Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Indian Railways

পরিকাঠামো তৈরি না হলে

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, আগামী কয়েক বছরে দেশে চারশোটি ‘বন্দে ভারত’ এক্সপ্রেস চালু হবে। অর্থাৎ, সরকার এই মুহূর্তে রেলের উন্নতির প্রতীক হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে বন্দে ভারত গোত্রের ট্রেনকে।

এ রাজ্যে বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের গতি যাত্রাপথের পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারণে দেশের অন্যান্য দ্রুতগতির ট্রেনের তুলনায় অনেকটাই কম।

এ রাজ্যে বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের গতি যাত্রাপথের পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারণে দেশের অন্যান্য দ্রুতগতির ট্রেনের তুলনায় অনেকটাই কম। ফাইল চিত্র।

পার্থ প্রতিম বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:৫১
Share: Save:

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের এক বনিয়াদি পরিকাঠামো হল রেল ব্যবস্থা— যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের অন্যতম ‘লাইফলাইন’। আর্থ-সামাজিক ভাবে দুর্বল মানুষের বেঁচে থাকা, উন্নত যোগাযোগ গড়ে তাঁদের সবল করার দায়িত্ব পালন করেছে রেল। কিন্তু পরিবহণের দুই মূল সূত্র— দ্রুত এবং নিরাপদ পরিবহণ— ভারতে এখনও যথাযথ নয়। ফলে ‘বন্দে ভারত’-এর মতো দ্রুতগামী ট্রেনের গতিকে দেশের আত্মনির্ভর প্রযুক্তির বিজ্ঞাপন হিসাবে ব্যবহার করলেও প্রশ্ন ওঠে রানাঘাট লোকাল বা দানাপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জারের মতো আমজনতার রেলের গতি, সুরক্ষা এবং স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, আগামী কয়েক বছরে দেশে চারশোটি ‘বন্দে ভারত’ এক্সপ্রেস চালু হবে। অর্থাৎ, সরকার এই মুহূর্তে রেলের উন্নতির প্রতীক হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে বন্দে ভারত গোত্রের ট্রেনকে। সেখানেই তৈরি হচ্ছে সবচেয়ে বড় খটকা, রেলের সার্বিক উন্নয়নের ‘রোড ম্যাপ’ নিয়ে। সম্প্রতি দেশের ষষ্ঠ ‘বন্দে ভারত’ এক্সপ্রেস চালু হয়েছে হাওড়া থেকে নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত। ৫৬১ কিলোমিটার যেতে সময় লাগবে আট ঘণ্টা। অর্থাৎ, পাটিগণিতের নিয়মে গড় গতিবেগ ঘণ্টায় সত্তর কিমি। প্রায় হাজার তিনেক ট্রেনকে নিয়ে করা সিএজি-র সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, দেশের দুই শতাংশ ট্রেনের যাত্রাপথে গড় বেগ ঘণ্টায় পঁচাত্তর কিলোমিটারের বেশি। কাজেই, বন্দে ভারত-এর গতি অদৃষ্টপূর্ব নয়। ইঞ্জিন কিংবা কোচের দৌড়ের ক্ষমতা যতই বাড়ুক না কেন, যাত্রাপথের সার্বিক রেল লাইন বা রেল সেতুর হাল, ট্রেনের সংখ্যা, সিগনাল, স্টেশনের সংখ্যা এবং নিরাপত্তার আনুষঙ্গিক বিষয়গুলি ব্যতিরেকে যাত্রার সময় কমানো যায় না। ইতিমধ্যে আমদাবাদ, বারাণসী বা কাটরাগামী বন্দে ভারত এক্সপ্রেস বেশ কিছু দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে রেললাইনে চলে আসা গবাদি পশুর কারণে। পশ্চিমবঙ্গের মতো বেশি জনঘনত্বের রাজ্যে লাইন পারাপার করা মানুষ কিংবা গবাদি পশুর বিপদ যথেষ্ট। ফলে, যত ক্ষণ না ট্রেনের যাত্রাপথের জনবহুল অংশগুলিতে লাইনের দু’পাশ নিরাপত্তা ঘেরাটোপে আনা যাবে, তত ক্ষণ ট্রেনের গতিবৃদ্ধির সঙ্গে জুড়বে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও।

ভাড়া স্থির করার সময় বহু ট্রেনকে ‘সুপারফাস্ট’ তকমা দিলেও এ দেশে একটি ট্রেনেরও গড় গতিবেগ ঘণ্টায় একশো কিমি নয়। দেশের দ্রুততম ট্রেন দিল্লি থেকে ঝাঁসিগামী ‘গতিমান এক্সপ্রেস’, গড় বেগ ঘণ্টায় ৯৩.১ কিমি। বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের গড় বেগ ঘণ্টায় ৮৮.৩ কিমি। এ রাজ্যে বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের গতি যাত্রাপথের পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারণে দেশের অন্যান্য দ্রুতগতির ট্রেনের তুলনায় অনেকটাই কম। যৎসামান্য বাজেটবরাদ্দ সেই পরিকাঠামোর উন্নতির সম্ভাবনাকেও সীমিত করেছে। কাজেই, এ রাজ্যে বন্দে ভারত-এর সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। তার উপরে, এই ট্রেন কলকাতা ছাড়বে কাকভোরে, ফিরতি পথে কলকাতায় ঢুকবে গভীর রাতে। সম্ভবত, যাঁদের গাড়ি আছে, শুধু তাঁদের কথা ভেবেই তৈরি হয়েছে সময়সূচি।

এ দেশে প্রতি দিন গড়ে আড়াই কোটি মানুষ ট্রেনে যাতায়াত করেন। দেশের শহর-শহরতলির আমজনতার লাইফলাইন হল লোকাল ট্রেন। ২০১২-১৩ সালে গোটা দেশে ইএমইউ লোকাল ট্রেনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৪১.৬ কিমি, যা ২০১৯-২০ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ঘণ্টায় ৩৮.৫ কিমি। ওই একই সময়কালে প্যাসেঞ্জার ট্রেনের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ৩৬.২ কিমি থেকে কমে হয়েছে ৩৩.৫ কিমি। ‘শতাব্দী’ থেকে ‘রাজধানী’ কিংবা ‘তেজস’ থেকে ‘বন্দে ভারত’-এর গতি নিয়ে সরকারি স্তরে মাতামাতি হলেও গতি কমেছে আমজনতার ট্রেনে। ট্রেন ‘লেট’ করার প্রবণতাও বেড়েছে— ২০১৩-১৪ সালে দেশের ৮২.৬% ট্রেন সময়সীমার মধ্যে চলেছিল, ২০১৮-১৯ সালে ৭৫.৩ %।

বিশ্বের চতুর্থ দীর্ঘতম রেলপথ ভারতে, আনুমানিক দৈর্ঘ্য ১,২৬,৩৬৬ কিমি, যার মধ্যে এ রাজ্যে রয়েছে ১০,৩০৯ কিমি। দেশের মধ্যে রেলপথের ঘনত্ব সর্বাধিক এ রাজ্যেই, এবং এই রাজ্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার। নতুন রেল লাইন স্থাপন যতটা জরুরি, তার চেয়েও বেশি জরুরি পুরনো রেল পরিকাঠামোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কার। বিশেষত পুরনো লাইনে নতুন দ্রুতগতির ট্রেন চালানোর আগে এই সতর্কতা বিশেষ প্রয়োজন, কারণ পুরনো লাইনে ট্রেনের সংখ্যা ও গতিবৃদ্ধির কারণে লাইনের আয়ু ক্ষয়ের হার বাড়ে। তখন সেই দুর্বল রেলপথকে প্রযুক্তিনির্ভর উপায়ে চিহ্নিত করা এবং সেগুলির পরিবর্তন জরুরি।

এ সবের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত সংখ্যায় দক্ষ কর্মী। চোদ্দো লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র ভারতীয় রেলে এখন শূন্য পদের সংখ্যা পাঁচ লক্ষের কাছাকাছি। রেলসেতু পর্যবেক্ষণ এবং মেরামতির কাজে প্রয়োজনীয় কর্মীর ৬০% পদ খালি। অথচ, দেশের ১,৪৫,৫২৩টি রেলসেতুর মধ্যে ৩৭,৬৮৯টি শতাব্দীপ্রাচীন। ফলে রেলসেতুর সুরক্ষাসমেত সার্বিক রেল পরিকাঠামোর সুরক্ষা আজ এই কর্মী-সঙ্কটে বড় প্রশ্নের মুখে। আর এমন বিপদ সঙ্গে নিয়ে আগামী তিন বছরে চারশো বন্দে ভারত ট্রেন চালানোর সরকারি সিদ্ধান্ত স্বস্তির চেয়ে বেশি শঙ্কার কারণ হয়ে উঠতে পারে।

নির্মাণ প্রযুক্তি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Railways Vande Bharat Express
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE