Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
Growth of Indian Economy

চলতি আর্থিক বছর ফুরিয়ে এল, আগামী অর্থবর্ষে দেশে বৃদ্ধির হার কি আশাপ্রদ হবে?

দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গথি শ্লথ। কী কাজ করছে এই ধীর গতির পিছনে? আগামী আর্থিক বছরে কি কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে?

অর্থনীতির ভাষ্যকারদের বেশির ভাগই একমত যে, এই বছর বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের নীচে থাকবে।

অর্থনীতির ভাষ্যকারদের বেশির ভাগই একমত যে, এই বছর বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের নীচে থাকবে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১১:৫৬
Share: Save:

নতুন বছর শুরু হতে না হতেই অর্থনীতির ভাষ্যকাররা অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ব্যাপারে চলতি আর্থিক বছরের থেকে তাঁদের নজর ঘুরিয়েছেন পরবর্তী অর্থবর্ষের দিকে। তাঁদের বেশির ভাগই একমত যে, এই বছর বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের নীচে থাকবে। এ বিষয়ে বাস্তব পর্যালোচনা বা পূর্বাভাসের বিষয়টি অত্যন্ত গুরত্বপুর্ণ। কেন না, আর এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বাজেট পেশ করা হবে। এবং বাজেটের প্রকল্পে এই পূর্বাভাস গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে। আগের আভাসগুলি, বিশেষ করে সরকারের মুখপাত্রদের দেওয়া আভাসগুলি অনেকাংশেই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলা হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রথম দফার কালে দুই অঙ্কের বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি বার বার দেওয়া হয়েছিল। এমনকি মোদী সরকারের দ্বিতীয় দফার শাসনের প্রথম বছরে, অর্থাৎ ২০১৯-২০ সালে তৎকালীন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু সেই অর্থবর্ষ শেষ হয়েছিল মাত্র ৪ শতাংশ বৃদ্ধির হারের মধ্যেই।

তার পরে শুরু হয় ভারতীয় অর্থনীতি কবে ৫ ট্রিলিয়ন (৫ লক্ষ কোটি) আমেরিকান ডলারের সীমা স্পর্শ করতে পারবে, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণীর ঢল। এর জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যবর্ষ প্রথমে ২০২২-২৩ থেকে পিছিয়ে ২০২৪-২৫ করা হয়, এখন তা আবার পিছিয়ে গিয়েছে ২০২৬-২৭ সালে। কোভিড অতিমারির ধস নামা দু’টি বছরকে মাথায় রেখেও বলা যায়, এমন ভাবে লক্ষ্যবর্ষ পিছিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অর্থনীতির পূর্বাভাস নামক বিষয়টিকেই রীতিমতো প্রশ্নের সামনে ফেলে দেয়। তার পরে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (আইএমএফ) লক্ষ্যে পৌঁছনোর তারিখকে নির্ধারণ করে দেয়। গত অক্টোবর মাস নাগাদ স্থির হয়, ২০২৬-২৭ অর্থবর্ষে ৪.৯৫ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলারে নিয়ে যেতে হবে। যেখানে চলতি অর্থবর্ষে তা ৩.৪৭ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার।

উপরের পরিসংখ্যান থেকে যদি কেউ মধ্যবর্তী ৪ বছরে ৪২ শতাংশ বৃদ্ধির কথা ভেবে নেন, তবে তিনি ভুল করবেন। কারণ এই পরিসংখ্যান ডলারের সাম্প্রতিক মানের নিরিখে নির্ধারিত, যার মধ্যে মুদ্রস্ফীতির বিষয়টিও রয়েছে। ২০২২ সালে আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতির হার ৭ শতাংশ। যদিও আমেরিকান ডলারের তুলনায় ভারতীয় টাকার মূল্যমান হ্রাস পেয়েছে ১১ শতাংশ। সেই কারণেই যখন অর্থনীতির প্রকৃত বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের নীচে, তখন ভারতীয় টাকায় বৃদ্ধি মেরেকেটে ১৪-১৫ শতাংশ। উল্টো দিকে আইএমএফ গত অক্টোবরে ডলারের বৃদ্ধির ন্যূনতম মাত্রা ৯ শতাংশ হিসাবেই দেখেছে। এখন যদি কেউ ডলারের নিক্তিতে বিষয়টির বিচার করতে চান, তবে তাঁকে ভারতীয় নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক আয় উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ভাবতে হবে, যা প্রায় ৪ হাজার আমেরিকান ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৩ লক্ষ ২৯ হাজার টাকা)।

এই হিসাবের উপর দাঁড়িয়েই বর্তমান মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টাদের এক জনের প্রত্যাশা, এই দশকের বাকি সময়ে গড়পড়তায় ৬.৫ শতাংশ বৃদ্ধির হার থাকবে। এই প্রত্যাশা আগাগোড়া বাস্তবসম্মত। কারণ, ইতিমধ্যেই ১৯৯২-৯৩ অর্থবর্ষ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের এই আঠাশ বছরে ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশ। এই গতিরই অন্তিম ভাগে অতিমারি হানা দেয়। সে ভাবে দেখলে, সার্বিক অর্থে বৃদ্ধির হার সাম্প্রতিক সময়ে বাড়তির দিকেই হওয়া উচিত ছিল। কেন না, এই মুহূর্তে অর্থনীতির দ্রুততম গতিছন্দের ক্ষেত্র (পরিষেবা) ক্রমেই বেড়ে চলেছে, যেখানে সব থেকে শ্লথ গতির ক্ষেত্র (কৃষি) অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সব থেকে কম অংশ জুড়ে রয়েছে। ৩ দশক আগে দেশের অর্থনীতিতে কৃষির অংশ ছিল মোট ৪০ শতাংশ। এখন তা নেমে এসেছে ১৭ শতাংশে।

যদি অর্থনীতিই এই পরিকাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে তার বৃদ্ধির গতিকে বাড়াতে না পারে, যদি উন্নততর আর্থিক পরিকাঠামো ও ডিজিটালাইজ়েশনের সুবিধাগুলি না নিতে পারে, তবে বুঝতে হবে, এর পিছনে কারণ হিসাবে কাজ করছে সঞ্চয়ের অঙ্কে পতন এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিপুল অধোগতি। আরও নিবিড় ভাবে দেখলে এর অন্যতম কারণ, সরকারি ঋণ ও মোট দেশজ উৎপাদনের অতিরিক্ত বেশি ফারাক-যুক্ত অনুপাত এবং কর্মনিযুক্ত জনসংখ্যার সঙ্গে মোট জনসংখ্যার অনুপাতের সঙ্কীর্ণ গণিত। এই সব বিষয় না ঘটলে বার্ষিক বৃদ্ধির হার স্থায়ী ভাবে ৭ শতাংশের গণ্ডি পেরিয়ে যেত নিশ্চিত।

নীতি নির্ধারণ অবশ্যই পরিবর্তন আনতে পারে। সে দিক থেকে দেখলে কর্মনিযুক্তির বিষয়টি সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার মতো বিষয়ও এই ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব এ দেশে বড়ই প্রকট। ভিয়েতনামের মতো দেশের পাশেও এ ক্ষেত্রে ভারত দাঁড়াতে পারে না। অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলি আন্তর্জাতিক অর্থনীতির মূল্যমান-শৃঙ্খলার সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত। সেই সব দেশে শুল্কের হার কম এবং ব্যবসার পরিবেশও অনেক বেশি ভাল। তুলনায় ভারতে শুল্ক-প্রাচীর দিন দিন উঁচু হচ্ছে এবং আঞ্চলিক স্তরে বাণিজ্যের বন্দোবস্তের উন্নতির জন্য তেমন কোনও উদ্যোগ এখানে চোখে পড়ছে না। বৃদ্ধির জন্য দেশজ উপকরণের উপর বেশি মাত্রায় নির্ভরতা ভারতকে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আগত গতিছন্দের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধা দেবে।

পরিশেষে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। সেটি এই, আগামী অর্থবর্ষে কি কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে? ৬ শতাংশের থেকে বেশি বৃদ্ধির হার সম্পর্কে যে কোনও অনুমানই বর্তমান গতির চাইতে সামান্য হলেও গুরত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়। এমন যে ঘটতে পারে না, তা নয়। তবে এমন ঘটার পথে রাজকোষ-ঘটিত এবং আর্থিক নীতি নির্ধারণগত কিছু বিষয় একযোগে কাজ করে। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্রের বৈষম্যগুলির প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। যেমন, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ঘাটতি (অর্থাৎ পণ্য ও পরিষেবার রফতানির চাইতে আমদানি কতটা বেশি), রাজকোষ ঘাটতি এবং সর্বোপরি আর্থিক ঘাটতি ও মুদ্রাস্ফীতি। এই সব কিছুই খুব স্বস্তিদায়ক অবস্থায় নেই। এমন ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগকারী এবং ভোক্তাদের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে। এই সব ঘাটতি পূরণের প্রচেষ্টার গতিছন্দ কেমন হবে, বলা মুশকিল। তবে, অর্থমন্ত্রী তাঁর ‘আন্ডার-বাজেটিং’ (পরিকল্পিত পরিমাণের চাইতে কম অর্থ অনুমোদনের বাজেট)-এর নীতি অব্যাহত রাখলে ভালই করবেন। এতে অর্থবর্ষের শেষে কিছু লাভ হলেও হতে পারে বলে আশা করা যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Economy Economic Growth Budget
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE