-মায়ের সন্তান, জন্মের সময়ই তাদেরও কপালে লেখা হয়ে যায়, ‘জীবিকা মজুরি’। সে শুধু অপেক্ষা করছিল, ভাইটা মজুর খাটার মতো হয়ে উঠুক। ততদিন সে বৃদ্ধ মা-বাবা, ভাইয়ের ক্ষুধা নিবারণে একাই খেটে যাবে। সে-সময়টুকুও তার হল না; কপালে অন্য প্রতীক্ষা লেখা ছিল— কখন দুঃখহরণ মৃত্যুর দয়ালু স্পর্শ তাকে অসহ্য দেহপীড়া থেকে মুক্তি দেবে! মা কপাল চাপড়ায়, মেয়েটার বিয়ে পর্যন্ত হল না। বাপের দুশ্চিন্তা, ক’দিন পরই ভিক্ষায় বেরোতে হবে, বালক ভাই মজুরিতে লেগে গেছে বটে, কিন্তু পুরো মজুর হয়ে না উঠলে পুরো মজুরি তো পাবে না।
পশ্চাৎপট সরল। পেটে ব্যথা ওঠে। বাড়ির ১০ কিলোমিটার দূরে সিয়ান (বোলপুর মহকুমা) হাসপাতাল। নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক কর্মী পরামর্শ দেন, এক প্রাইভেট নার্সিং হোমে যেতে: “তোমার তো কার্ড আছে, খরচ লাগবে না।’’ কার্ড মানে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনার (আরএসবিওয়াই) কার্ড। ২০০৮ সালে চালু হওয়া এই যোজনার ব্যবস্থায় বলা হয়েছিল, গরিব এবং অন্যান্য দুর্গত শ্রেণিভুক্ত পরিবারগুলোর জন্য বছরে সর্বাধিক তিরিশ হাজার টাকা পর্যন্ত— হাসপাতালে ভর্তি হলে— চিকিৎসার বিমা করা থাকবে; পরিবারগুলোকে দেওয়া কার্ড দেখিয়ে সরকার নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানগুলোর যে কোনওটায় চিকিৎসা মিলবে; এ-বাবদ যা খরচ হবে, তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিমা সংস্থার কাছ থেকে উসুল করবে। প্রসঙ্গত, বিমার অন্তর্ভুক্ত চিকিৎসার পদ্ধতি ছিল ১,০৯০টি, যাদের বিমা মূল্য ছিল ১০০ টাকা থেকে ৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত।
মল্লিকা তো অক্ষরবঞ্চিত, এম এ, পিএইচ ডি করা লোকেদের পক্ষেও কোনও হাসপাতাল কী চিকিৎসা বাবদ কত টাকা কাটল তার থই পাওয়া কঠিন। যা-ই হোক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরীক্ষানিরীক্ষা করে মল্লিকার পেটে পাথর পেলেন, অপারেশন হল, কার্ড থাকা সত্ত্বেও নয়-নয় করে হাজার দুয়েক টাকা খরচাও হল। আরোগ্য হল না। এ-দিকে হাসপাতাল থেকে বলা হল, “কার্ডে টাকা ফুরিয়েছে, চিকিৎসা করতে হলে টাকা দিতে হবে।” সরকারি হাসপাতাল জানিয়ে দিল, কলকাতা নিয়ে যেতে হবে। “কোথায় কলকাতা, সেখানে যেতে খরচ তো আছেই, তা ছাড়া কোথায় হারিয়ে যাব, কে জানে; এ আমাদের কপালের দোষ।”
শুধু মল্লিকাই নয়, দুলু বাগদি, মজহর হোসেন-এর মতো বহু লোকেরই জীবনে সরকারি ভরতুকিতে বেসরকারি চিকিৎসা থেকে নেমে এসেছে দুর্বিপাক। আমার গবেষণার ক্ষেত্র ছিল বীরভূম, যেখানে মোড়ে মোড়ে আরএসবিওয়াই কার্ডধারীদের সাদর আমন্ত্রণ: “সুবর্ণ সুযোগ! সুবর্ণ সুযোগ!… বিনা মূল্যে অর্শ, ভগন্দর, হার্নিয়া, হাইড্রসিল… চোখের ছানি নেত্রনালীর অপারেশন করার সুযোগ!... বিশেষ দ্রষ্টব্য: মহিলাদের বন্ধ্যাত্বকরণ করা হয়!” ভারতের বহু শহরে একই রকম বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। অজ্ঞ-অনভিজ্ঞ লোকেরা যাতে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয় তার ব্যবস্থায় লেগে পড়ে সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী, নার্সিং হোম মালিক সরকারি-বেসরকারি ডাক্তার, হাতুড়ে, আর নানান খুড়তুতো-খালাতো-ইতস্তুতো দরিদ্রজীবী। বেসরকারি নার্সিং হোম ব্যবসা করতে নেমেছে, মুনাফার টানে বিশ্বাসের অপসরণ যে একটা আর্থনীতিক নিয়ম, এবং সে-কারণে বিমা নয়, সরকার পরিচালিত সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা যে একটা নৈতিক দাবি, বিশ্রুত অর্থতাত্ত্বিক কেনেথ অ্যারো তা জানিয়েছিলেন ১৯৬৩ সালে। শুধু অপচিকিৎসার বিপদই নয়, তার চেয়ে বড় কথা, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ঝুঁকি মাপবার মতো বিদ্যা এখনও জীববিজ্ঞানের অনায়ত্ত, কখনও যে তা দখলে আসবে এমন বলা কঠিন। সমাজতান্ত্রিক, এমনকী উদার গণতান্ত্রিক ভাবধারার বহু দেশে তাই স্বাস্থ্যের জন্য রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অঙ্গীকারটা দৃঢ় থেকেছে, এবং মানুষ তার সুফল পেয়েছে। বিপরীতে, স্বাস্থ্যকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পরিণাম যে খুব শুভকর হয়নি তার সবচেয়ে বড় নিদর্শন আমেরিকা— যে দেশের এক দিকে আছে সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসাদানের ব্যবস্থা, অন্য দিকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর বিপুল সংখ্যা।
ভারত সরকার শুনেও শোনেনি, দেখেও দেখেনি। স্বাধীনতার পর অসম্পূর্ণ ভাবে হলেও যে সরকারি পরিষেবা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তাকে সম্পূর্ণতার দিকে নিয়ে না গিয়ে ক্রমশ বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, যে ভাবে চলছিল, তাতে বাজারের মন ভরছিল না। তার ঘরে যা আসছিল, তা মানুষের ব্যক্তিগত আয়-সঞ্চয়-সম্পত্তিবিক্রয়-ঋণ থেকে। সরকারি কোষাগার লুট করতে না পারলে বড় মুনাফাতে হাত পৌঁছয় না। উপরন্তু, প্রথম ইউপিএ আমলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারি নিষ্ক্রিয়তার কিছুটা ঘাটতি মেটানোর প্রয়াসে জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের মতো পদক্ষেপগুলো কিছুটা হলেও স্বাস্থ্যব্যবস্থার ইতিবাচক পুনর্নির্মাণের সংকেত দেয়। তাই ব্যবস্থা হল সরকারি টাকায় বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবসার, বিমা যার উপকরণ।
২০১৫-১৭ সালে আরএসবিওয়াই নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বুঝেছি, এবং বিভিন্ন সমীক্ষা থেকেও দেখা গিয়েছে, ব্যবস্থাটা কতটা প্রবঞ্চনাপূর্ণ। প্রথমত, আরএসবিওয়াই বাস্তবত নিখরচার নয়, এর ব্যবহারকারী প্রত্যেককেই কিছু না কিছু টাকা খরচ করতে হয়েছে (আমার সমীক্ষায় গড়ে ভর্তি-পিছু আড়াই হাজার টাকা)। আবার যে যত দুর্বল, কণ্ঠহীন, তার খরচ তত বেশি। দ্বিতীয়ত, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের বাজার খুলে গিয়েছে। ছত্তীসগঢ়, মহারাষ্ট্রের আদিবাসী এলাকায় বন্ধ্যাত্বকরণ, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ডে ছানি অপারেশন, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে লোক ঠকানো থেকে নিয়ে প্রাণ, নিদেনপক্ষে অঙ্গহানি পর্যন্ত নানা মাপের নানা পাপের কথা বহুবিদিত। তৃতীয়ত, যে রাজ্য বা এলাকাগুলোতে অধিকতর দুর্বল শ্রেণির বাস, সেখানে সরকারি পরিষেবা নেই। আবার লাভের মধু নেই বলে বেসরকারি পরিষেবাও ওঝা-হাতুড়েতে সীমিত। উদাহরণ ঝাড়খণ্ড। সেখানে সরকার আরএসবিওয়াই-এর জন্য যে-সব প্রতিষ্ঠানকে নথিভুক্ত করেছে তার ১৫ শতাংশই হল প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র (পিএইচসি), যেগুলোতে রোগী ভর্তির সুবিধা নেই (যদিও আরএসবিওয়াই কেবল ভর্তি হওয়া রোগীদের জন্যই)। চতুর্থত, যে রাজ্যে গরিব এবং নিরক্ষর যত বেশি, সে-সব রাজ্যে এতে নথিভুক্তির হার তত কম। উদাহরণ, ২০১৬ সালে বিহারে আরএসবিওয়াই-তে নথিভুক্তির ব্যাপ্তি ছিল মাত্র ১২ শতাংশ (সারা দেশে ৫৪ শতাংশ); বিপরীতে কেরলে সংখ্যাটা ছিল ৯০ শতাংশ। কেরল সরকারি পরিষেবার ক্ষেত্রে কোনও আপস না করেই আরএসবিওয়াইকে কেন্দ্রীয় সরকারের কৃপণ হাত থেকে চুইয়ে পড়া যৎসামান্য অর্থের সদ্ব্যবহারে লাগায়, বিহার কোনওটাই করতে পারে না।
অর্থাৎ, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়া বাকি সব কিছুই ওপর থেকে মলম লাগানো, দেহমন্দিরের অন্তর্ভাগে কলুষের নির্ভয় নিবাস। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য ডাক্তার লাগে, নার্স লাগে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে সচল করতে হয়। সেটা থাকলে হাসপাতালের ওপর চাপ কমে, জনজীবনও অনেক স্বাভাবিক এবং উৎপাদনশীল হয়। হা হতোস্মি! কেরল, তামিলনাডু, হিমাচলের মতো কতিপয় ব্যতিক্রম বাদ দিলে দেশ জুড়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, নেহরু যুগে অসম্পূর্ণ ভাবে গড়ে তোলা পরিকাঠামোর এক অতিকায় কঙ্কাল। তার হাড়-পাঁজরার খাঁজে খাঁজে শুধুই অভাব। মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ একটা ব্যবস্থা যদি জীবিত থাকত, তা হলে মল্লিকা এবং তার মতো হাজার হাজার প্রাণ অকালে বিলীন হত না।
২০১৭-র ১ ফেব্রুয়ারি মল্লিকার বাবা যখন নিজের কপালকে দুষছিলেন, তখনই সংসদে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় ঘোষণা করছিলেন, গরিবদের জন্য স্বাস্থ্যবিমার অঙ্ক বাড়িয়ে এক লক্ষ টাকা করা হবে। তারও এগারো মাস আগে, ২০১৬-র ২৮ ফেব্রুয়ারি, একই লোক ঠিক একই কথা শুনিয়েছিলেন। স্বাধীন ভারতে বাগ্বিস্তারে শীর্ষস্থানাধিকারী সরকারের তহসিলদার এ-বারে পাঁচ গুণ উদার, ১০ কোটি পরিবারের প্রতিটির জন্য বছরে পাঁচ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবিমা! অনেকে উচ্ছ্বসিত, কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন, এত টাকার জোগাড় হবে কোথা থেকে। কেউ বলছেন এটাও বাক্যমাত্র। অর্থমন্ত্রীর ভাষণটা বোধহয় এমন বাক্য যার কোনও ক্রিয়ার দায় নেই! যে সরকার মানুষের অসহায়তা নিয়ে অশ্লীল তামাশা চালিয়ে যায়, ক্ষমতা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবার দায় তার নেই। কিন্তু ভারতের তো আছে। সে দায় প্রশ্ন করার, কথার কথা বা ক্রিয়াহীন কথার বদলে প্রশ্নবাচী কথা বলার। প্রশ্নই হতে পারে মানুষের সুস্থ, মুক্ত, সুখী জীবনের বিমা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy