E-Paper

বিপদের সুযোগ, আবার

দেশের আর্থিক সমৃদ্ধির প্রকৃত চেহারাটি বোঝার জন্য যে সূচকটি তুলনায় বেশি প্রযোজ্য, সেই মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে ভারত ১০৮টি দেশের পিছনে রয়েছে।

রাজেশ্বরী সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:০৯

গত শতকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা ছিল প্রধানত উন্মুক্ত— পণ্য, পরিষেবা, মূলধন এবং শ্রম, সবই কম-বেশি অবাধে যাতায়াত করত এক দেশ থেকে অন্য দেশে। এই ব্যবস্থায় যে দেশগুলি যোগ দিয়েছিল, তাদের লাভ হয়েছিল প্রচুর। পশ্চিমি দুনিয়ার তৈরি করা এই উদার অর্থনীতিতে ভারতও যোগ দেয় ১৯৯১ সালে। এবং, বিপুল লাভবান হয়। ১৯৯১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে দু’দশকে ভারতের বৃদ্ধি হয় চার গুণ— ভারতীয় শিল্পসংস্থা, কর্মী এবং মূলধন বিশ্ববাজারের নাগাল পায়; আবার এ দেশে আসতে থাকে বিদেশি বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি। সেই যুগের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এক দিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতি, আর অন্য দিকে চিনের নিরন্তর জাতীয়তাবাদী বাণিজ্য নীতি, যা বহু ক্ষেত্রেই অন্যায্য— দুইয়ে মিলে বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী মুক্ত বাজারের ঐকমত্যকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। আজ আমরা যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছি, সেটা সাময়িক সমস্যা নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার এক কাঠামোগত পরিবর্তন। একটি নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তার দুই স্তম্ভ আমেরিকা এবং চিন— হয় এই বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার প্রতি নেতিবাচক অবস্থান নিচ্ছে, অথবা তাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। এই মুহূর্তে ভারতের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন: যে অর্থকাঠামোর দৌলতে ভারতের দ্রুত আর্থিক উন্নতি ঘটেছিল, সেটিই যখন ভেঙে পড়ছে, তখন দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করার উপায় কী?

ভারতের অর্থনৈতিক যাত্রাপথে এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ মোড়। জিডিপির অঙ্ক বলবে যে, ভারত বিশ্বের দ্রুততম বৃদ্ধির হারসম্পন্ন অর্থব্যবস্থা— কিন্তু সে হিসাব মোট জিডিপির। দেশের আর্থিক সমৃদ্ধির প্রকৃত চেহারাটি বোঝার জন্য যে সূচকটি তুলনায় বেশি প্রযোজ্য, সেই মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে ভারত ১০৮টি দেশের পিছনে রয়েছে। এই ব্যবধান দূর করার কাজটি কখনও সহজ নয়— আর, বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থায় এখন যে টালমাটাল পরিস্থিতি চলছে, তাতে কাজটি আরও কঠিন হয়েছে। সেই কঠিন পরিস্থিতির একটি প্রতীক হল ভারতীয় রফতানির উপরে আমেরিকায় ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ। ভারতের নীতিনির্ধারকদের এই বাস্তবের কথা মাথায় রেখে চলতে হবে; স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যে দৃষ্টি আবদ্ধ না রেখে সাহসী ও নির্ণায়ক নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে এক দিকে অভ্যন্তরীণ অর্থব্যবস্থা মজবুত হয়, আর অন্য দিকে বিশ্ববাজারের প্রতিকূল আবহাওয়ার মুখোমুখি হওয়া যায়।

প্রথম কথা হল, এই মুহূর্তে অর্থব্যবস্থার দরজা-জানালা বন্ধ করে অন্তর্মুখী হওয়ার প্রবণতাটিকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। ভারতের প্রাক্‌-১৯৯১ অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট যে, রক্ষণশীল আর্থিক নীতি বৃদ্ধির পক্ষে ক্ষতিকর। অর্থব্যবস্থার দরজা বন্ধ করে আজ অবধি কোনও দেশের উন্নতি হয়নি। কাজেই এই মুহূর্তে এমনকি যদি আমেরিকাও রক্ষণশীল নীতির পথে হাঁটে, ভারতের সে ভুল করলে চলবে না।

ভারতের কর্তব্য, তার বাণিজ্য নীতিতে একটি বড় মাপের পরিবর্তন সাধন। এই মুহূর্তে যদি ওয়াশিংটন এবং বেজিং বাণিজ্যসঙ্গী হিসাবে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য না হয়, তবে নয়াদিল্লির কর্তব্য অন্য দিকে তাকানো— ‘ওইসিডি এক্স-ইউএস’এর দিকে। অর্থাৎ, আমেরিকা বাদে অন্যান্য উন্নত অর্থব্যবস্থা, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ। এই উন্নত দেশগুলি এখনও পুরনো উদার, নিয়ম-ভিত্তিক, প্রতিষ্ঠান-নির্ভর বাণিজ্যিক সম্পর্কে বিশ্বাস করে, কোনও এক জন নেতার মর্জি অনুসারে বাণিজ্য চালায় না। তাইওয়ানের মতো সমমনস্ক গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গেও বাণিজ্যসম্পর্কে উন্নতি প্রয়োজন।

এই দেশগুলির সঙ্গে ভারত গভীর বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে— দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে, এবং দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তির মাধ্যমে। সম্প্রতি ভারত ব্রিটেনের সঙ্গে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, সেটি ঠিক পদক্ষেপ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তিও দ্রুত সেরে ফেলা দরকার। কিন্তু, এ সবই সূচনা, অন্তিম লক্ষ্য নয়। অন্য দিকে, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গেও ভারতের আরও গভীর ভাবে সংযুক্ত হওয়া প্রয়োজন, যাতে ভারত বৈশ্বিক জোগান-শৃঙ্খলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারে। ট্রান্স-প্যাসিফিক এগ্রিমেন্ট থেকে আমেরিকা বিদায় নেওয়ার পর এগারোটি দেশের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রগ্রেসিভ এগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ-এর (সিপিটিপিপি) মতো বহুজাতিক কাঠামোর অঙ্গ হওয়া ভারতের পক্ষে ইতিবাচক পদক্ষেপ হবে— বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় নিজের জায়গা নিশ্চিত করার এটাই পথ।

ভারতীয় অর্থব্যবস্থার আয়তন চার লক্ষ কোটি আমেরিকান ডলারে পৌঁছতে পারে, কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেটা বিশ্বের মোট অর্থনৈতিক উৎপাদনের মাত্র ৪ শতাংশ— এবং, বৈশ্বিক পণ্য রফতানিতে ভারতের অবদান মাত্র ২ শতাংশ। ভারতের রফতানির পরিমাণ যদি আগামী পাঁচ বছরে এক শতাংশ-বিন্দুও বাড়ে, তা হলে তা এ দেশের আর্থিক বৃদ্ধির পক্ষে অতি গুরুত্বপূর্ণ হবে।

কিন্তু, এ পথে হাঁটতে গেলে ভারতকে আর্থিক রক্ষণশীলতা ছাড়তে হবে। ২০১৪ সাল থেকে ভারতে আর্থিক রক্ষণশীলতা বেড়েছে। গড় আমদানি শুল্ক দ্বিগুণ হয়েছে— ২০১৩ সালের ৬ শতাংশ থেকে ২০২৩-এ ১২%। এখন এশীয় দেশগুলির মধ্যে ভারতের আমদানি শুল্ক অন্যতম চড়া। অর্থপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হলে ভারতকে আমদানি শুল্ক কমাতে হবে, শুল্ক-বহির্ভূত অন্যান্য বাধা দূর করতে হবে, এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রকৃত উদার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে।

একই সঙ্গে তাকাতে হবে অভ্যন্তরীণ নীতিকাঠামোর দিকেও। জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালালে চলবে না— দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে গভীর, কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। ভারতে এক দিকে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা এবং অতিনিয়ন্ত্রণের ঐতিহ্য রয়েছে, আর অন্য দিকে রয়েছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্বলতা— এর থেকে বেরিয়ে এমন একটি নীতিকাঠামো তৈরি করতে হবে, যাতে বাছাই করা বাণিজ্যসঙ্গীদের সঙ্গে সম্মিলিত ভাবে কাজ করা সহজ হয়। তার জন্য দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব প্রয়োজন, বিশ্ব-বাণিজ্য সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল কর্মীর প্রয়োজন। শিক্ষাজগতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। ভারতে এমন সংস্থা প্রয়োজন, যা বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে সক্ষম। তেমন সংস্থার জন্য আবার লাল ফিতের ফাঁস কাটাতে হবে, নিয়মকানুনকে সরল করতে হবে, বিচারব্যবস্থাকে মজবুততর করতে হবে, এবং বাহ্যিক পরিকাঠামোর পাশাপাশি মানবসম্পদ নির্মাণেও জোর দিতে হবে। জিএসটির হার কমানোর মতো সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপ জরুরি, কিন্তু যথেষ্ট নয়। গোটা ব্যবস্থাটি কী ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সাফল্য শেষ পর্যন্ত তার উপরেই নির্ভর করবে।

এর পাশাপাশি ভারতকে সতর্ক থাকতে হবে, যেন কোনও আমেরিকা-বিরোধী অবস্থান না নেওয়া হয়। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপড়েন থাকেই; কিন্তু আমেরিকার মতো অতিবৃহৎ অর্থনৈতিক সঙ্গীকে অবজ্ঞা করার সামর্থ্য ভারতের নেই। এই দুই অর্থব্যবস্থা পরস্পরের সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িত— আমেরিকায় কর্মরত প্রবাসী ভারতীয়দের মাধ্যমে, সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পাঠরত ভারতীয় ছাত্রদের মাধ্যমে, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির গতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমেরিকান প্রযুক্তির ভূমিকায়, ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় আমেরিকান বিনিয়োগে, এবং ভারতের আর্থিক ক্ষেত্র ও পরিষেবা রফতানিতে আমেরিকার ভূমিকায়। কোভিড-পরবর্তী পর্যায়ে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার পুনরুত্থানের পিছনে পরিষেবা রফতানির ভূমিকা বিপুল— ভারতের ১৭০০-র বেশি গ্লোবাল কেপেবিলিটি সেন্টারের ৬০ শতাংশেরও বেশি সদর দফতর আমেরিকায়। এগুলির উপরে সরাসরি শুল্কের প্রভাব হয়তো পড়ছে না, কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খারাপ হলে সংস্থাগুলি হয়তো ভারতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইতস্তত করবে, ফলে ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় বিপুল ধাক্কা লাগবে।

ভেবে দেখলে, আজকের পরিস্থিতিটি ১৯৯১ সালের মতোই— এ বার সঙ্কটটি হয়তো তুলনায় কম দৃশ্যমান, কিন্তু এ বারও ঝুঁকি সমান। অর্থব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে, এবং আজ যে নীতি নির্ধারিত হবে— বিশেষত, বিশ্বায়নের এই নতুন পর্যায়ে, তা আগামী বহু দশকের জন্য ভারতীয় অর্থব্যবস্থার কক্ষপথ নির্ধারণ করে দেবে। সামনে সুযোগ অনেক, কিন্তু ভুল করার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন সুচিন্তিত হয়।

অর্থনীতি বিভাগ, ইন্দিরা গান্ধী ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট রিসার্চ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

america China trade India Economic Growth

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy