E-Paper

হারিয়ে গেলেন যাঁরা

মুক্তি সংগ্রামের মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন মাতঙ্গিনী পালও। না, মাতঙ্গিনী হাজরা নন। পুরুলিয়ার কংগ্রেস কর্মী দেবেশ্বর পালের মেয়ে মাতঙ্গিনী পালের ব্যক্তিজীবনও প্রায় অজানা।

সোনালী দত্ত

শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৫৯

—প্রতীকী ছবি।

মেদিনীপুরের তেরপেখিয়ায় গদাধর প্রধানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁর, তিন বছরের মধ্যেই বৈধব্য। সমাজ-সংসারের কলরব ঠেলে দিল যৌনকর্মীর কাজে। কিন্তু হৃদয়ে তাঁর দেশ বিরাজ করে। যন্ত্রণা দেয় পরাধীনতা। মুক্তি সংগ্রামে সরাসরি যোগ দেবার সামর্থ্য নেই। সমাজই বন্ধ করেছে সব রাস্তা। রাতের অভিসারে যে সরকারি আমলা বা পুলিশ আসত, তাদের মুখ থেকে গোপন খবর বার করে তিনি জানিয়ে দিতেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার তাড়না তাঁকে পথে টেনে নিয়ে এল। ‘লবণ আইন অমান্য’ করতে মদের বাজারে পিকেটিং করতে গেলেন ১৯৩২ সালের ১১ জানুয়ারি। গ্রেফতার হয়ে তিন মাসের কারাবাস, মুক্ত হয়ে আবার গেলেন নন্দীগ্রাম থানা এলাকার এক রাজনৈতিক সভায়, ১৯ অগস্ট। তাঁকে চিনে ফেলল এক পুলিশ কর্মচারী, চুল ধরে টানতে টানতে, পদাঘাত করতে করতে নিয়ে গেল পুকুরের ধারে। শুরু হল প্রহার। বীভৎস নির্যাতনের পর যখন হাসপাতালে আনা হল, কিডনি ও দেহের অন্য রেচন-অঙ্গ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। দুঃসহ যন্ত্রণা সয়ে পেলেন মৃত্যুর মুক্তি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে কখনও স্থান না পাওয়া এই শহিদের নাম সত্যবতী দেবী৷ শুধু মেদিনীপুরেই এমন অসংখ্য সত্যবতী ছিলেন, ভারত যাঁদের ইতিহাসে স্থান দেয়নি। এ দেশের সমস্ত নারীর মতোই, মুক্তি সংগ্রামে যোগ দেওয়া নারীরাও উপেক্ষিতা।

মুক্তি সংগ্রামের মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন মাতঙ্গিনী পালও। না, মাতঙ্গিনী হাজরা নন। পুরুলিয়ার কংগ্রেস কর্মী দেবেশ্বর পালের মেয়ে মাতঙ্গিনী পালের ব্যক্তিজীবনও প্রায় অজানা। শ্বশুরবাড়ির আপত্তি অগ্রাহ্য করে ১৯৩২ সালে বেলদা গ্রামে এক বিরাট জনসভায় নেতৃত্ব দেন মাতঙ্গিনী। পরে আইন অমান্য করে মিছিল নিয়ে পথ হাঁটেন। সশ্রম কারাদণ্ড হয় তাঁর। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে বেরিয়ে ৪ জুলাই আবার মিছিলের নেতৃত্ব দেন তিনি, ‘বন্দি দিবস’ উপলক্ষে সংগঠিত সেই মিছিল স্লোগান তুলেছিল ‘ব্রিটিশ শাসন ধ্বংস হোক’! জেল গেটে পৌঁছনোর পর সকলে যখন পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায়, অ্যাডিশনাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ রাগে উন্মত্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাতঙ্গিনীর উপর। তাঁকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে এনে শুরু করল ভয়ঙ্কর নির্যাতন। অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও মাতঙ্গিনী ভেঙে পড়েননি। পরের বছর বন্দি দিবসেও তাঁকে আবার দেখা গিয়েছিল— মিছিলের নেতৃত্ব দিতে।

কিন্তু তার পর কী হল মাতঙ্গিনীর? আমরা জানি না। আজ থেকে সাত-আট দশক আগে অন্দর থেকে বাইরে আসার ‘পাপ’ অস্বীকার করে মুক্তি সংগ্রামে যোগ দেওয়া নারীদের অধিকাংশই সরকারি বয়ানে ‘শহিদ’ হওয়ার স্বীকৃতি পাননি। মাতঙ্গিনী হাজরা যদি বা স্মরণীয় হতে পেরেছেন, মাতঙ্গিনী পালদের সে সৌভাগ্য হয়নি৷ তাঁরা স্রেফ হারিয়ে গিয়েছেন। হয়তো সংসার তাঁদের বর্জন করেছে অথবা করেছে অন্তরিন, হয়তো এসেছে কষ্টের মৃত্যু। এই পরিণতিতে কেবল অবহেলা আর বিস্মৃতিই ছিল, গৌরবের ভাগ পাননি প্রায় কেউই৷ স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশনের লাইনে সংখ্যা হয়ে থেকে গিয়েছেন অনেকে, অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অব্যক্ত অভিমানে।

এই প্রসঙ্গে ঢাকার মেয়ে বিপ্লবী সুহাসিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা না বললেই নয়। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামে হল সশস্ত্র অভ্যুত্থান। জালালাবাদ পাহাড়ে শহিদদের স্যালুট দিয়ে জীবিত বিপ্লবীরা ছড়িয়ে পড়লেন এ দিক-ও দিক। বিপ্লবী অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল এবং জীবন ঘোষাল এসে আশ্রয় নিলেন নেতা ভূপেন্দ্র দত্তের কাছে, কলকাতায়। কিন্তু কলকাতা তেমন নিরাপদ জায়গা নয়। কাজেই তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হল ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরে। বিপ্লবী শশধর আচার্য ও সুহাসিনী সেখানে এক নকল সংসার পাতলেন দম্পতির পরিচয়ে। সেই ‘সংসার’-এ আশ্রয় পেলেন পলাতক বিপ্লবীরা। দুর্ভাগ্য, পুলিশ সেই আস্তানার সন্ধান পেয়ে যায়। কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে চন্দননগরের সেই বাড়ি ঘিরে ফেলেন। বিপ্লবীরা অস্ত্র হাতে তুলে নেন। গভীর রাতের অন্ধকারে শুরু হয় এক অসম যুদ্ধ। জীবন ঘোষাল গুলিবিদ্ধ হয়ে গাছ থেকে পুকুরে পড়ে যান, পরে উদ্ধার হয় তাঁর মৃতদেহ। বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা হিসাবে শশধর আচার্য এবং সুহাসিনী গঙ্গোপাধ্যায় গ্রেফতার হন। সুহাসিনীকে এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত করেছিলেন টেগার্ট। এর পর বেশ কয়েক বছর বন্দি ছিলেন সুহাসিনী— স্বাধীন ভারতে, ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ এই বিপ্লবীর মৃত্যু হয়। একটি সামান্য দুর্ঘটনায় আহত হলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, সেখানে ন্যূনতম চিকিৎসাটুকুও না পেয়ে পরে মারা যান তিনি।

এখন স্বাধীনতার উদ্‌যাপন হয় জনপ্রিয় হিন্দি ছবির রোম্যান্টিক দেশাত্মবোধক গানের সুরে নেচেকুঁদে— যাঁরা অহিংস অথবা সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিলেন, তাঁদের নাম কমই উচ্চারিত হয়। নারী বিপ্লবীদের বৃত্তান্ত ও পরিণতি সম্পর্কে এই উৎসবে স্বভাবতই কোনও উল্লেখ পর্যন্ত থাকে না। এ বিষয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থের সংখ্যাও হাতেগোনা। এমনকি এই বাংলাতেও ছবিটা খুব একটা আলাদা নয়। কাজেই উজ্জ্বলা মজুমদার, কল্যাণী দাস, কুসুম বাগদি, জ্যোতিকণা দত্ত, পারুল মুখোপাধ্যায়, প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম, বেলা মিত্র, রোকেয়া বেগম, হালিমা খাতুন, দুকড়িবালা দেবী, বিমলপ্রতিভা দেবী, লাবণ্যপ্রভা দত্ত, সাবিত্রী চক্রবর্তী প্রমুখের নাম আমাদের না-শোনাই থেকে যায়৷ যে ভারত দেশকে মা বলে, যে ভারতে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ও নির্যাতিত, যে ভারতে ধর্ষক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর ধর্ষিতার পরিবারকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়, এই নামগুলিকে ঐতিহাসিক চরিত্র হিসাবে সামনে পেলে হয়তো সে দেশের আকাশে একটা আশার সূর্য জ্বলে ওঠার উৎসাহ পেত। পঁচাত্তর পেরিয়ে না হোক, একশোর পথে এগিয়ে চলা আমাদের স্বাধীনতা হয়তো সত্যিই অমৃতের মহোৎসব হয়ে উঠতে পারত।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

India Independence

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy