এক জনের হাতে বিজেপির ঝান্ডা। গলা ফাটিয়ে ‘জয় শ্রী রাম’ বলে চিৎকার করছেন। অন্য জনের হাতে তৃণমূলের পতাকা। ‘জয় জগন্নাথ’ বলে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন। রাস্তার দু’দিকে দু’জন দাঁড়িয়ে। ক্রমশ গলার স্বর চড়ছে। ‘জয় শ্রী রাম’ রণহুঙ্কারের মতো শোনাচ্ছে। ‘জয় জগন্নাথ’ প্রায় শাসানিতে পরিণত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির এই টুকরো দৃশ্য এখন দেশ জুড়ে ‘ভাইরাল’। হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতার এমন আদর্শ উদাহরণ আর হয় না।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী কালীগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনের পরে বলেই দিয়েছেন, ওই কেন্দ্রের মুসলিম অধ্যুষিত সিংহভাগ বুথে বিজেপি পঞ্চাশটি ভোটও পায়নি। কিন্তু ভোটে হেরে গেলেও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বুথের প্রায় সবগুলিতেই বিজেপি এগিয়ে। হিন্দু ভোটারদের এই ঐক্যই রাজ্যে ‘হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি’-র ধ্বজা ওড়াতে পারে বলে তাঁর মত। সহজ কথায়, হিন্দু ভোট এককাট্টা করেই আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির জয়ের স্বপ্ন দেখছেন শুভেন্দুবাবুরা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পুরনো অনুগামী, অধুনা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর এই হিসাব ঘেঁটে দিতেই পাল্টা হিন্দু ভোট দখলের পন্থা নিয়েছেন। দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনের পরে বাড়ি বাড়ি জগন্নাথের প্রসাদ বিলি সেই প্রচেষ্টারই অংশ। বিজেপি যখন হিন্দু ভোট এককাট্টা করতে চাইছে, তখন রীতিমতো সরকারি ব্যয়ে মন্দির-রাজনীতি করে সেই হিন্দু ভোট ধরে রাখতে চাইছেন তৃণমূল নেত্রী। একে নরম হিন্দুত্ব বললে কম বলা হয়।
দেশের রাজনীতির সাম্প্রতিক ইতিহাস অবশ্য বলছে, বিজেপির সঙ্গে এই হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতায় নেমে কোনও দলই বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেনি। তার সবচেয়ে আদর্শ উদাহরণ অরবিন্দ কেজরীওয়াল ও তাঁর আম আদমি পার্টি। দিল্লিতে ক্ষমতায় টিকে থাকতে অরবিন্দ কেজরীওয়াল নিয়ম করে হনুমান মন্দিরে যাওয়া শুরু করেছিলেন। সরকারি খরচে সুন্দর কাণ্ড পাঠের ব্যবস্থা করেছিলেন। তীর্থযাত্রার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। মন্দিরের পুরোহিত, গুরুদ্বারের গ্রন্থীদের মাসিক ভাতার কথা ঘোষণাও হয়েছিল। বিজেপির সঙ্গে বিজেপির তৈরি হিন্দুত্বের পিচেই খেলতে নেমে দিল্লিতে গোহারা হারতে হয়েছে কেজরীওয়ালকে।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে রাহুল গান্ধীও এই ভুল করেছিলেন। সে বার ভোটের আগে আচমকাই রাহুল নিজেকে শিবভক্ত বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন। ভোটের প্রচারের সময় মন্দিরে মন্দিরে যেতে শুরু করেন। রামের উপাসক বিজেপির বিরুদ্ধে নিজেকে শিবের উপাসক বলে তুলে ধরে রাহুল গান্ধী একেবারেই সুবিধা করতে পারেননি। ২০১৪-র তুলনায় ২০১৯-এ আরও বেশি আসনে জিতে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি। হয়তো সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে নিজের শিবভক্তির কথা না বলে সংবিধান হাতে ভারত যাত্রা করেছিলেন রাহুল গান্ধী।
একই ভুল করেছিলেন উত্তরপ্রদেশের দলিত নেত্রী মায়াবতী। ২০০৭-এ ‘বহুজন’ বা দলিত ভোটের সঙ্গে উচ্চবর্ণের ভোট যোগ করতে মায়াবতী ‘সর্বজন হিতায়, সর্বজন সুখায়’-এর কথা বলেছিলেন। সেই ‘সোশ্যাল এঞ্জিনিয়ারিং’ তাঁকে লখনউয়ের গদিতে বসিয়েছিল। একই সূত্র মেনে ব্রাহ্মণ ভোট জিততে ২০২২-এর উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিএসপি নেত্রী বেদমন্ত্রের সঙ্গে ত্রিশূল হাতে উদয় হয়েছিলেন। লাভ হয়নি। হিন্দুত্ববাদের সমর্থকরা হিন্দুত্বের আসল ব্র্যান্ড যোগী আদিত্যনাথকেই ভোট দিয়েছিলেন।
দেশের রাজনীতির সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে, বিজেপির বিরুদ্ধে সাফল্য মিলেছে জাতপাতের অঙ্ক কষে। বিজেপি জাতপাত নির্বিশেষে গোটা হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করতে চায়। সেই হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক থেকে দলিত, অনগ্রসরদের একাংশকে বার করে আনতে পারলে যে সাফল্য মিলতে পারে, তার সব থেকে বড় উদাহরণ ২০২৪-এর লোকসভা ভোট। বিশেষ করে সেই লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশের ফলাফল। বিজেপি চারশোর বেশি আসনে জিতে সংবিধান বদলে দিতে চায় বলে রাহুল গান্ধী যে সংবিধান হাতে প্রচার করেছিলেন, তাতেই দলিত, অনগ্রসরদের একটা বড় অংশের ভোট বিজেপির থেকে সরে গিয়েছিল। বিজেপি লোকসভা আসনের সংখ্যায় তিনশোর ঘর থেকে লাফ দিয়ে চারশো পেরোনোর বদলে সোজা আড়াইশোর নীচে নেমে এসেছিল। কারণ ২০১৪ ও ২০১৯-এ প্রভাবশালী যাদব বাদে অন্যান্য ওবিসি, মায়াবতীর নিজস্ব জাটভ সম্প্রদায় বাদে অন্য দলিতরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। ২০২৪-এ তাঁরা বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদব পিছড়ে-দলিত-অল্পসংখ্যক ভোটব্যাঙ্ককে পাখির চোখ করেই সাফল্য পেয়েছিলেন। সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের সঙ্গে হিন্দুদের মধ্যে ওবিসি ও দলিত ভোটকে এককাট্টা করেই ইন্ডিয়া জোট উত্তরপ্রদেশের ৮০টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৪৩টি জিতেছিল। বিজেপি বাকি সব পরিচয় মুছে দিয়ে শুধু ভোটারদের হিন্দু পরিচিতিই জাগিয়ে তুলতে চায়। তাই হিন্দুদের মধ্যেই বিভিন্ন রকম পরিচিতি সত্তা জাগিয়ে তোলাটাই পরিচিতি সত্তার রাজনীতির কৌশল।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, কংগ্রেস বা অন্য দল বিজেপির সঙ্গে হিন্দুত্বের রাজনীতি করতে না পেরে জাতপাতের রাজনীতি বা পরিচিতি সত্তার রাজনীতির কৌশল নিয়েছে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাম জমানাতেই পরিচিতি সত্তার রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক তাঁর সঙ্গে ছিল। পশ্চিমবঙ্গে মতুয়াদের মতো তফসিলি জাতি-ভুক্ত সমাজকে আলাদা ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে প্রাধান্য দেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বামফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার সাফল্যের অন্যতম উপাদান। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি যখন ধর্মীয় মেরুকরণে জোর দিচ্ছে, তখন মমতা ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় শিলিগুড়িতে গিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার তফসিলি জাতি ও জনজাতি নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেখানে রাজবংশী, গোর্খা, জৈন, নমশূদ্র সমাজের সঙ্গে লেপচা, ভুটিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাও ছিলেন। কারণ পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৮২টি বিধানসভা কেন্দ্রে তফসিলি জাতি ও তফসিলি জনজাতির ভোট গুরুত্বপূর্ণ।
এ বার তফসিলি জাতি, জনজাতির সঙ্গে ওবিসি ভোটব্যাঙ্কও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাখির চোখ। তাই আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিনি ৭৬টি সম্প্রদায়কে নিয়ে নতুন ওবিসি তালিকা ঘোষণা করেছেন। ফলে রাজ্যে ওবিসি তালিকা ভুক্ত সম্প্রদায়ের সংখ্যা ১৪০-এ পৌঁছেছে। ভুললে চলবে না, ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যায় তফসিলি জাতি, জনজাতির ভাগ প্রায় ২৯ শতাংশ। সেই জনগণনার সঙ্গে জাতগণনা হয়নি বলে ওবিসি-দের সংখ্যা নির্ধারণ হয়নি। কিন্তু মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে ওবিসি-র সংখ্যা জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগ। আদালতের সঙ্গে যুদ্ধ করে মমতা সেই ওবিসি ভোটব্যাঙ্ককেই বার্তা দিচ্ছেন। বিজেপি অভিযোগ তুলছে, মমতা মুসলিমদের ওবিসি-র তালিকায় নিয়ে এসে সংরক্ষণের সুবিধা পাইয়ে দিতে চাইছেন। অর্থাৎ মমতার ঝুলিতে যেমন সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে, তেমনই তাঁর পরিচিতি সত্তার রাজনীতিতে তফসিলি জাতি, জনজাতি ও ওবিসি সমাজও আছে। এর বাইরে যে উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজ, ‘জয় জগন্নাথ’-এর মন্ত্রে তিনি সেই হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককেও কাছে টানতে চাইছেন। যাতে শুভেন্দু অধিকারীর হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে এককাট্টা করে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসার স্বপ্ন সফল হতে না পারে।
সমস্যা হল, এই হিন্দুত্ব বনাম জাতপাতের রাজনীতিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়নের কথা বরাবরই ধামাচাপা পড়ে যায়। বিজেপির প্রচারে তাই হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করার কথা থাকে। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় এলে রাজ্যে কী ভাবে শিল্পায়ন হবে, সেই উত্তর মেলে না। বিজেপি তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। কিন্তু তৃণমূলে থাকতে সিবিআই-ইডির খাতায় নাম উঠে যাওয়া নেতারা বিজেপিতে গেলে কী ভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে সমস্ত তদন্ত বন্ধ হয়ে যায়, তা রহস্যই থেকে যায়।
‘জয় শ্রী রাম’ বনাম ‘জয় জগন্নাথ’-এর ভাইরাল ভিডিয়োয় ফেরা যাক। নজর করলেই দেখা যাবে, তৃণমূল ও বিজেপির ঝান্ডাধারীরা যে রাস্তায় দু’পাশে দাঁড়িয়ে রাম ও জগন্নাথের নামে হুঙ্কার দিচ্ছেন, সেই রাস্তা খানাখন্দে ভরা, কাদা ও জলমগ্ন। ভাঙা রাস্তা দিয়েই বাইক, সাইকেল, পথচারীরা চলছেন। হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতায় উন্নয়ন বরাবরের মতোই হারিয়ে গিয়েছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)