Advertisement
E-Paper

প্রাণে যেই অস্থিরতা আছে

সেই বিষয়ে অশোকবাবু বিলক্ষণ সচেতন ছিলেন। বহু লেখায় তিনি নিজেকে আঘাত করেছেন, নিজের মতের বা কাজের অসঙ্গতিগুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৮ ০১:০২
স্বতন্ত্র: বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানী, যন্ত্রকুশলী ও প্রযুক্তিবিদদের ডাকা এক সমাবেশে অশোক মিত্র। কলকাতা, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০০৩

স্বতন্ত্র: বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানী, যন্ত্রকুশলী ও প্রযুক্তিবিদদের ডাকা এক সমাবেশে অশোক মিত্র। কলকাতা, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০০৩

বছর চারেক আগে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ সঙ্কলনের মুখবন্ধে জানিয়েছিলেন, লেখাগুলিতে ‘সব মিলিয়ে হয়তো একটি অস্থির সময়ের আর্তনাদ আদৌ অস্পষ্ট নয়।’ ওই সঙ্কলনে নির্বাচিত প্রবন্ধগুলি মোটামুটি তার আগের এক দশকে লেখা। তার পর ভারতের ভাগ্যাকাশে নরেন্দ্র মোদীর আবির্ভাব। মোদীর রাজত্বে চার বছর কাটিয়ে চলে গেলেন অশোক মিত্র। ওই শেষ চার বছরেও, প্রায় অন্তিম মুহূর্ত অবধি, লেখা থামেনি, আর্তনাদ তীব্রতর হয়েছে। অন্যথা হওয়ার কোনও উপায় ছিল না। যা তিনি অন্যায় বলে মনে করতেন তাতেই প্রতিক্রিয়া জানানো তাঁর স্ব-ভাব, যে প্রতিক্রিয়ায় প্রখর ক্রোধের সঙ্গে মিশে থাকে গভীর বেদনা, যে রসায়ন থেকে উঠে আসে সুতীব্র আর্তি। আর চার পাশের জগৎ ও জীবনের ছত্রে ছত্রে যখন অন্যায়ের মিছিল, তখন প্রতিক্রিয়াও লাগাতার হবেই, আর্তনাদ বিরামহীন।

বেদনাতুর ক্রোধ এবং ক্রুদ্ধ বেদনার এই আর্তি আমাদের সজাগ রেখেছিল অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে। অশোক মিত্র ক্রমাগত লিখে গিয়েছেন, কাছের এবং দূরের ঘটনাপ্রবাহে সাড়া দিয়েছেন নিজের মতো করে, জানিয়েছেন নিজের মত, নিজের বিচার-বিশ্লেষণ, তর্ক তুলেছেন ক্রমাগত, তর্ক তুলেছেন নিজের সঙ্গেও। তাঁর অজস্র লেখায় বহু কথা বার বার ফিরে এসেছে, অনেক সময় একই ভাষায়, একই ভঙ্গিতে নিজেকে পুনরাবৃত্ত করেছেন তিনি। এক কথা বলতে বলতে সরে গিয়েছেন অন্য কথায়, অন্য পথে, কখনও হয়তো বা বিপরীত পথে। নিজেই জানিয়েছেন সেই পুনরুক্তির কথা, প্রতিসরণের কথাও। তা নিয়ে তাঁর কোনও সঙ্কোচ ছিল না। থাকার কারণও ছিল না— নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে চলা-ই সচল সজাগ মনের ধর্ম।

সেই বিষয়ে অশোকবাবু বিলক্ষণ সচেতন ছিলেন। বহু লেখায় তিনি নিজেকে আঘাত করেছেন, নিজের মতের বা কাজের অসঙ্গতিগুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। নিজের অবস্থান সম্পর্কে নির্মোহ ধারণা না থাকলে এটা করা কঠিন। সেই ধারণা তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন প্রায় চার দশক আগে, ক্যালকাটা ডায়রি-র পূর্বকথায়। প্রধানত ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি পত্রিকা’য় লেখা কলামের এই সঙ্কলনটি গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে, লন্ডনে। শ্রেষ্ঠাশ্রেষ্ঠবিনিশ্চয়ের অসার স্পর্ধা রাখি না, তবে এ বিষয়ে মনে কোনও সংশয় নেই যে, অশোক মিত্রের এই লেখাগুলি অ-তুলনীয়। এবং, মনে রাখতে হবে, এই কলাম তিনি লিখেছিলেন সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে, পশ্চিমবঙ্গ যখন বেলতলার মানুদার চারণভূমি, মারণভূমিও। পিশাচ-লীলায় অস্থির সময়ের আর্তনাদ সেই সপ্তাহলিপির ছত্রে ছত্রে। জরুরি অবস্থার ভারতে এ বই প্রকাশের উপায় ছিল না, তাই তার প্রথম ঠিকানা লন্ডন।

দু’বছর পরে, ১৯৭৯ সালে নতুন সংস্করণের প্রকাশ উপলক্ষে অশোকবাবু নিজের সম্বন্ধে কয়েকটি কথা লিখেছিলেন। তার মর্ম এই রকম: ‘‘এই লেখাগুলির লেখক কলকাতার কয়েদি: তাতে তার যতখানি গৌরব, হয়তো ততটাই ট্রাজেডি। তবে যে মানুষটা এক দিন এই নিবন্ধগুলি লিখেছিল তার পক্ষপাতিত্ব এবং বাতিকগুলো নিয়ে আজ সঙ্কোচ বোধ করার কোনও কারণ নেই। তার পক্ষপাত বাঙালি পক্ষপাত, তার বাতিকও স্থানীয় ভুবন থেকে সঞ্জাত। সে তার চার পাশের জনসমাজের অংশ; যে ক্লেদ কলকাতার চরিত্রলক্ষণ, তার দ্বারাই সে লালিত হয়েছে। তার আনুগত্যগুলি স্থানীয়, প্রাদেশিক, হয়তো বা গোষ্ঠীগত। একই সঙ্গে, চেতনার অন্য ধারাটিকেও সে অস্বীকার করতে পারে না, সেই চেতনাও তার মনোভূমিতে নিহিত— ভারতীয় জাতি নামক বিশাল, গোলমেলে, অস্পষ্ট বস্তুটির অঙ্গ হিসেবে নিজেকে চিনে নেওয়ার চেতনা। এই জাতিটি নানা বিভ্রান্তির এক সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা, কিন্তু সেই সব রকমারিকে ছাপিয়ে জেগে থাকে যে সত্য, তার মূলে আছে তীব্র সামাজিক দ্বন্দ্ব এবং উৎকট শ্রেণি-শোষণ।’’

এই আত্মবীক্ষার প্রতি পদে যে টানাপড়েন, যে অস্থিরতা, সেটাই অশোক মিত্রকে ক্রমাগত চালিয়ে নিয়ে গিয়েছে, জীবনের শেষ অবধি তার অবসান হয়নি। যা হওয়ার তা হবে— এই নিশ্চেষ্ট নিয়তিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ, নৈব নৈব চ। শেষের দিকে কেবলই বলতেন, ‘আর বাঁচার কোনও ইচ্ছে নেই’, কিন্তু সেটা শারীরিক বাঁচা, তার চেয়ে অনেক অনেক বড় যে বেঁচে থাকা, সেই চেতনার নাড়ি নিশ্চল হয়নি কখনও। আদিগন্ত অন্ধকার, চোখের সামনে পুরনো ইমারতগুলো ভেঙে পড়ছে, ‘বামফ্রন্ট আমাদের নয়নের মণি’ জপ করতে করতে এক সময় নিজের কাছেই স্বীকার করছেন ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা পণ্ডশ্রম, এই রাজ্যের— এবং দেশের— বৃহত্তম বামপন্থী দল গভীর অসুখে আক্রান্ত’, কিন্তু অতলান্ত আশাভঙ্গের যন্ত্রণাও অশোকবাবুকে শেষ অবধি শুভনাস্তিকের স্থবিরতা দিতে পারেনি। পার্টির সঙ্গে দূরত্ব উত্তরোত্তর বেড়েছে, বিশেষ করে বামফ্রন্ট জমানার শেষ পর্বে, তবু, সেই দূরত্বে দাঁড়িয়েই, পার্টিকে ‘সর্বনাশের গহ্বর থেকে ফিরিয়ে আনার’ দুর্মর প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছেন।

এবং পার্টির সর্বজ্ঞ নায়কদের কান কামড়ে একটা কথাই বলার চেষ্টা করেছেন: শৃণ্বন্তু। নানান লেখায়, সাক্ষাৎকারে বার বার বলেছেন তিনি— দলের অন্দরমহলে, বাহিরমহলে, বৃহত্তর সমাজেও বহু শুভার্থী মানুষ বহু বিষয়ে দলের নীতি ও কর্মপন্থা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছেন, সমালোচনা করছেন, নতুন পথে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন, দলনেতারা তাঁদের কথা শুনুন, ‘‘দল তো নেতাদের-মন্ত্রীদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়, যাঁরা তাঁদের সমর্থন দিয়ে, সাধনা দিয়ে, অধ্যবসায় দিয়ে, বহু প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে দলের পরিবৃত্তকে বিস্তৃততর, বলিষ্ঠতর করেছেন, তাঁরাও দলের অন্তর্ভুক্ত, দলের স্বত্বাধিকার তাঁরাও দাবি করতে পারেন।’’ জানতেন তিনি, ‘‘দলের পরিবৃত্তে এই কথাগুলি বলা হচ্ছে, কিন্তু শুনবেন কে? শোনবার প্রক্রিয়া তো বন্ধ।’’ ভ্যানগার্ড পার্টির কানে যেই বধিরতা আছে, তার নিরাময় হবে— সেই প্রত্যয় প্রবীণ মানুষটির মনে বিশেষ অবশিষ্ট ছিল না আর, থাকার কারণও রাখেননি প্রকাশ কারাটরা। তবু, হাল ছাড়া নয়, হাল ছাড়তে নেই কোনও দিন।

পার্টির নেতারা অশোক মিত্রকে সসম্মান শেষ বিদায় জানিয়েছেন। তাঁর শেষবেলাকার অস্থির আর্তনাদগুলিকেও শেষ বিদায় জানালেন কি?

Ashok Mitra Indian economist Marxist politician CPM laders
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy