Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
cinema

‘যে যেখানে লড়ে যায়...’

২০১৩-র মে মাসে সদ্য উন্মেষিত পিপলস ফিল্ম কালেক্টিভ-এর দুই সদস্য কস্তুরী বসু ও দ্বৈপায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় পৌঁছে যান নৈহাটির বন্ধ হয়ে যাওয়া গৌরীপুর জুট মিলে।

—ফাইল চিত্র।

দেবলীনা
শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:০৪
Share: Save:

১৯৬৭ সালে গুয়াতেমালার সেনার হাতে নৃশংস ভাবে নিহত তরুণ কবি রেনে কাস্তিয়ো-র কবিতা আওড়ে চলে ১৯৮৬-র আম্মা আরিয়ান ছবির চরিত্র (ছবি)। সে ছবি তৈরি হয়েছিল জনগণের অর্থসহযোগিতায়। পরিচালক জন আব্রাহাম। তিনি তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন গ্রামে-গঞ্জে-মফস্‌সলে, সিনেমাকে সম্বল করে— মাঠে-ঘাটে-বসতিতে-মেহনতি মানুষের আঙিনায় সিনেমা দেখিয়ে করলেন মাধুকরী। সেই প্রয়াসের নাম দিলেন ‘ওডেসা কালেক্টিভ’।

২০১৩-র মে মাসে সদ্য উন্মেষিত পিপলস ফিল্ম কালেক্টিভ-এর দুই সদস্য কস্তুরী বসু ও দ্বৈপায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় পৌঁছে যান নৈহাটির বন্ধ হয়ে যাওয়া গৌরীপুর জুট মিলে। দেখানো হয় আনন্দ পটবর্ধনের অকুপেশন: মিলওয়ার্কার এবং মেঘনাথ বিজু টোপ্পো-র ছবি গাড়ি লোহরদগা মেল। মনে পড়তে পারে, সত্তরের দশকের আশেপাশে ঋত্বিক ঘটকের আমার লেনিন, গৌতম ঘোষের হাংরি অটাম, উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর মুক্তি চাই, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ঢুলি নিয়ে ফিল্ম সোসাইটির বাইরে বেরিয়ে কিছু মানুষ কারখানা বা বস্তি অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিলেন। উদ্যোগটির নাম ছিল ‘পিপলস ফিল্ম ওয়ার্কশপ’। ছবি দেখার সেই জমায়েতে দর্শক ছবির মনোযোগী আলোচক হয়ে উঠলেন। মেহনতি মানুষ ছবির রাজনীতি নিয়ে সওয়াল জবাব করলেন।

এমত ইতিহাসকে সাক্ষ্য রেখেই পিপলস ফিল্ম কালেক্টিভ তার যাত্রা শুরু করল। তাদের ইস্তাহারে লেখা রইল ১৯৬০-৭০’এ লাতিন আমেরিকায় ঘটে যাওয়া তৃতীয় সিনেমার আন্দোলনের কথা। যার পুরোভাগে ছিলেন আর্জেন্টিনার চলচ্চিত্র নির্মাতা ফার্নান্দো সোলানাস এবং অক্টাভিয়ো গেতিনো। লেখা রইল শহিদ শঙ্কর গুহনিয়োগীর ‘সংঘর্ষ অউর নির্মাণ’ আন্দোলনের কথা। ক্রমে এই কালেক্টিভ হয়ে উঠল স্বাধীন একটি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক গোষ্ঠী, যাদের সম্বল সাধারণ মানুষের অর্থ এবং উৎসাহ। জনগণই যার একমাত্র পৃষ্ঠপোষক।

কালেক্টিভ-এর এক দশকের চড়াই-উতরাই পথচলায় কত ঘটনা। ২০১৩-তে মুজ়ফ্‌ফরনগর দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে বানানো নকুল সিংহ সাহনি-র ছবি মুজ়ফ্‌ফরনগর বাকি হ্যায় প্রথম দেখানো হয় ‘কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এ। দেশ জুড়ে সাড়া ফেলে এই নির্ভীক তথ্যচিত্র। রোহিত ভেমুলা নামে এক যুবা হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছবিটি দেখানোর ইচ্ছা জানিয়ে আয়োজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার পর, রোহিত নিজেই খবর হয়ে গেলেন। ২০১৬-র জানুয়ারির যে দিনে রোহিত আত্মহত্যা করলেন, তখন ফেস্টিভ্যাল চলছে। সেই শোকের আবহে উপস্থিত ছিলেন দীপা ধনরাজ, যিনি পরবর্তী কালে রোহিতের এই পরিণতি নিয়ে নির্মাণ করবেন এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ছবি উই হ্যাভ নট কাম হিয়ার টু ডাই। ২০২০ সালে দুই স্বাধীন নির্মাতা অস্কার জোখ আর মাতিয়াজ় পিন্টারের প্রথম দেখা হয় এই ফেস্টিভ্যালেই, একই ঘরে থাকছিলেন তাঁরা। এই উৎসব যেন জুড়ে দিল তাঁদের, এখন ওঁরা এক সঙ্গে জুটি বেঁধে ছবি বানাচ্ছেন।

এক বার আচমকাই হল-কর্তৃপক্ষ হল দিতে নারাজ হলেন। স্পষ্ট উচ্চারণে বলা রাজনৈতিক ছবির আবহই কি এই উচ্ছেদের কারণ? প্রায় বিনা নোটিসে পাততাড়ি গুটিয়ে নতুন মোকামের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হল। উৎসব বন্ধ হল না অবশ্যই, কিন্তু উচ্ছেদের এমন তিক্ত স্মৃতি আরও হুঁশিয়ার করে তুলল, বিশেষ করে দেশের এমন ফ্যাসিবাদী সময়কালে।

এই দশ বছরে বাৎসরিক ছবির উৎসব আয়োজন করা ব্যতিরেকেও এই দল নানাবিধ কর্মকাণ্ডের নিরন্তর চর্চায় নিয়োজিত থেকেছে। মাসিক আলোচনা ও ছবির প্রদর্শনী, ভ্রাম্যমাণ সিনেমা ও ছোটদের জন্য সিনেমা (লিটল সিনেমা); সিনেমা নির্মাণ বিষয়ে কর্মশালা, কোভিড সময়ে যা অনলাইনেও হয়েছিল; পিপলস স্টাডি সার্কল প্রকাশ করে চলেছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পুস্তিকার সিরিজ়; প্রতিরোধের সিনেমা নামে সাময়িক-পত্র প্রকাশ, সেমিনার, পিপলস স্টাডি সার্কল এবং অবশ্যই জনগণের ভরসায় নিজেদের ছবি বানানো। দশ বছরের এমন ঘটনাবহুল যাত্রাপথে সঙ্গে হেঁটেছেন অসংখ্য স্বাধীন চিত্রনির্মাতা, গবেষক, চলচ্চিত্রকর্মী, লেখক, শিল্পী, গায়ক, যন্ত্রী এবং অবশ্যই অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী মানুষ।

এই সময়-সারণির আগে-পরে সারা দেশ জুড়েই সিনেমাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে নানাবিধ অন্য ধারার উদ্যোগ। ২০০৬ সালে গোরখপুরে শুরু হয়েছে ‘সিনেমা অব রেসিস্ট্যান্স’, যা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ভোপালে কমিউনিটির মানুষদের নিয়ে যৌথ উদ্যোগে একের পর এক ছবি বানিয়ে চলেছে একতারা কালেক্টিভ। দক্ষিণে আছে ‘পেডেস্ট্রিয়ান পিকচার্স’। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে গ্রাম-মফস্‌সলের সঙ্গীদের কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে নকুল সিংহ সাহনি শুরু করেছেন ‘চলচ্চিত্র অভিযান’। এই দেশ যখন চরম এক সঙ্কটমুহূর্তে এসে উপস্থিত হয়েছে, তখন ভারত জুড়ে এমন সব স্থানীয় উদ্যোগ এই গভীর তমস সময়েও আশার রোশনি হয়ে ওঠে। মূলধারার সিনেমার রাজপথ ছেড়ে জনতার সিনেমা যখন আন্দোলনের ভাষা হয়ে ওঠে তখন বৃহৎ পুঁজি, কর্পোরেট অথবা সরকার তার নানা কিসিমের শক্তি নিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালেও কেউ কেউ শিরদাঁড়া সোজা রেখে সেই পথ দিয়ে হাঁটেন, তোয়াক্কাহীন।

হয়তো কখনও রেনে কাস্তিয়োর কবিতা অন্য ভাবে লেখা হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

cinema Protest People
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE