Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
স্বর্ণকুমারী দেবী, অবলা বসুরা নারীপ্রশ্নে আলাদা রকম ভাবতেন
Society

তাঁদের কুর্নিশ করি

১৯৩৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রোটারি ক্লাবে একটি বক্তৃতায় অবলা বলছেন, বর্তমানে বাংলায় প্রায় চার লাখ বিধবা যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০।

চিত্তবলধারিণী: স্বর্ণকুমারী দেবী ও অবলা বসু (ডান দিকে)

চিত্তবলধারিণী: স্বর্ণকুমারী দেবী ও অবলা বসু (ডান দিকে)

অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:১৯
Share: Save:

কয়েক দিন আগে, ২৮ অগস্ট চলে গেল এক অসামান্য নারী স্বর্ণকুমারী দেবীর জন্মদিন। ওই যুগের আর এক জন স্মরণীয়া অবলা বসু জন্মেছিলেন ৮ অগস্ট। সাম্প্রতিক কালে রাজা রামমোহনের সার্ধদ্বিশতবর্ষ, বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে আবেগঘন, মননশীল শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জোয়ার দেখলাম, কিন্তু এঁদের কথা আমরা সে ভাবে মনে করলাম না। অথচ ঔপনিবেশিক বাংলার সমাজে নারীবিষয়ক প্রশ্নের উত্তর এঁরা পুরুষদের থেকে ভিন্ন ভাবে খুঁজেছিলেন। বিশেষত বিধবাদের সম্বন্ধে তাদের ভাবনা, বা বলা ভাল, বৈধব্যসমস্যার উত্তর এঁদের কাছে ভিন্ন রকম ছিল। উচ্চারিত হয়েছিল বিকল্প এক সমাধানসূত্র— যা নারীর দেহের থেকেও মন, মনন, স্বাবলম্বন ও আত্মসম্মানকে বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছিল।

সতীদাহ প্রথা বিলোপসাধনে রামমোহন রায়ের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। তিনি সতীদাহকে ‘বিধবাদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা’র প্রথা হিসেবে পুনঃ-সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, এবং ব্রিটিশরাও এই সংজ্ঞাকে গ্রহণ করেছিলেন তাদের আইনের বয়ানে। তবে রামমোহনের কাছে বিধবাদের জন্য মৃত্যুর বিকল্প ছিল কামনাবাসনাবর্জিত মৃতবৎ এক জীবন। তিনি শাস্ত্র উদ্ধৃত করে দেখিয়েছিলেন, ব্রহ্মচর্য পালনেই বৈধব্যের সার্থকতা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাদের, বিশেষত বালবিধবাদের যৌনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং এই যৌনতাকে বৈধ খাতে বইয়ে দেওয়ার জন্য তিনি পুনর্বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন কী ভাবে বিধবাদের জন্য না ভাবার কারণে সমাজ ব্যভিচার, ভ্রূণহত্যা ও বেশ্যাবৃত্তির পাপে নিমজ্জিত। সেই পাপ থেকে সমাজকে উদ্ধার করার একমাত্র পথ হল, পুনর্বিবাহের বৈধকরণ। বিধবাদের অস্তিত্বের পরনির্ভরতা যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, দ্বিতীয় বার বিয়ে হলেও যে তারা আবার বৈধব্য এবং অস্তিত্বের নিদারুণ সঙ্কটে নিমজ্জিত হতে পারে, তা তাঁর ভাবনায় বোধ হয় তেমন গুরুত্ব পায়নি।

এ দিকে বিধবাদের অস্তিত্বের এই বিপন্নতা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন উনিশ শতকের কয়েক জন মননশীল নারী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর গল্প-উপন্যাসে বিধবাচরিত্র বার বার এসেছে, তবে বিধবার প্রেম শেষ অবধি বিবাহে পরিণতি পায়নি তাঁর লেখা কোনও উপন্যাস বা ছোটগল্পে। ‘স্নেহলতা বা পালিতা’ উপন্যাসের বিধবা নায়িকা স্নেহলতা আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বিধবাবিবাহ বৈধকরণের পর অনেক দশক পেরিয়ে গেলেও ‘অমরগুচ্ছ’ গল্পের নয়নতারা দাদার বন্ধু মি চ্যাটার্জির প্রতি তার আকর্ষণকে পাপ হিসেবে চিহ্নিত করে অপরাধবোধে দীর্ণ হয়। পরলোকগত ‘পতিদেবতার’ প্রতি ভক্তিতেই জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায় সে। বিধবার প্রেমের সার্থক পরিণতি দেখাতে স্বর্ণকুমারী দেবী স্পষ্টতই কুণ্ঠিত। ক্রমশ তাঁর কাছে বিধবার প্রেম ও পুনর্বিবাহের চাইতেও যেটা বেশি জরুরি মনে হয়, সেটা হল নারীর স্বাবলম্বন, মাথা উঁচু করে বাঁচার সুযোগ। ১৮৯৬ সালে স্বর্ণকুমারী সখী সমিতি স্থাপন করেন। এই সমিতির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অসহায় বিধবাদের শিক্ষিত করে স্বনির্ভর করে তোলা। বিশেষত, অন্তঃপুর শিক্ষয়িত্রী হিসেবে তাদের নিযুক্ত করা। ‘আরেকটি প্রস্তাব’ প্রবন্ধে তিনি লেখেন, “বিধবা যদি রীতিমতো শিক্ষালাভ করে অন্তঃপুরে স্ত্রীলোক ও বালকদিগের শিক্ষাদান করে ও অন্যান্য দেশহিতকর কর্মে নিযুক্ত থাকে তাহলে তারা নিজেদের অন্ন জোগাড় করে নিতে পারবে, লাঞ্ছনা গঞ্জনার থেকে মুক্তি পাবে।” তিনি এ কথাও বলেন, যে সব বিধবা চায় তারা পুনর্বিবাহ করতে পারে, কিন্তু “যারা হিন্দু শাস্ত্রানুযায়ী ধর্মাচরণে বৈধব্যকাল অতিবাহিত করতে চায় তারা দেশহিতকর কার্য্যে জীবন অতিবাহিত করবে।” অর্থাৎ, স্বর্ণকুমারীর কাছে পুনর্বিবাহ ঐচ্ছিক, সসম্মানে বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য নয়। অপরিহার্য হল শিক্ষা ও স্বাবলম্বন।

মেয়েদের মন আছে, বুদ্ধি আছে— এই বিশ্বাস স্বর্ণকুমারী বিভিন্ন প্রবন্ধে তেজোদীপ্ত কণ্ঠে ব্যক্ত করেছেন। ‘পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রবন্ধে তিনি স্বীকার করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বুদ্ধি, শিক্ষা, জ্ঞানের দিক দিয়ে নারী পুরুষের থেকে পিছিয়ে। যুগ যুগ ধরে নারী শিক্ষাবঞ্চিত হয়েছে, অনিবার্য ভাবেই তার মেধা, মননের বিকাশ ঘটেনি। কিন্তু মেয়েদের যদি পুরুষের সমান শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়, তার পরেও যদি তাদের বৌদ্ধিক, এবং মেধাগত উৎকর্ষের খামতি থাকে শুধু তখনই তিনি বিশ্বাস করবেন নারী পুরুষের থেকে প্রকৃতিগত ভাবে নিকৃষ্ট। তাঁর চোখে নারীর মননশীল বিকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা অফুরান।

অবলা বসু সম্বন্ধে তাঁর সমকালে এবং বর্তমান সময়েও যে সামান্য আলোকপাত হয়েছে তাতে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর সুযোগ্য পত্নী হিসেবেই তিনি প্রধানত উপস্থাপিত হন। প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে থাকে এক জন নারী— বহুব্যবহারে জীর্ণ হয়ে যাওয়া এই ‘স্টিরিয়োটাইপ’টি যেন তাঁর ক্ষেত্রে ষোলো আনা প্রযোজ্য। ওঁর নিজস্ব অবদান বা কৃতিত্ব যেন তাঁর প্রখর প্রতিভাসম্পন্ন স্বামীর পাশে গুরুত্বের সঙ্গে চর্চার বিষয়ই হতে পারে না। আপাতদৃষ্টিতে অবলা বসুও তাঁর বিশ্ববিখ্যাত স্বামীর সুযোগ্য পত্নী হয়ে ওঠাকে জীবনের ব্রত মনে করেছিলেন। নিজে ডাক্তারি পড়া সম্পূর্ণ করেননি। অন্য কোনও জীবিকাও গ্রহণ করেননি। স্বামীর কাজকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তবে অনেকেই জানি না যে, অবলা মেয়েদের আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে একের পর এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ করেছেন। মেয়েদের, বিশেষত গ্রামবাংলার মেয়েদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারের জন্য ১৯১৯ সালে তিনি স্থাপন করলেন নারী শিক্ষা সমিতি। কিন্তু পড়াবে কারা? পড়াবে বিধবারা। আর বিধবাদের শিক্ষয়িত্রী হিসেবে প্রশিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন বিদ্যাসাগর বাণী ভবন। অসহায় বিধবা মেয়েরা শিক্ষালাভের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসী ও স্বনির্ভর হয়ে উঠবে, এবং গ্রামেগঞ্জে সুযোগবঞ্চিত মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে, এই ছিল অবলা বসুর স্বপ্ন। ১৯৩৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রোটারি ক্লাবে একটি বক্তৃতায় অবলা বলছেন, বর্তমানে বাংলায় প্রায় চার লাখ বিধবা যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০। এরা অসহায়, পরনির্ভরশীল। এদের স্বনির্ভর করার উদ্দেশ্যে, আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর বাণী ভবন নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছে। এই ভবন শুরু হয়েছিল দুই জন বিধবাকে নিয়ে। ১৯৩৪-এ এই ভবনের বাসিন্দা প্রায় ষাট জন বিধবা। এদের মধ্যে চল্লিশ জন শিক্ষয়িত্রী আর বাকিরা অন্যান্য পেশায় নিযুক্ত। অবলা বসুর স্বপ্ন সার্থক হয়েছে।

বোঝা যাচ্ছে, স্বর্ণকুমারী দেবী বা অবলা বসুর চোখে বিধবা নারী শুধুমাত্র স্খলনপ্রবণ কামনাজর্জর দেহ নয়। বিধবাদের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার পথ দেখাতে চেয়েছেন তাঁরা। পুনর্বিবাহ কোনও সমাধান নয়, জীবনধারণের জন্য অনিবার্যও নয়। অনিবার্য হল নিজের পেট নিজে ভরানো, সসম্মানে বাঁচা। এই ভাবে স্বর্ণকুমারী ও অবলা বিধবাদের বেঁচে থাকাকে অর্থবহ করে তুলতে চেয়েছিলেন। অপ্রতিরোধ্য সমাজবিনাশী এক তীব্র যৌনকামনার আধারের পরিবর্তে বিধবা নারীকে দেখেছিলেন তার মেধা, বুদ্ধিবৃত্তি অবলম্বন করে, কারও দয়ায় না বেঁচেও জীবনের পথে দিব্যি এগিয়ে যেতে পারার মতো সম্পূর্ণ মানুষ হিসাবে। উপরন্তু, শিক্ষাবঞ্চিত গ্রাম-গঞ্জের মেয়েদের এগিয়ে যেতে আলাদা ভাবে সাহায্য করার কথাও তাঁরা ভেবেছিলেন। তাঁদের মনে হয়েছিল, এ ভাবেই এক উন্নততর সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারে। স্বর্ণকুমারী ও অবলার জন্মদিন উপলক্ষে তাঁদের ভাবনাকে কুর্নিশ করি।

ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Society Women Widow
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE