Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
india

বন্ধুহীনতার নীতি

ছিটমহলের সন্তোষজনক সমাধান হইয়াছে; রেল-সড়ক-নদীপথে যোগাযোগ বাড়িয়াছে; পণ্য পরিবহণ বাড়িয়াছে; ভিসা-সংখ্যাও বাড়িয়াছে। ভারতের পক্ষে এই মৈত্রী অতি জরুরি, কারণ প্রতিবেশী দেশগুলিতে চিনের উপস্থিতি ও প্রভাব যে গতিতে বাড়িতেছে, তাহা ভারতকে স্বস্তি দিতে পারে না।

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২০ ০০:০৪
Share: Save:

কোনও প্রভাবশালী নেতার আঞ্চলিক রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করিতে গিয়া যদি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহিত ঘনিষ্ঠ ও গঠনমূলক সহযোগিতার কূটনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট হইয়া যায়, তবে তাহা গভীর লজ্জার বিষয়। কথাটি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বাংলাদেশ বিষয়ক কটূক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বলিয়াছেন শিবশঙ্কর মেনন। মেনন দেশের ভূতপূর্ব বিদেশসচিব ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা— তাঁহার পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বস্তুত, তিনি যে ব্যাধিটিকে চিহ্নিত করিয়াছেন, এই মুহূর্তে বিজেপির রাজনীতির তাহাই সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকারক দিক— আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির লাভের হাড়িকাঠে চড়ানো। এই ‘রাজনৈতিক’ কূটনীতি ভারতের মঙ্গল করিতেছে না— দক্ষিণ এশিয়ায় দিল্লি ক্রমেই বন্ধুহীন হইয়াছে। ব্যতিক্রম ছিল বাংলাদেশ, যাহার সহিত সম্পর্ক উন্নয়নে নরেন্দ্র মোদীর প্রথম দফার শাসনকালের ভূমিকাও কম নহে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করিয়াছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আসিয়াছেন। ছিটমহলের সন্তোষজনক সমাধান হইয়াছে; রেল-সড়ক-নদীপথে যোগাযোগ বাড়িয়াছে; পণ্য পরিবহণ বাড়িয়াছে; ভিসা-সংখ্যাও বাড়িয়াছে। ভারতের পক্ষে এই মৈত্রী অতি জরুরি, কারণ প্রতিবেশী দেশগুলিতে চিনের উপস্থিতি ও প্রভাব যে গতিতে বাড়িতেছে, তাহা ভারতকে স্বস্তি দিতে পারে না।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ-বর্ষণ উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের অন্যতম প্রধান অস্ত্র। ভৌগোলিক গণ্ডি অতিক্রম করিয়া অমিত শাহ কেন বাংলাদেশকে সেই বিদ্বেষের নিশানা করিলেন, তাহা অনুমান করা কঠিন নহে। তাঁহার নিকট ধর্মীয় পরিচিতির বাড়া আর কোনও পরিচিতি নাই, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের আগামী বিধানসভা নির্বাচনে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষের পালে আরও হাওয়া টানিতে তিনি বাংলাদেশকে জড়াইয়া ধর্ম-রাজনীতি ঘোলা করিতে চাহেন। এই দিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর এই সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত আক্রমণের প্রতিক্রিয়া কী হইতে পারে, শ্রীশাহ তাহা ভাবিতেছেন না। দুর্ভাগ্যজনক। বিপজ্জনকও বটে। দেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব মনে রাখিয়া কী ভাবে বাংলাদেশের সহিত সম্পর্কের ক্ষতের শুশ্রূষা সম্ভব, কেন্দ্রীয় সরকার তাহা অবিলম্বে ভাবুক। ঘটনা হইল, কাঠমান্ডু বা কলম্বোর তুলনায় ঢাকার সহিত দিল্লির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর, সম্পর্কের উন্নতিসাধনের সম্ভাবনাও অধিকতর। বহুবিধ কারণে বাংলাদেশও ভারতকে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বাড়তি গুরুত্ব দিয়া থাকে। কিন্তু, তাহার অর্থ ইহা নহে যে, ভারতের তরফে কোনও প্রচেষ্টা ব্যতিরেকেই সম্পর্কের ক্ষত শুকাইবে। ক্ষত নিরাময়ের প্রক্রিয়া দ্রুত, অতি দ্রুত শুরু করা চাই।

বাস্তবিক, কূটনীতির দুনিয়ায় স্থায়ী একমাত্র দেশের নিজস্ব স্বার্থ— সেই স্বার্থরক্ষায় বন্ধু ও শত্রু সমানেই পাল্টাইয়া যাইতে পারে। সম্প্রতি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদের টেলি-বৈঠক, কিংবা চিনের সহিত বাংলাদেশের আদানপ্রদানকে এই দৃষ্টিকোণেই দেখিতে হইবে। অমিত শাহ যাহাই ভাবুন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ঐতিহাসিক কারণেই স্বাভাবিক মিত্র নহে। তাহা সত্ত্বেও অতীতের বোঝা পিছনে ফেলিয়া বাংলাদেশ নূতন কূটনৈতিক সম্পর্ক রচনা করিতেছে— ভারতের নিকট ইহা শিক্ষণীয়, নিন্দনীয় নহে। চিন যে ভাবে কাঞ্চনমূল্যে আনুগত্য কিনিতেছে, অর্থনৈতিক কারণেই ভারতের পক্ষে তাহা অসম্ভব। ফলে, প্রতিবেশী অঞ্চলে চিনের স্বার্থগন্ধময় উপস্থিতি ও অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিহত করিতে চাহিলে, আঞ্চলিক মহাশক্তি হিসাবে নিজের প্রতিষ্ঠা চাহিলে ভারতের নিকট একমাত্র পথ— প্রতিবেশীর সহিত কূটনৈতিক সুসম্পর্ক। অতীত ভুলিয়া, ঘরোয়া রাজনীতি ভুলিয়া, অর্থনৈতিক আয়তনের অহঙ্কার ভুলিয়া সেই পথে হাঁটা ব্যতীত গতি নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

India Bangladesh China International Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE