Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
History

বিরোধ ও মিলনের ইতিহাস

‘সুসভ্য’ পশ্চিম তার ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকেই বার বার দাবি করে এসেছে ভারতবর্ষের কোনও জাতীয়তাবাদের ইতিহাস নেই।

Mughal painting.

শিল্প: মোগল চিত্রকলা। উইকিমিডিয়া কমনস।

আবির্ভাব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৫৬
Share: Save:

ভারতবর্ষের ইতিহাস কাহাদের ইতিহাস।” বাক্যটি থেকে রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন তাঁর ‘পূর্ব ও পশ্চিম’ প্রবন্ধটি। এই প্রবন্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লে দেখা যাবে লিখিত আছে গ্রহণের কথা, মিলনের কথা। কী ভাবে আর্য অনার্যের সঙ্গে মিলল, ব্রাহ্মণ শূদ্রের সঙ্গে মিলল। আচার, ধর্ম, পূজাপ্রণালী, গ্রহণ করে ঐক্য ও বিরোধ নিয়েই মিলল, সেই কথা। ভারতের ইতিহাস যে শুধুমাত্র হিন্দু ও মুসলমানের ইতিহাস নয়, তিনি বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছেন। “...আমরা মনে করি জগতে স্বত্বের লড়াই চলিতেছে, সেটা আমাদের অহংকার; লড়াই যা সে সত্যের লড়াই।”

ইতিহাস সত্য। এখন কথা হল, কতখানি সত্য? বলা যায় যে, মতামত ও বিশ্লেষণে না গিয়ে ইতিহাস যত ক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে তথ্যে অর্থাৎ সময় ও ঘটনায় আবদ্ধ রাখে, তত ক্ষণ পর্যন্ত তা সত্য। কিন্তু বিশ্লেষণকে সরিয়ে রাখলেও, ঘটনার বিবরণ দিতে গেলেই ইতিহাসের মধ্যে এসে যায় পরিপ্রেক্ষিত, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, মতাদর্শ। ঠিক যে রকম অর্ধেক গেলাস জল কী ভাবে বর্ণনা করা হবে তা নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির উপর। তেমনই স্বাধীনতা সংগ্রাম বনাম ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, বিপ্লবী বনাম সন্ত্রাসবাদী— এমন যাবতীয় একজাতীয় দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যের নির্মাণ করে এই বর্ণনা।

কিন্তু তথ্য? সেই তথ্য কি একমাত্রিক কিছু? ইতিহাসবিদের তথ্য প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়। ইতিহাসবিদ ই এইচ কার-এর বহুচর্চিত গ্রন্থ হোয়াট ইজ় হিস্ট্রি?-র সেই কথা, যেখানে তিনি বলছেন— ইতিহাসবিদের কাছে ইতিহাসের তথ্য হল মাছের বাজারে সাজানো সারি সারি মাছের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া মাছ; যার থেকে কী ইতিহাস নির্মিত হবে তা নির্ভর করছে সেই মাছ কী ভাবে রান্না করা হবে তার উপর। ইতিহাসবিদ কোন তথ্যকে বর্জন করে কোন তথ্যকে গ্রহণ করবেন, কী ভাবে তাকে পরিবেশন করবেন তার উপর নির্ভর করেই রচিত হবে ইতিহাস। এর ফলে ইতিহাসের যে এক রকমের গণতন্ত্রীকরণ হল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ইতিহাস একটি জাতির কোন কাজে লাগে? জার্মান দার্শনিক হের্ডার মনে করেছিলেন— একটি জাতি তার প্রাচীনত্বের দাবি যত দৃঢ় ভাবে তুলতে পারে, তত তার জাতি গঠনের ভিত মজবুত হয়। জাতি হিসাবে তার দাবির অস্তিত্ব মজবুত হয়। ইতিহাস এই কাজটাই করে। ইতিহাসের মধ্যে লেখা থাকে একটি জাতির গড়ে ওঠার দিনের চলা পথের সম্মিলিত স্মৃতি, অতীত গৌরব ও গ্লানি; বিরোধ ও মিলনের যাবতীয় উপাদান।

‘পূর্ব ও পশ্চিম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “হিন্দুর ভারতবর্ষে যখন রাজপুত রাজারা পরস্পর মারামারি কাটাকাটি করিয়া বীরত্বের আত্মঘাতী অভিমান প্রচার করিতেছিলেন, সেই সময়ে ভারতবর্ষের সেই বিচ্ছিন্নতার ফাঁক দিয়া মুসলমান এ দেশে প্রবেশ করিল, চারি দিকে ছড়াইয়া পড়িল এবং পুরুষানুক্রমে জন্মিয়া ও মরিয়া এ দেশের মাটিকে আপন করিয়া লইল।” রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থে’ও ‘শক-হুন-দল পাঠান মোগল/ এক দেহে হল লীন।’ এক দেহে তো লীন হল, মনে মিলল কি?

মনেও যে মিল হয়েছিল তা বোঝা যায় স্থাপত্য, শিল্পকলা ও সঙ্গীত থেকে। কয়েক মাস আগে কলকাতায় ‘অবন ঠাকুরের ছবিলেখা’-র বিষয়ে বলতে গিয়ে দার্শনিক অধ্যাপক অরিন্দম চক্রবর্তী অবনীন্দ্রনাথ থেকে পড়ে শোনাচ্ছিলেন। যেখানে অবনীন্দ্রনাথ বলছেন— মোগল বা তুর্কি যে ভাবে মিলেছিল, ইংরেজের সঙ্গে ভারতের মিলন সেই ভাবে হল না। মালা-বদল হয়েছিল মোগলের সঙ্গে। এর পরেই অরিন্দম চক্রবর্তী বলছেন— আমাদের দুর্ভাগ্য, এখন আমরা মনে করছি যে, মোগল কোনও দিন মেলেইনি। ইংরেজ শুধু আমাদের দেশ ভাগ করে দিয়ে গিয়েছে তা-ই নয়, আমাদের দেশের সমস্ত চিত্তটাকে ভাগ করে দিয়ে গিয়েছে।

‘সুসভ্য’ পশ্চিম তার ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকেই বার বার দাবি করে এসেছে ভারতবর্ষের কোনও জাতীয়তাবাদের ইতিহাস নেই। পরবর্তী কালে তারা বলেছে— যেটুকু যা আছে তা ওই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়োজনেই উদ্ভূত। ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর দ্য নেশন অ্যান্ড ইটস ফ্র্যাগমেন্টস: কলোনিয়াল অ্যান্ড পোস্টকলোনিয়াল হিস্ট্রিজ় বইতে এর একটি চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ইতিহাস যেন আমাদের মতো উপনিবেশবাসীদের জন্য এই ডিক্রি জারি করে দিয়েছে যে, আমরা চিরজীবন গ্রহীতা হয়েই থাকব। ইউরোপ-আমেরিকাই যেন ইতিহাসে প্রকৃত ‘সাবজেক্ট’। তাই, যাবতীয় কথা বলার, ভাবনা-চিন্তা করার সব ‘এজেন্সি’ যেন তাদেরই। ওরাই আমাদের হয়ে ভাবনা-চিন্তা করে দেবে এবং তার ফসল হিসাবেই যেন আমরা আলোকপ্রাপ্ত হব, তেমনই বুঝি লিখিত আছে।

যে স্বাধীন ভারত ‘আজ়াদির অমৃত মহোৎসব’ পালন করল, সেই ভারত নয়া ইতিহাস নিশ্চয়ই লিখবে। তবে, রাস্তা, শহর, সৌধ বা স্টেশনের নাম বদলে দিলে তার ঔপনিবেশিক ইতিহাস যেমন মিথ্যে হবে না, তেমনই পাঠ্যক্রম থেকে মোগল অধ্যায় অথবা দেশভাগ বাদ গেলে দেশের ইতিহাস থেকে তা মিথ্যা হয়ে যাবে না। আসলে যা বাদ পড়ে যাবে, তা হল, ভারতের আবহমান ইতিহাসের একটি মূল সুর— বহুত্ব— দ্বন্দ্ব ও মিলন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

History India Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE