Advertisement
E-Paper

তুমি গ্ল্যাডিয়েটর! তুমি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারো না

যাঁর একটা টুথব্রাশ হাতে তোলারও ক্ষমতা ছিল না, তিনি যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন, তা-ই নয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছেন। আইপিএলের ধকল নিচ্ছেন। দেশের সহ-অধিনায়ক হয়েছেন। সেঞ্চুরি করে শূন্যে সামারসল্ট দিয়ে উদ্‌যাপন করছেন! ইনি গ্ল্যাডিয়েটর নন তো কে?

অনিন্দ্য জানা

অনিন্দ্য জানা

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৫ ১৪:২২
Batting of injured Rishabh Pant like a gladiator in the arena of England

বুধবার চোট পেয়ে মাঠ ছাড়ার সময় পন্থ। সঙ্গে বৃহস্পতিবার তাঁকে নিয়েই করা বিসিসিআইয়ের পোস্ট। ছবি: সংগৃহীত।

ওল্ড ট্রাফোর্ডের ড্রেসিং রুমের সিঁড়ি বেয়ে ধীর পায়ে নেমে আসছিল চেহারাটা। টকাটক সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা নয়। এক-পা এক-পা করে নামা। প্রথমে বাঁ পা সিঁড়ির ধাপে। তার পরে সেই পায়ের পাশে সাবধানে স্থাপন করা ডান পায়ের পাতা। ব্যাটটা বাঁ হাতে আলগোছে ধরা। ডান হাত আঁকড়ে আছে সিঁড়ির রেলিং। শরীরের ডান দিকের ভর ওই হাতের উপর। যেন ডান পায়ে অনর্থক চাপ না পড়ে।

প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে যন্ত্রণায় মুখের পেশি কুঁচকে যাচ্ছিল। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছোনোর পর ডান হাতের সহায়ক রেলিংটাও ছেড়ে গেল তাঁকে। ধীরে, খুব ধীরে বাউন্ডারির দড়ির দিকে এগোলেন তিনি।

ততক্ষণে আউট হয়েও প্রায় এক মিনিট মাঠের মধ্যে অপেক্ষা করছেন শার্দূল ঠাকুর। যাতে পরের ব্যাটারের মাঠে ঢোকার সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার টাইমিংটা সেট করে নেওয়া যায়। যাতে পরের যোদ্ধা মাঠে ঢোকার সময়টায় তিনি সর্বসমক্ষে তাঁর পিঠটা চাপড়ে দিতে পারেন। কারণ, শার্দূল ঠাকুর বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন, আসল ‘শার্দূল’ ওই নেমে আসছে ড্রেসিংরুমের সিঁড়ি বেয়ে।

বাঘের মতো খানিকটা গুঁড়ি মেরে তিনি যখন খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাউন্ডারির দড়ি টপকাচ্ছেন, প্রস্থানোদ্যত শার্দূল ডান হাতের গ্লাভসটা খুলে তাঁর শিরস্ত্রাণ পরিহিত মাথায় হাত রাখলেন। মনে হল, সারা ভারতবর্ষই বুঝি বা মাথায় হাত রাখল আহত যোদ্ধার। অকালবৃষ্টির মতো ঝরে পড়ল শুভেচ্ছাবারি।

নিচু হয়ে মাঠের মাটিকে প্রণাম করে গণ্ডি অতিক্রম করে এগোলেন তিনি। গ্যালারি এবং ক্রিকেটবিশ্ব বিস্ফারিত, বিমোহিত, বিমুগ্ধ। গোটা মাঠ দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। সেই শব্দব্রহ্ম হেডফোনের ‘নয়েজ় ক্যানসেলেশন’-এর লক্ষ্মণরেখা ভেদ করে পৌঁছে যাচ্ছে শব্দনিরোধক কাচঘেরা কমেন্ট্রি বক্সে বসে থাকা ধারাভাষ্যকারদের কানে। তাঁদের কণ্ঠে আকণ্ঠ বিস্ময়। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, ওল্ড ট্রাফোর্ডের গ্যালারি ভারতের সমর্থক নয়। ওল্ড ট্রাফোর্ডের গ্যালারি ইংল্যান্ডেরও সমর্থক নয়। ওল্ড ট্রাফোর্ডের গ্যালারি তখন শুধুমাত্র ওই সাতাশের যুবকের একাগ্র সমর্থক। যে সমর্থন দেশ, জাতি বা গোষ্ঠী কাঁটাতারে আবদ্ধ থাকে না। কারণ, বীরত্ব কখনও ভূগোলের দাসত্ব করে না। দেশকাল নির্বিশেষে বীরের সামনে সকলে নতজানু, নতশির হয়।

অ্যাম্ফিথিয়েটারের ঠিক মধ্যিখানে অস্ত্র-হাতে দাঁড়ানো এক গ্ল্যাডিয়েটরের মতো লাগছিল তাঁকে। ঋষভ পন্থকে।

দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আগের দিন এই সময় নাগাদ তাঁকে মেডিক্যাল কার্টে চাপিয়ে মাঠ থেকে বার করে নিয়ে যেতে হয়েছিল। চোট এতটাই গুরুতর যে, সাপোর্ট স্টাফদের কাঁধে ভর দিয়েও ডান পা ফেলতে পারছিলেন না। মোজা খোলার পরে টিভি ক্যামেরায় যা ধরা পড়ল, ডান পায়ের পাতার বাইরের দিকে একটা আমলকির সাইজ়ের ফোলা। ছিটে ছিটে রক্তও যেন। দেখে মনে হচ্ছিল, ঠিকই। এ তো জুতো গলাতে গেলেও প্রাণান্তকর যন্ত্রণা হবে। মেডিক্যাল কার্টে বসে তিনি যখন বেরোচ্ছেন, তখন তাঁর মুখে যন্ত্রণা আর হতাশা মিলেমিশে একাকার।

দ্রুত ক্রিকেটবিশ্বে খবর ছড়িয়ে পড়ল, ‘ঋষভ পন্থ রিটায়ার্ড হার্ট। ঋষভ পন্থ আহত অবসৃত’। শোনা গেল, চোটের জায়গায় স্ক্যান করানোর জন্য তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনিশ্চয়তা তখন থেকেই তৈরি হয়েছিল। ওল্ড ট্রাফোর্ডের মাঠে ঋষভ পন্থের ফিরে আসার অনিশ্চয়তা।

রাত পোহাতে খবর ছড়াল, ছ’সপ্তাহের মতো মাঠের বাইরে ঋষভ। কেউ বললেন, ডান পায়ের পাতার হাড় ভেঙেছে। কেউ বললেন, ডান পায়ের বুড়ো আঙুল ভেঙেছে। আহত হওয়ার রিপ্লে বারবার দেখেও অবশ্য বোঝা যায়নি কী করে বুড়ো আঙুল ভাঙতে পারে। রিভার্স সুইপ মারতে গিয়েছিলেন। ডেলিভারিটা সামনে ভাঁজ-করা ডান পায়ের পাতার বাইরের দিকে গিয়ে আছড়ে পড়েছিল। বুটের এমন একটা জায়গায়, যেখানে কোনও আলাদা বা অতিরিক্ত সুরক্ষা থাকে না। মোজা খোলার পরেও ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে চোট বলে মনে হয়নি। কিন্তু সেই বিভ্রান্তি দূরে সরিয়ে রাখলেও এটা নিয়ে কারও মনে কোনও সংশয় ছিল না যে, ইংল্যান্ড সিরিজ় থেকেই ছিটকে যেতে চলেছেন তিনি। ওল্ড ট্রাফোর্ডে আবার মাঠে নামার সম্ভাবনা তো দূর অস্ত!

তবে পায়ের হাড় ভাঙলেও মাঠে ফিরে ব্যাট করতে পারেন, এমন একটা সম্ভাবনার কথা বিসিসিআই টুইট করে জানিয়েছিল বটে। বলেছিল, আহত ঋষভ পন্থের জায়গায় এই টেস্টে ধ্রুব জুরেল কিপিং করবেন। কিন্তু ঋষভ দলের সঙ্গেই আছেন। দলের প্রয়োজন পড়লে ব্যাট করবেন। সেটা সকলে ‘সম্ভাবনা’ হিসাবেই দেখেছিলেন। বাস্তব নয়। কিন্তু ঋষভ পন্থ হলেন আধুনিক ক্রিকেট মহাকাব্যের নায়ক। শুধু নায়ক নন, লেখকও। নিজের মহাকাব্য নিজেই রচনা করেন তিনি। ৩৭ রানে আহত হয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন। সেই অবস্থাতেই পরদিন আবার অস্ত্র-হাতে ময়দানে নেমে পড়তে হল। দলের প্রয়োজন। দেশের প্রয়োজন।

অভিভূত দীনেশ কার্তিক বলছিলেন, ‘‘আই অ্যাম অ্যাস্টাউন্ডেড দ্যাট হি ইজ় আউট দেয়ার!’’ ক্রিস ব্রড বলছিলেন, ‘‘উই জাস্ট ডোন্ট নো হোয়াট্‌স কামিং!’’ মেল জোন্স বলছিলেন, ‘‘ব্যাটার্ড, ব্রুইসড। বাট স্টিল স্ট্যান্ডিং!’’

ঠিকই। আগের দিন যাঁর দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছিল, তিনি যন্ত্রণা সহ্য করেও সটান দাঁড়িয়ে আছেন। উন্নতশির। কমেন্ট্রি বক্সে অতীতের ভারতীয় ক্রিকেটারদের নজির তুলে এনে তুলনামূলক বীরত্বের আলোচনা শুরু হয়েছে। ‘স্টুপিড-স্টুপিড-স্টুপিড’ এবং ‘সুপার্ব-সুপার্ব-সুপার্ব’ খ্যাত সুনীল গাওস্কর বলছেন নরি কন্ট্রাক্টর, বিজয় মার্চেন্ট, কপিল দেবের কথা। পায়ের ছিঁড়ে-যাওয়া পেশি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে কপিলের পাঁচ উইকেট নেওয়ার কাহিনি। কেউ বলছেন ২০০২ সালে অ্যান্টিগায় ভাঙা চোয়াল তার দিয়ে জুড়ে তার উপর ব্যান্ডেজ জড়িয়ে অনিল কুম্বলের বীরত্বের কথা। আরও আরও অনেকে, গ্রেম স্মিথ থেকে নাথান লায়ন। চোট নিয়েও ক্রিকেটমাঠে যাঁদের লড়াই লোকগাথায় ঢুকে গিয়েছে।

কিন্তু কী জানেন? কারও বীরত্বকে খাটো না-করেই বলি, এঁদের কারও জীবনে গাড়ি দুর্ঘটনার পরে বেঁচে উঠে শরীরের দুশোর বেশি সেলাই নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে আসার পটভূমিকা ছিল না। এঁদের কেউ ক্রিকেট খেলতে খেলতে মৃত্যুর চৌকাঠে পৌঁছে গিয়ে আবার ফিরে আসেননি। যাঁকে চার জন মিলে তুলে ধরে দাঁড় করাতে হত, যাঁর একটা টুথব্রাশ হাতে তোলারও ক্ষমতা ছিল না, তিনি যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন, তা-ই নয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছেন। আইপিএলের ধকল নিচ্ছেন। দেশের সহ-অধিনায়ক হয়েছেন। ইংল্যান্ডের মাঠে সেঞ্চুরি করে শূন্যে সামারসল্ট দিয়ে সেই সাফল্য উদ্‌যাপন করছেন!

ইনি গ্ল্যাডিয়েটর নন তো কে?

সত্যি বলতে, ভেবেছিলাম, মাঠে নেমেছেন বটে। ধুমধাড়াক্কা চালিয়ে কিছু রান-টান তুলে নিয়মরক্ষা করে চলে আসবেন। কোথায় কী! খোঁড়াতে খোঁড়াতে সিঙ্গল্‌সও নিতে লাগলেন ঋষভ। ক্রিকেট-ধুরন্ধর বেন স্টোক্‌স চোট-জর্জরিত ডান পা লক্ষ্য করে পর পর বল করছেন। নিঁখুত নিশানায় প্যাডে আছড়ে পড়ছে একের পর এক এক্সপ্রেস ডেলিভারি। স্বাভাবিক। ইংল্যান্ড অধিনায়ক জানেন, এখনও জায়গাটা তপতপে হয়ে রয়েছে। এক বার ঠিকঠাক লাগলে ভয় খাওয়ানো যাবে। আর জায়গামতো না-লাগাতে পারলেও ডান পা আড়াল করে করে খেলতে হবে ঋষভকে। তাতে স্ট্রোকে প্রার্থিত ওজন যাবে না। অর্থাৎ, ঋষভের স্বাভাবিক স্ট্রোক প্লে আটকে তাঁকে দৌড়ে খুচরো রান নিতে বাধ্য করতে হবে। যাতে চোটের জায়গায় আরও চাপ পড়ে।

কিন্তু ওই যে, নিজের মহাকাব্য যিনি নিজেই লেখেন, তাঁকে থামানো যাবে কী করে? তাঁর কলম তো তাঁরই হাতে। ভাঙা পায়ে ওজন ট্রান্সফার না করে কার্যত বাঁ পায়ে ভর করে স্ট্রোক নিতে শুরু করলেন ঋষভ। জফ্রা আর্চারের স্লোয়ার শর্ট পিচ্‌ড ডেলিভারি উড়িয়ে দিলেন মিড উইকেটে, ডান পা-কে বাঁ পায়ের আড়ালে রেখে প্যাডের গোড়া থেকে ফ্লিক করলেন। মাঝখানে যখন এক বার বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হয়ে গেল, দেখলাম কষ্ট করে ড্রেসিংরুমের সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন। তাঁকে আগলে আগলে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন আকাশ দীপ। পিছনে আরও দু’-তিন জন সতীর্থ। যদি টাল সামলাতে না পারেন? যদি সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে পা ফস্কে যায়? এক ভাষ্যকার আশ্চর্য হয়ে বলছিলেন, ঋষভ সিঁড়ি ভেঙে ড্রেসিং রুমে যাচ্ছে কেন? বৃষ্টি একটু পরেই থেমে যাবে। মাঠের পাশে ডাগ আউটেই তো বসতে পারত!

কে জানে, হয়তো ওই সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে পায়ের নড়াচড়ায় তিনি আরও একটু সড়গড় করছিলেন নিজেকে। হয়তো যন্ত্রণা সহ্য করার সীমারেখাটা টেনেটুনে আরও একটু বাড়িয়ে নিচ্ছিলেন।

এ-ও এক ঘটনাচক্রই যে, স্টোক্‌সকেই কভার-মিড উইকেট দিয়ে বাউন্ডারি মেরে ৫০ পেরোলেন ঋষভ। যখন ব্যাট তুলছেন, তখনও যন্ত্রণার অভিঘাতে তাঁর মুখ বেঁকেচুরে যাচ্ছে। কমেন্ট্রি বক্স ডবল উচ্ছ্বসিত। রিকি পন্টিং বলছেন, ‘‘কে বলল, ব্যাট করতে পায়ের পাতার দরকার হয়!’’ মাইকেল আর্থারটন বলছেন, ‘‘দ্য মোস্ট রিমার্কেব্‌ল ফিফটি, ইন দ্য সারকামস্টেন্সেস।’’

ব্যক্তিগত ৫৪ রানে (আগের দিনের ৩৭ রানের সঙ্গে আরও ১৭ জুড়ে) জফ্রা আর্চারের যে ডেলিভারিটা আহত ঋষভের স্টাম্প ছিটকে দিল, অনেক আচ্ছা আচ্ছা আর সুস্থ ব্যাটারও ঘোল খেয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু আমরা তার চেয়েও অনেক বেশি মনে রাখব ওই ১৭টা রান। রানের নিরিখে মূল্য কম। জীবনের নিরিখে অমূল্য!

যখন খোঁড়াতে খোঁড়াতে ড্রেসিং রুমের দিকে রওনা দিলেন, মনে হচ্ছিল, ম্যাঞ্চেস্টার টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে দরকার হলে নির্ঘাত আবার ব্যাট হাতে নেমে পড়বেন ঋষভ পন্থ। কারণ, তিনি গ্ল্যাডিয়েটর। গ্ল্যাডিয়েটরদের পালালে চলে না। তারা যুদ্ধ করে। শত্রু নিকেশ করে। তার পরে রক্ত মুছে, ক্ষতস্থান সেলাই করে বিক্ষত দেহে বর্ম এঁটে, মাথায় শিরস্ত্রাণ চাপিয়ে আবার পরের লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়।

গ্ল্যাডিয়েটরেরা পালায় না। ঋষভ পন্থ পালান না। ঋষভ পন্থ আসলে একজন গ্ল্যাডিয়েটর।

Rishabh Pant Indian cricketer India vs England 2025
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy