Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

অগ্রাধিকার

একেবারে গোড়াতেই বাদ পড়িবে বাজারব্যবস্থার সর্বাধিক পরিচিত নীতিটি— যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি দাম দিতে সম্মত হইবেন, পরিষেবা তাঁহারই প্রাপ্য।

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২০ ০০:৩৬
Share: Save:

গুজবই, কিন্তু সত্যের মিশেলহীন নহে। ইটালিতে কোভিড-১৯’এ আক্রান্ত বৃদ্ধবৃদ্ধাদের বিনা চিকিৎসায় মরিতে দেওয়া হইতেছে, ইহা গুজব। কিন্তু, যাঁহাদের বাঁচিবার সম্ভাবনা সর্বাধিক, তাঁহাদেরই চিকিৎসায় অগ্রাধিকার দেওয়া হইবে, এমন নীতি অনুসৃত হইতেছে— এই কথাটি সত্য। অগ্রাধিকারের প্রশ্নটি আসিতেছে, কারণ কোভিড-১৯’এর কারণে যত লোকের চিকিৎসা প্রয়োজন, ইটালির স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর পক্ষে সেই ভার বহন করা অসম্ভব। ভারতের পক্ষেও সম্ভব কি? কোভিড-১৯ যদি ভারতে সত্যই তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করে, কে বলিতে পারে, চিকিৎসায় অগ্রাধিকারের প্রশ্নটি উঠিবে না? কথাটি শুনিতে ভয়ঙ্কর— অসুস্থ ব্যক্তি চিকিৎসা পরিষেবা হইতে বঞ্চিত হইবেন। কিন্তু, চাহিদা যদি জোগানের বহু গুণ হয়, তবে কাহাকে না কাহাকে বঞ্চিত না করিয়া উপায় কী? প্রশ্ন হইল, কে অগ্রাধিকার পাইবেন আর কে পাইবেন না— তাহা স্থির করিবার সর্বাপেক্ষা ন্যায্য নীতিটি কী হইতে পারে?

একেবারে গোড়াতেই বাদ পড়িবে বাজারব্যবস্থার সর্বাধিক পরিচিত নীতিটি— যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি দাম দিতে সম্মত হইবেন, পরিষেবা তাঁহারই প্রাপ্য। কোনও সুস্থ সমাজ (আপৎকালীন) চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে এই নীতি গ্রহণ করিতে পারে না। ‘আগে আসিলে আগে পাওয়া যাইবে’-র নীতিও এই ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নহে। তাহার মধ্যে যদিও নিরপেক্ষতা আছে, কিন্তু বিচার নাই। চিকিৎসার প্রয়োজন কাহার কতখানি, এই নীতি তাহা দেখিবে না। প্রশ্ন যেখানে প্রাণদায়ী চিকিৎসা পরিষেবার বণ্টনের, তখন প্রয়োজনের কথাটিও বিচার করিতে হইবে বইকি। তবে কি যত জনের চিকিৎসা প্রয়োজন, তাঁহাদের সকলের মধ্যে পরিষেবার সমবণ্টন বিধেয়? না কি, যে রোগী যতখানি বঞ্চিত, অনগ্রসর, তাঁহাকে তত বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া বিধেয়? না কি, অগ্রাধিকারের কথা ভাবিতে হইবে সমাজের সর্বোচ্চ সামগ্রিক কল্যাণের কথা মাথায় রাখিয়া? অর্থাৎ, কাহাকে অগ্রাধিকার দিলে তাহা সমাজের পক্ষে সর্বাধিক লাভজনক, ইহা কি তবে বিবেচ্য হইতে পারে?

অর্থনীতির যুক্তি এই সামগ্রিক কল্যাণের অনুসারী অগ্রাধিকারের নীতিকে বাছিতে বলিবে। অর্থাৎ, এক দিকে যাঁহার সুস্থ হইয়া উঠিবার সম্ভাবনা বেশি, এবং অন্য দিকে, যিনি বাঁচিয়া থাকিলে সমাজের সর্বাধিক কল্যাণ সাধিত হইবে, চিকিৎসায় তাঁহারই অগ্রাধিকার। প্রশ্ন উঠিবে, সেই লোকটি বা লোকগুলি কে, তাহা বাছিয়া লইবার অধিকারী কে হইবেন? সেই সিদ্ধান্তে যে স্বজনপোষণ কিংবা শ্রেণিবৈষম্য কিংবা গোষ্ঠীবিদ্বেষের ন্যায় হরেক রকমের ফাঁকফোকর থাকিয়া যাইবে না, তাহা নিশ্চিত করিবে কে? তর্কের খাতিরে ধরিয়া লওয়া যাউক, কোনও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক এই বাছাইয়ের কাজটি করিবেন। কিন্তু, যাহা সমাজের পক্ষে সর্বাপেক্ষা মঙ্গলের, তাহা যে ব্যক্তির পক্ষেও সমান গ্রহণযোগ্য— বিশেষত, সমাজের স্বার্থে যিনি ত্যাগস্বীকার করিতে বাধ্য হইতেছেন, তাঁহার পক্ষে— এমন দাবি করা অসম্ভব। সমাজকে আর কিছু দেওয়ার অধিকার নাই বলিয়া কাহারও বাঁচিবারও অধিকার থাকিবে না, ভাবিয়া দেখিলে, ইহা এক ভয়ানক পরিস্থিতি। সত্য হইল, এই অবস্থায় এমন কোনও পথ খোলা নাই, যাহা প্রকৃতার্থে গ্রহণযোগ্য। সেই পথটি রাষ্ট্র সজ্ঞানে ফেলিয়া আসিয়াছে— পথটি এমন স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়িয়া তোলার, যাহাতে সঙ্কটকালে এমন ভয়াবহ বিকল্পের সম্মুখে দাঁড়াইতে না হয়। সেই পথে হাঁটা যে অসম্ভব নহে, কিউবা দেখাইয়া দিয়াছে। দক্ষিণ কোরিয়া হইতে সিঙ্গাপুর, বহু দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোতেই সেই জোর আছে, যাহাতে প্রাণ বাঁচাইবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের প্রশ্ন উঠে না। যে দেশগুলি পারে নাই, এই নৈতিকতার সঙ্কট একান্ত ভাবেই তাহাদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE