প্রথমত বলি, রণজিৎদার পশুপ্রীতির গল্প। রণজিৎদা ক্যানবেরায় বসবাস করতে শুরু করার কিছু দিনের মধ্যে একটি কালো ঘরছাড়া বেড়াল নিজেই এসে রণজিৎদাদের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। বেড়ালটি রোগা-পাতলা, কোথা থেকে যে সে এসেছিল, কেউ জানে না। কিন্তু রণজিৎদাদের পরিবারে তার দিব্যি একটা মৌরসি পাট্টা জুটে গিয়েছিল। যখনই রণজিৎদার বাড়িতে গিয়ে কোনও আড্ডায় বা আলোচনায় (বাঙালি হিসেবে এই দু’টি অভ্যাস আলাদা করা খুব শক্ত) বসেছি, সে তৎক্ষণাৎ কোত্থেকে এসে দু’তিন বার রণজিৎদার চার পাশে ঘুরে মিউ মিউ করে কিছু একটা আর্জি পেশ করে হঠাৎ এক লাফে রণজিৎদার কোল জুড়ে বসত। রণজিৎদা সস্নেহে তার কালো লোমে আঙুল বোলাতে বোলাতে নানা রকম দুরূহ তত্ত্ব আলোচনায় মগ্ন হতেন। দেখে আমার বেড়াল-কাঁধে আর এক নামী ইতিহাসবিদ ই পি টমসনের ছবির কথা মনে পড়ত। এক দিন গিয়ে দেখি, রণজিৎদা আর মেখঠিল্ড একটি জুতোর বাক্সের মধ্যে বেড়ালটির জন্য একটি ছোট্ট বিছানা বানিয়েছেন। বেড়ালটি নেই। জিজ্ঞেস করতে জানলাম, অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে সে গুরুতর জখম হয়েছে, তাই সে হাসপাতালে গিয়েছে অস্ত্রোপচারের জন্য। বেড়াল হাসপাতাল থেকে বাড়ি এল, খুব যত্নে সেই জুতোর বাক্সের মধ্যে নরম বিছানায় শুয়ে সে মেখঠিল্ড ও রণজিৎদার শুশ্রূষা পেয়ে সেরে উঠল আবার। চিকিৎসার খরচ অল্প ছিল না, এবং যত দূর জানি, সেই সমস্ত খরচ রণজিৎদারাই দিয়েছিলেন। আমার স্মৃতি বলছে যে, ওঁরা ক্যানবেরা ছাড়ার আগেই বেড়ালটির জীবনাবসান ঘটে।
বেড়াল নাহয় ঘরছাড়া হলেও গৃহপালিত জন্তু। রণজিৎদাদের বাড়ির পিছনের বাগানে গাছের ফল খেতে আসত অস্ট্রেলিয়ানরা যাদের ‘পসাম’ বলে, সেই নিশাচর মারসুপিয়াল জাতীয় প্রাণীরা। বেশ বড়সড় বেড়ালের সাইজ়। মানুষ দেখতে অভ্যস্ত হলেও এরা কিন্তু বন্য প্রাণীই। এই রকম একটি পসামের সঙ্গে রণজিৎদাদের বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। রণজিৎদারা তার জন্য ফল জোগাড় করে রাখতেন। এক দিন রণজিৎদা দেখা হতেই খুব উৎসাহভরে বললেন, “কাল সন্ধেবেলা কী হয়েছিল, জানো? সেই পসামটি এসেছে, অন্ধকারে তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ও মা, তাকিয়ে দেখি তার মাথার উপর দিয়ে আরও একজোড়া ছোট্ট চোখ দূরের তারার মতো তীক্ষ্ণ হয়ে জ্বলছে! বুঝলাম, বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে মা পিঠে করে।” রণজিৎদার সেই উত্তেজিত ও খুশি মুখখানি আমি কখনও ভুলব না। এমন ভাবে বলছিলেন যেন পসামটি তার বাচ্চার সঙ্গে তার মানুষ বন্ধুদের পরিচয় করাতে নিয়ে এসেছিল! সত্যিই হয়তো তাই।
রণজিৎদার সঙ্গে দিনের বেলা বেশির ভাগ আলোচনা ও গল্পই হত হাঁটতে হাঁটতে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লাগোয়া ছিল ক্যানবেরা শহরের কেন্দ্রস্থিত বার্লি গ্রিফিন হ্রদ। ঢাকুরিয়া লেকের মতো এটিও একটি মনুষ্যসৃষ্ট লেক, ১৯৬০-৬৩ সাল ধরে খনন ও ভর্তি করা হয়। আয়তন ছাড়াও আমাদের কলকাতার লেকের সঙ্গে একটা বড় তফাত হল যে, এই লেকটি নিকটস্থ মলংলো নদীর সঙ্গে জোড়া ও এর এক পাশে মনোরম পাহাড়, ব্ল্যাক মাউন্টেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর দিয়ে একটু হাঁটলেই সেই লেকের ধারে হাঁটার পথে পৌঁছে যেতাম। রণজিৎদা অনেক কিছু নিয়ে গল্প করতেন। তখনই জেনেছিলাম যে, রণজিৎদার নানান টুকরো চিন্তা লিখে রাখার কয়েকটি ডায়েরি ছিল। সেই ডায়েরি খুব দেখতে ইচ্ছে করত, কিন্তু দেখিনি কখনও। হাঁটতে হাঁটতে রণজিৎদা মাঝে মাঝে গাছের ভাঙা বাকল বা ডাল তুলে নিতেন, পরে সেগুলিতে কিছু লিখে বা এঁকে কার্ডের মতো করে অন্য মানুষদের দিতেন।
হাঁটার শেষে অনেক সময় ফিরে এসে ইউনিভার্সিটির কোনও চায়ের দোকানে বসে আড্ডা শেষ হত। এক বার একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের চায়ের দোকানে আসতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। সব দোকানই প্রায় বন্ধ। আমরা হন্যে হয়ে চা-চাতকের মতো ঘুরছি, এমন সময় দেখি এক ফুটফুটে অল্পবয়সি অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে আমাদের দিকে চেয়ে বন্ধুত্বের হাসি হাসছে। কিন্তু তার চোখ দু’টি কেমন যেন দূরে ছড়ানো। রণজিৎদা তাকে বললেন, “তুমিও কি চায়ের দোকান খুঁজছ?”
সে বললে, “তোমরা কি ভারতীয়?” আমরা হ্যাঁ বলাতে সে বলল, “আমি শান্তি খুঁজছি। তোমরা ভারতীয়, তাই তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।” ব্যস, রণজিৎদা বললেন, বেশ তো, আমাদের সঙ্গে এসে চা খাও। সে এল। জানা গেল, সে বাড়িঘর ছেড়ে একটি ভারতীয় ধর্মপ্রতিষ্ঠানে সন্ন্যাসিনী হয়েছে। রোজ তাদের হিন্দু ধর্মের কিছু প্রাচীন গ্রন্থ পড়ানো হয়। রণজিৎদা জিজ্ঞেস করেন, “কী তোমাদের বোঝানো হয় বলো তো?” তার পর সে যা-ই বলে, রণজিৎদা আমাদের বন্ধু গৌতম ভদ্রের মতো করে মাথা নেড়ে বলেন, “ভুল, স-ব ভুল,” আর তাকে নতুন করে বোঝাতে শুরু করেন। মেয়েটির তখন রীতিমতো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা! তার চা শেষ না-করেই একটি ছুতো করে আমাদের হাত থেকে নিজেকে উদ্ধার করে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়!
রণজিৎদার সঙ্গে দু’-এক বার মনোমালিন্য হয়েছে। এক বার অভিমানটা ছিল আমার। কী একটা কারণে গোসা করে সাবঅলটার্ন স্টাডিজ় থেকে লেখা প্রত্যাহার করে নিয়েছি, কথা বন্ধ। ও মা, এক দিন দেখি আমার মতো নগণ্য এক মানুষের দরজায় রণজিৎদা। হাতে একটি বই। বইটি দিয়ে বললেন, অনেক ঝগড়া হয়েছে, এ বার ভাব করে নাও। সেই বইটি আজও আমার কাছে আছে। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের একটি সদ্যপ্রকাশিত বই, জন মলোনি রচিত, আই অ্যাম নেড কেলি।
রণজিৎ গুহর মতো সৃষ্টিশীল এক জন ইতিহাসবিদ যে আজও আমাদের মধ্যে আছেন, তা আমাদেরই বিশেষ সৌভাগ্য। আমাদের সাবঅলটার্ন গোষ্ঠীতে সকলের বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মনের দিক থেকে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে তরুণ। তাঁর দীর্ঘ জীবনে নিজেকে বার বার ভেঙে তৈরি করেছেন তিনি। জিজ্ঞাসার যে কোনও শেষ নেই, তাঁর জীবন যেন এই অনুভবেরই মূর্ত প্রকাশ।a