ছবি: তিয়াসা দাস
অনেক দিন আগে ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’ নামের অদ্ভুত এক ভ্রমণকাহিনি পড়েছিলাম, যেখানে স্বয়ং দেবতারা কলকাতা দর্শনে এসেছিলেন। লেখক দুর্গাচরণ রায় আমার মনোহরণ করেছিলেন। করোনাক্রান্ত কলকাতায় গৃহবন্দি অবস্থায় ওই বইটা অনেক দিন পরে খুঁজে পেয়ে মনে হল— ১৮৯৮তে প্লেগাক্রান্ত কলকাতার ছবি এই লেখক নিশ্চয় এঁকেছেন। কিন্তু প্রথমেই হতাশা, দেখছি লেখকের দেহাবসান ১৮৯৭, অতএব কলকাতার প্লেগের কোনও বর্ণনা প্রত্যাশা করা যায় না। কলকাতার প্লেগে বিবেকানন্দ, সদানন্দ ও সিস্টার নিবেদিতার ভূমিকা তো এর পরের বছর থেকে। আরও দেখলাম, এই বিচিত্র ভ্রমণকাহিনী ‘কল্পদ্রুম’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হবার পরে বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ সালে।
ভাবছি নানা বিষয়ে পৃথিবীর নানা লেখকের কত বই আছে, এ সবের যে সব প্রমাণ আমার ছোট্ট ফ্ল্যাটে আছে তা সিন্ধুতে বিন্দুমাত্র। লক ইন-এর ভিকটিমদের এই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
শচীপতি ইন্দ্র একদিন নিজ বৈঠকখানায় বরুণ-সহ বসে থাকতে থাকতে মর্ত্যভূমি দর্শনের ইচ্ছাপ্রকাশ করলেন। বরুণকে বললেন, তুমি তো সর্বক্ষণ পৃথিবীতে থাক, তোমাকে তো সর্বদেশে সর্বস্থানে সর্বজনকে যথাসময়ে জল জোগাইতে হয়। বরুণ বললেন, মর্ত্যের রাজা ইংরেজ। “স্বর্গে ইংরাজাধিকৃত স্থান নাই বটে, কিন্তু সত্বরেই বোধ করি, স্বর্গরাজ্যও ইংরাজরাজের করতলগত হইবে।”
কলকাতার গুণগানে মুখর বরুণ যে দীর্ঘ বর্ণনা শুরু করেছিল তাতে কুইনাইন ঔষধের বর্ণনা প্রসঙ্গে লেখা ছিল, কুইনাইনের শিশি সম্বল করিয়া ‘‘কত শত গণ্ডমূর্খ ধন্বন্তরি পথে পথে ডিসপেন্সরি খুলে বিরাজ করিতেছে।’’
প্লেগ কবলিত কলকাতার ছবি অবশ্যই দেবতাদের চোখে পাওয়া যেত লেখক দুর্গাচরণ রায় যদি আর কয়েক বছর বাঁচতেন। কিন্তু হতাশ হয়ে লাভ নেই, বইটা ওল্টাতে ওল্টাতে পুরনো বিপর্যয়ের নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া গেল। এই দুর্যোগের সংক্ষিপ্ত বিবরণও আজও আমাদের প্রয়োজন। বরুণ তাঁর প্রিয় ইন্দ্রকে বলছেন— ‘‘১৭২৭-এর অক্টোবর মাসে ঝড়ে ও ভূমিকম্পে সেন্ট জনস চার্চের চূড়া ভাঙ্গে এবং কলকাতার প্রায় দুইশত গৃহ নষ্ট হয় এবং প্রায় ২০,০০০ ডিঙ্গা, নৌকা ও জাহাজ নষ্ট হয়। ইংরাজদিগের নয়খানি জাহাজের মধ্যে আটখানি নষ্ট হয়। এই ঝড়ে ভূমিকম্পে প্রায় ৩০,০০০ লোক মারা যায়।’’ এর পর আছে ১৭৫৭তে পলাশীর যুদ্ধের খবর, লর্ড ক্লাইভের নানা সংবাদ। তার পর আছে বাংলা ১১৭৬ সনে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। ‘‘ইহাতে ১৫ই জুলাই হইতে ১০ সেপ্টেম্বর মধ্যে ৭৬,০০০ লোক মারা যায়। ইহার উপর অগ্নিকাণ্ডও ঘটিয়েছিল। টাকায় চারিশের চাউল বিক্রি হইয়াছিল।’’
এই বইয়ের শেষ প্রান্তে মন্বন্তর ও মহামারীর সংক্ষিপ্ত সুখপাঠ্য বিবরণ পাওয়া গেল। দেবরাজের আদেশে এবং গণেশের উদ্যোগে অমরাবতীতে একটি বৃহৎ সভার আয়োজন হয়েছিল। ছত্রিশ কোটি দেবদেবী সেখানে উপস্থিত। বিশিষ্ট উপস্থিতি ডোমের স্কন্ধে শীতলা, বিড়াল আরোহণে ষষ্ঠী প্রভৃতি। ‘‘এতদ্ভিন্ন নানা প্রকার রোগ, যথা— জ্বর, কারবঙ্কল, বহুমূত্র... প্রভৃতি আসিয়া জুটিতে লাগিলেন।’’ আরও আসিলেন, ‘‘বৃষ্টিবাদল ঝড়, মহাঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জলস্তম্ভ, ভূমিকম্প প্রভৃতি।’’ পিতামহের সভাপতিত্বে দেবরাজ দণ্ডায়মান হয়ে বললেন, ‘‘হে অমরবৃন্দ! আমরা সম্প্রতি মর্ত্যে গমন করিয়াছিলাম। তথায় যেরূপ দেখিলাম, তাহাতে পৃথিবী ধ্বংস করিবার ইচ্ছা করিয়াছি। মর্ত্যে ব্রাহ্মণগণের আর ব্রাহ্মণত্ব নাই... পূর্বকার ব্রাহ্মণেরা দাসত্ব করিতেন না, কিন্তু এখনকার ব্রাহ্মণেরা পাঁচ টাকা বেতনে কনস্টাবেল ও মেথরের পেয়াদাগিরি পর্যন্ত করিতেছেন... পূর্বকার ব্রাহ্মণেরা সকলের বাড়ি যাজন ও আহার করিতেন না, এখন ব্রাহ্মণেরা দক্ষিণা পাইলে বেশ্যাবাড়ী, ধোপার বাড়ীতেও আহার করিতে ছাড়েন না।... এখনকার ব্রাহ্মণদিগের সন্ধ্যা করা দূরে থাক, বেশ্যা পরিচারিকা লুচি ও বেগুনভাজা না আনিলে জল খান না।... ব্রাহ্মণেরা কন্যা বিক্রয় করিতেছেন ও কেহ কেহ পরিবর্তে বিবাহ করিতেছেন।’’
দেবরাজ ইন্দ্রের ভাষণ দীর্ঘ, শেষে বললেন, ‘‘এক্ষণে মনুষ্যের আর সৎপ্রবৃত্তি নাই, কুপ্রবৃত্তিতে দেহ পরিপূর্ণ। এই নিমিত্ত আমি পৃথিবী ধ্বংসের অভিলাষ করিয়াছি।’’ তখন চতুর্দিক থেকে সাধু সাধু শব্দে সকলে করতালি দিলেন।
পিতামহ তখন বললেন, “আমি পৃথিবীকে একেবারে ধ্বংস না করে ক্রমে ক্রমে করতে ইচ্ছা করি। অতএব উপস্থিত দেবগণের মধ্যে কে কি ভার নিতে প্রস্তুত আছে জানতে চাই।’’
আরও পড়ুন: মারী নিয়ে ঘর: স্বামীজি সেই সময় কী করেছিলেন
‘‘তখন সংক্রামক রোগ গাত্রোত্থান করিয়া কহিলেন, কেবল আমার দ্বারাই বাংলা ধ্বংস হইয়াছে। আমি ১৮২৪ খৃষ্টাব্দে যশোহরের অন্তর্গত মহম্মদপুর নামক গ্রামে প্রথম আবির্ভূত হই। তারপর ১৮২৫/২৬ অব্দে যশোহর ও তৎসন্নিহিত অনেকগুলি স্থানের লোককে সংহার করিয়া ১৮৩২/৩৩ অব্দে নদীয়া জেলায় প্রবেশ করি এবং অনেকগুলি গ্রাম নষ্ট করিয়া ১৮৫৬ সালে উলাতে আসিয়া দেখা দিই। উক্ত নগর ধ্বংস করিয়া ১৮৫৭ অব্দে রাণাঘাটের নিকটস্থ অনেকগুলি গ্রাম নষ্ট করি। তৎপরে ১৮৫৯ অব্দে কাঁচড়াপাড়ায় উপস্থিত হই। কাঁচড়াপাড়া ধ্বংস করিয়া গঙ্গা পার হই এবং হুগলীর উত্তরপূর্বাংশ ও বারাসত ধ্বংস করিয়া তৎপর ১৮৫৯/৬০ অব্দে শান্তিপুরে শুভাগমন হয়। তথা হইতে ১৮৬৪ অব্দে কৃষ্ণনগরে যাই। ১৮৬৭ অব্দ পর্যন্ত থাকিয়া নগরের এক তৃতীয়াংশ লোক নষ্ট করিয়াছি। ডিঃ গুপ্তর মিক্শ্চার ও সুধাসিন্ধু প্রভৃতি কতকগুলি ঔষধ হইয়া আমার প্রতাপ একটু কমিয়াছে। কিন্তু সম্পূর্ণরূপে সামলাইতে লোকের অনেক কাল লাগিবে। এক্ষণে আপনারা যদি বলেন ত পুনরায় একবার কোমর বাঁধিয়া লাগিব।’’
ছোট একটি প্যারায় মহামারির এমন ইতিহাস আর কোথায় পড়েছি বলে মনে করতে পারছি না। দুর্গাচরণ রায় তাঁর বিখ্যাত বইয়ের শেষ দুটি পাতায় কলকাতায় প্লেগাক্রমণের পূর্ববর্তী পটভূমিটি নিপুণভাবে অঙ্কন করেছেন।
সংক্রামকের ভাষণের পর— ‘‘তখন পালা জ্বর, হাম জ্বর, বসন্ত প্রভৃতি রোগেরা ‘বেশ’ ‘বেশ’ শব্দ করিয়া কহিল, আমরাও তোমার যথেষ্ট সাহায্য করিব। ওলাউঠা উঠিয়া কহিলেন, আমি বুড়া হওয়ায় যদিও পূর্বের ন্যায় সামর্থ্য নাই, তথাপি প্রাচীন হাড়ে আর একবার লাগিয়া দেখিব।
অতিবৃষ্টি কহিল, আমি অনবরত জল ঢালিয়া দেশ ভাসাইয়া দিব, তাহা হইলে শস্য নষ্ট হইয়া যাইবে ও লোক খাইতে না পাইয়া মারা যাইবে।
শুখা কহিল, তোমার হাতে নিস্তার পাইয়া যদি দুই একটি ক্ষেত্র বাঁচে, শস্য পাকিবার পূর্বে আমি শুকাইয়া দিব।
অগ্নিবৃষ্টি কহিল, পৃথিবী ধ্বংসের আবার ভাবনা কি, আমি মধ্যে মধ্যে এক এক স্থানে দেখা দিলে কুটটি পর্যন্ত থাকিবে না।
জলস্তম্ভ কহিল, আমি যদি এক এক বার দেখা দিই— যেদিক দিয়া যাইব ৫/৭ মিনিটের মধ্যে বাড়ী ঘর ফরশা হইয়া পরিষ্কার রাস্তা হইবে।
ভূমিকম্প বলিল, আমি যদি পাঁচ মিনিট একটু জোর করে পৃথিবীকে নাড়া দিই, তাহা হইলে বাড়ী ঘরদোর, মানুষ, পশু, গাছপালা প্রভৃতির আর কোনও চিহ্নমাত্র থাকে না।”
এর পর করসংগ্রহকদের নিয়ে নিষ্ঠুর রঙ্গরসিকতা। “এইসময় ট্যাক্সেরা কহিল, যত রোগবালাই মর্তে যাচ্ছে, চল আমরা এই সময় যাইয়া লোকগুলোকে চেপে চুপে ধরিগে যাই, তা হলে পরণের কাপড় ফেলে পালাবে।
কাম কহিল, আমি আর সম্পর্ক বিচার করিতে দিব না।
ক্রোধ কহিল, আমি পিতৃমাতৃ ও স্ত্রী হত্যা পর্যন্ত ঘটাইব। তাহা হইলে দেবগণের ক্রোধ আরও বৃদ্ধি হইবে।
বিদ্যা কহিলেন, আমি অদ্য হইতে অবিদ্যারূপে দেখা দিব।
বুদ্ধি কহিলেন, আমি আর সুবুদ্ধিরূপে থাকিব না।
লক্ষ্মী কহিলেন, আমার অলক্ষ্মীই এখন বাড়তে থাকবে।
সরস্বতী কহিলেন, আমার দুষ্ট মূর্তিই সকলের স্কন্ধে চাপিবে।
ষষ্ঠী কহিলেন, আমি আর সহজে ধনী লোককে ছেলে দিব না।
...সাইক্লোন (মহাঝড়) কহিলেন, তোমরা সকলেই নিশ্চিন্ত থাক,আমি মধ্যে মধ্যে এক এক প্রদেশে দেখা দিয়া চালচাপা, দেওয়ালচাপা ও নৌকাডুবি করিয়া লক্ষ লক্ষ প্রাণীকে চালান দিব।
দুর্ভিক্ষ কহিল, বেশ বেশ— আমিও তোমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইয়া উপস্থিত হইব।
শিব কহিলেন, এখন হইতে আমি এমন নূতন নূতন রোগের সৃষ্টি করিব, যাহার নাম বা ঔষধ কবিরাজরা খুঁজিয়া পাইবেন না।
ইন্দ্র প্রশ্ন করলেন, পিতামহ! এত লোক আসবে কিসে?
পিতামহ ব্যাখ্যা করলেন, রেলগাড়ী অথবা স্টীমার। রেলওয়ে ও স্টিমারে নিত্যই যেরূপ দুর্ঘটনা ঘটে— তাহাতে এক এক চালানে অনেকে আসিতে পারবে।
যমের বক্তব্য— আমি তবে নরক সাফ করিগে।
চিত্রগুপ্ত অমনি জানালেন, আমার কিন্তু কতকগুলি অ্যাসিস্টেন্ট চাই। এত হিসাব একা রাখিতে পারব না।”
বইয়ে নানা দুর্যোগে বিপর্যস্ত দেশের যে ছবিটি আঁকা হয়েছে তা এক কথায় তুলনাহীন এবং এখনও বারবার পাঠযোগ্য।
বইয়ের শেষে পিতামহের ঘোষণায় কি লেখকের ব্যাঙ্গোক্তি লুকিয়ে আছে? পিতামহ বলছেন, ইংরাজ রাজ্যের তুলনায় আমাদের স্বর্গরাজ্যও তুচ্ছ মনে হয়। এমনকি, দেবরাজও কোনো কোনো বিষয়ে ইংরাজরাজের অনুকরণ করিতে ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন। আশীর্বাদ করি— ইংরাজ রাজ্য চিরস্থায়ি হউক।
তখন নারায়ণ সভাপতিকে ধন্যবাদ দিবার প্রস্তাব কহিলেন এবং ইন্দ্র সেই প্রস্তাব সমর্থন করিলেন। হরি হরি শব্দে সভাভঙ্গ হইলেন— এই হল দেবগণের মর্ত্যে আগমনের শেষ লাইন।
ভাবতে আশ্চর্য লাগে এই বইয়ের প্রথম প্রকাশ কলকাতায় প্লেগের আক্রমণের আগে ১৮৮৬ সালে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের সময়। হিসেব করলে এখন (২০২০) থেকে ১৩৪ বছর আগে। দুর্গাচরণ রায় তখন ভাবতেও পারেননি শতাব্দীর দুর্গম দূরত্ব পেরিয়ে তাঁর মুজতবা আলীসুলভ ব্যাঙ্গোক্তি করোনাকন্টকিত ভারতে আবার নতুন ভাবে পঠিত হবে।
আরও পড়ুন: লকডাউনে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছে দামোদর
দুর্গাচরণ রায় মহাশয়ের দেবগণের মর্ত্যে আগমন রসরসিকতায় ভরা। দেবদেবতা থেকে শুরু করে কলেরা বসন্ত, ইংরেজ ইন্ডিয়ান কাউকে নিয়ে মজা করতে ছাড়েননি। ভ্রমণকাহিনির আদর্শ লেখক তিনি, এঁকে ছাড়িয়ে যেতে স্মরণকালের মধ্যে কাউকে দেখিনি। মহামারির ইতিহাস খোঁজ করতে গিয়ে আরও কিছু উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না।
ইন্দ্র যখন উৎসাহ সহকারে বরুণের কাছে ইংরেজের বাষ্পীয় শকটের প্রশংসা করলেন তখন দুর্গাচরণের ব্যাখ্যা: ‘বাষ্পে চলে বলিয়া ইহার নাম বাষ্পীয় শকট হইয়াছে। কলটি বাষ্পের দ্বারা চলে বলিয়া অনেকে ইহাকে কলের গাড়ীও বলে।’
পিতামহ ব্রহ্মাকে কলকাতা ভ্রমণে নিয়ে যাওয়ার বিশেষ ইচ্ছা ইন্দ্রের। কিন্তু মৃত্যুহীন ব্রহ্মাকে নিয়েও অতুলনীয় রঙ্গ রসিকতা—“চল ব্রহ্মলোকে যাইয়া পিতামহকে সঙ্গে লইবার চেষ্টা করি। পিতামহের যেরূপ অবস্থা— আজকালের মধ্যে যদি ফুক করিয়া মারা যান, এত সুখের কলকাতা আর দেখিতে পাইবেন না। বড় আফশোস থাকিবে।” সব কথা ভেঙে না বলে, কৌশলে পিতামহকে নিয়ে যাবার চেষ্টা। “তাহা হইলে তিনি মর্ত্ত্যে যাইয়া হঠাৎ নিজ সৃষ্টির মধ্যে আশ্চর্য সৃষ্টি দেখিয়া চমৎকৃত হইবেন।”
বরুণ ও ইন্দ্রকে দেখে পিতামহ জানতে চাইলেন— স্বর্গে আবার দৈত্যদের উপদ্রব আরম্ভ হয়নি তো? ইন্দ্র জানালেন, এবার উপদ্রব করবার উপক্রম ইংরেজ জাতির।
মলিন মুখে পিতামহ এবার ‘পুরাতন বস্ত্রে বাঁধা কতগুলি বেদ বাহির করিয়া চশমা চক্ষে দিয়া দেখিতে দেখিতে কহিলেন, না, ইহাদের হইতে দেবগণের কোন ভয় নাই। এই ইংরেজজাতির রাজ্যসময়ে মনসা, জগন্নাথ প্রভৃতি গ্রাম্য দেবগণ স্বর্গে চলিয়া আসিবেন। উৎসাহী ইন্দ্র আর একবার বললেন, আপনার একবার যাওয়া উচিত। ব্রহ্মার উত্তর: ‘কি করে ভাই যাই, জান তো আমার ঘুমেতেই মাথা খেয়েছে।’
মা মনসার ইংরেজ আমলে নয়া দাপটের ইঙ্গিতটি আমার ভীষণ ভাল লেগেছিল। মুজতবা আলী বেঁচে থাকলে একবার তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা যেত।
রসিক লেখক এর পর বৈকুণ্ঠের একটি দৃশ্য অঙ্কন করেছেন। দেবরাজ ও বরুণ ঠাকুরের সঙ্গে মর্ত্যযাত্রার খবর নিয়ে নারায়ণ এবার নারায়ণীকে জানালেন, “প্রিয়ে, আমাকে বিদায় দাও, মর্ত্যে যেতে হবে।” নারায়ণীর একটি প্রশ্নে নারায়ণ জানালেন, “কলকাতা দেখতে এবং কলের গাড়িতে চড়তে বড়ই সাধ হয়েছে। বেড়াতে যাবো।”
নারায়ণী আলুলায়িত কেশে কার্পেট বুনছিলেন, এবার বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘পাঁচজনেই তোমাকে খারাপ কল্লে।’ এর পরের ডায়লগ আরও কঠিন— “মর্ত্ত্যে যেতে, মর্ত্ত্যের নাম করতে তোমার ভয় হয় না? ভেবে দেখ, সত্য, ক্রেতা, দ্বাপর যুগে সেখানে গিয়ে কত ঢলাঢলি করেছ এবং আমাকে কত কষ্ট দিয়েছ।”
নারায়ণ: “কেবল তিন দিন— আমি প্রতিজ্ঞা করে যাচ্ছি, তিন দিনের মধ্যে ফিরে আসবো।”
নারায়ণী: “নাথ! আর কেন জ্বালাও? সেখানে গেলে তুমি যদি তিন দিন ছেড়ে তিন শত বৎসরের মধ্যে ফিরে এস— এক কলম আমি লিখে দিতে পারি।”
এর পরেই উনিশ শতকের কলকাতা নিয়ে রমণীদের আশঙ্কা সম্বন্ধে অবিস্মরণীয় বর্ণনা। ...সেখানে আরমানি বিবিকে পেলে, ‘আর কি আমায় মনে ধরবে?... তাদের সঙ্গে মিশে মদ, মুরগী, বিসকুট, পাঁউরুটি খেয়ে ইহকাল, পরকাল ও জাত খোয়াবে!... এমনও হতে পারে— ব্রাহ্মসমাজে নাম লিখিয়ে বিধবা বিয়ে করে বসবে।
এরপর নারায়ণীর চূড়ান্ত কথা—“নাথ! আমি তোমাকে প্রাণ থাকিতে বিদায় দেব না।”
আরও পড়ুন: আঙুলটা ধরেই রইল প্রজন্ম
কলকাতা দেখতে কৃতসংকল্প নারায়ণ “আর কোনো কথা না বলিয়া নিজ বস্ত্রাদি ও পাথেয় লইয়া বহির্ব্বাটীতে গমন করিলেন।”
স্বামীকে বিদায় দিতে গিয়ে নারায়ণী “কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “শেষ পৌষে বাড়ী হতে যাচ্চো— খুব সাবধানে থেকো, নতুন শহরে চর্ব্বি মিশান ঘিয়ে ভাজা ময়রার দোকানের জিনিস গুলো বেশী খেও না, পেটের অসুখ হবে।”
অসুখে বিসুখে ভরা কলকাতা ভ্রমণে দেবতাদের মানসিকতার ব্যাপারে কৈলাসের বর্ণনাও অসাধারণ। “অদ্য পৌষ মাসের সংক্রান্তি, পার্ব্বতী পিঠেপুলি প্রস্তুত করিতেছেন; আর দেবাদিদেব মহাদেব নিকটে বসিয়া কার্ত্তিককে গালি দিতেছেন।”
নারায়ণ সবিনয়ে শিবকে জানালেন, “আমারা কলিকাতা দর্শন করিতে যাব, সেইজন্য বড়দাদা আপনাকে ডাকিতে পাঠাইয়াছেন।”
এখানে ‘বড়দাদা’ কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ— ব্রহ্মার প্রতি ইঙ্গিত।
শিব বললেন, “ভাই, এ অপেক্ষা আর সুখের বিষয় কি আছে; তবে বাড়ী ফেলে আমার একদণ্ড কোন স্থানে যাবার যো নাই। আমি গেলে বিষয়কর্ম্ম দেখে, এমন লোক একটীও নাই।”
নরগণের শিবনিন্দার খবর আমরা শুনেছি, কিন্তু শিবের সন্তাননিন্দার খবর এই প্রথম পেলাম। নারায়ণের মুখে কার্তিক-গণেশের উল্লেখ শুনে শিব বেজায় তেতে উঠে বললেন, “দুটো ছেলের একটাও মানুষের মত হ’ল না! কার্ত্তিকেটা তো ঘোর ইয়ার হয়ে উঠেছে, রাত দিন কেবল আয়না ব্রূস নিয়েই আছে... বেটা কানাপেড়ে সিমলার ধুতি না হ’লে পরেন না... আমি পয়সা বাঁচিয়ে বাঘছালে লজ্জা নিবারণ করে বেড়াই— বেটা আমার সিল্কের পাঞ্জাবী পোরে তেড়ী কেটে বাবু সেজে বেড়ান।”
দুর্গাচরণ রায়ের গণেশনিন্দাও অবিস্মরণীয়। ইন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন— গণেশটি কেমন?
বিরক্ত পিতার উত্তর— “দাদার ভাই। বেটা প্রত্যহ আদ মণ ক’রে সিদ্ধি খায়। দুঃখের কথা ব’লবো কি,— আজকাল আবার নাম হয়েছে সিদ্ধিদাতা গণেশ।”
নারায়ণের মন্তব্যও সময়োচিত। “বেশ হয়েছে,— যেমন বুড়ো বয়সে বে বে করে হেদিয়েছিলেন, তেমনি ফলভোগ করুন। বৌ আবার মধ্যে মধ্যে রাগ ক’রে ঐ ছেলেদের কোলে নিয়ে বাপের বাড়ী যান নয়?”
শিব যখন জানাচ্ছেন— ‘এখন আর সে রোগটা নাই।’ তখন নারায়ণের সময়োচিত ব্যখ্যা— “বুড় বয়সে বাপের বাড়ী গেলে বাপে জায়গা দেবে কেন? আর ক্রমে ক্রমে যে রকম মাগ্যিগণ্ডার দিন হ’য়ে উঠছে।”
আমরা জানছি, উনিশ শতকের রোগজর্জরিত কলকাতা দেখতে দেবগণ ১লা মাঘ হরিদ্বারে ল্যান্ড করলেন। দারুণ শীতে কাতর পিতামহের মন্তব্যটি স্মরণীয়— “ও বরুণ! এ কোথায় আনলি?
বরুণ যখন বললেন হরিদ্বার তখন বিরক্ত ব্রহ্মার তাৎক্ষণিক উত্তর— হরিদ্বার না যমের দ্বার!... আপাততঃ আমাকে আগুন করে সেক তাপ দিয়ে বাঁচাও।
(ছবি: তিয়াসা দাস)
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy