ইয়াস ঝড়ের সময় একটি ছবি সমাজমাধ্যমে দ্রুতবেগে ছড়িয়েছিল— সুন্দরবনের ঘোড়ামারা দ্বীপের পঞ্চায়েত প্রধান নিজেই বাড়ির চালে বসে বাঁচার চেষ্টা করছেন! কলকাতার ২৩ সেপ্টেম্বরের আকাশভাঙা, নিয়মমাফিক না হলেও আক্ষরিক অর্থে তো বটেই, বৃষ্টির পর দেখা গেল ঘোড়ামারা আর কলকাতায় বিশেষ তফাত নেই; স্বয়ং মহানাগরিককে রাস্তায় নেমে নালার ময়লা পরিষ্কার করতে হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি সামলাতে।
গত দুই দিনের বিপর্যয় কলকাতার প্রতিটি মানুষকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বুঝিয়েছে ক্রমশ বেড়ে চলা প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে থেকে রক্ষা পেতে এখনই প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা; প্রশাসনিক স্তরে তো বটেই, এমনকি ব্যক্তিগত স্তরেও। এটা বেঁচে থাকার প্রশ্ন। এক বন্ধু ও বন্ধুপত্নী ২২ তারিখের রাতে আগাম ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে আর এক বন্ধুর বাড়িতে আটকে পড়েছিল প্রায় তিরিশ ঘণ্টা। বানভাসি বস্তির নিম্নবিত্তের পাশাপাশি জলবন্দি উচ্চবিত্তদের নিশ্চয়ই ভাবতে হবে যে, আগামী সময়ে এমন পরিস্থিতি হলে তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলো জল ছাড়া কেমন ভাবে লড়বেন। যাঁরা একতলায় থাকেন, শোওয়ার ঘরে নদীর জলের মতো স্রোত দেখতে দেখতে চিন্তা করেছেন যে কলকাতায় কি আর একতলায় থাকা যাবে? প্রশ্ন উঠছে, যদি তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতেই এমন যাই যাই অবস্থা হয়, তবে বিজ্ঞানীদের অঙ্ক মিলিয়ে যদি আগামী দিনে এমন বৃষ্টির পাশাপাশি মারাত্মক সাইক্লোন হয়, আমাদের তিলোত্তমার ভবিষ্যৎ কী? এ বারের নামহীন নিম্নচাপ বোঝাল যে অনেক হয়েছে, এ বার দয়া করে বিশেষজ্ঞদের দেওয়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে সামলানোর প্রেসক্রিপশন মেনে কাজ শুরু করুন; নয়তো আগামী দিনে ইতিহাস আপনাদের, মানে রাজনীতিকদের, এই শহরের হত্যাকারী হিসাবে চিহ্নিত করবে।
এমন ভবিষ্যদ্বাণী কিন্তু ছিলই। আমরা তাকে জরুরি বলে মনে করিনি। বাম আমলে বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি রিপোর্ট বলেছিল যে, ‘দ্রুত’ শহরের নিকাশি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করতে না পারলে হয়তো শহরের অংশবিশেষকে পনেরো দিন একটানা জলের তলায় থাকতে হবে। তার পর কিছু কাজ হলেও তা সিন্ধুতে বিন্দুমাত্র— ‘পনেরো দিন’ লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে আর বিশেষ দেরি নেই। আজ থেকে বহু বছর আগে জল জমার পিছনে প্লাস্টিক থেকে পলি জমার যে যুক্তি তৎকালীন পুরসভার মেয়র পরিষদের কাছে শুনেছিলাম, স্থান, কাল, পাত্র ও দল পাল্টালেও আজকেও যেন তারই প্রতিধ্বনি। আজও তাই মহানাগরিককে নালার মুখের প্লাস্টিক সরাতে হয়, তাঁকে ও মুখ্যমন্ত্রীকে মানতে হয় যে জল বেরোনোর খালগুলো কানায় কানায় ভর্তি, জল বেরোনোর বদলে উল্টে খালের জল কলকাতায় ঢুকছে। শুনেছিলাম, এক সময় লোকসভায় দেশের উন্নতি হচ্ছে বলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দাবি করাতে, লোকসভা সাংসদ ও বিখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ঠিক, উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু অন্যরা রেলের গতিতে যাচ্ছে, আর আমাদের দেশের উন্নতি হচ্ছে গরুর গাড়ির গতিতে, তাই চোখে পড়ছে না!
আন্তর্জাতিক রিপোর্ট বলছে যে, মোট বৃষ্টির মাত্রা খুব একটা না বাড়লেও এক দিনের মধ্যে অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা কলকাতায় আগামী দিনে পঞ্চাশ শতাংশ বাড়বে। বাড়বে অত্যন্ত তীব্র ঝড়ের সংখ্যা। বছরের প্রতি দু’দিনের মধ্যে এক দিনের তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি ছাড়াবে। বাড়বে জলোচ্ছ্বাস। বস্তুত কলকাতা শহর শাংহাই বা মুম্বইকে ছাড়িয়ে এশিয়ার মধ্যে অন্যতম ‘জলবায়ু-বিপন্ন’ শহর হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। মনে রাখতে হবে বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবন কাছাকাছি হওয়ার দরুন কলকাতার যেমন স্থানগত বিপন্নতা আছে, তেমনই এক পাশে গঙ্গা আর অন্য দিকে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি থাকার দরুন এ শহরের স্থানগত সুবিধাও আছে— যাকে পরিবেশবিদ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ বলতেন শহরের ‘পরিবেশগত ভর্তুকি’।
এই ভর্তুকিকে আমরা আদৌ কি সঠিক ভাবে ব্যবহার করছি? উত্তর— না। ই এম বাইপাস করে আমরা কলকাতা থেকে জল স্বাভাবিক ভাবে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছি। বিষফোড়ার মতো তাতে জুটেছে, বাম তৃণমূল সব আমলেই লাগামছাড়া বেআইনি বাড়ি তৈরি। আদি-অনাদি সব গঙ্গাই কখনও মেট্রো রেলের রাস্তা, কখনও অন্য কারণে গঙ্গাপ্রাপ্ত। তালিকার শেষ নেই ।
সম্প্রতি কলকাতা পুরসভা মেয়রের নেতৃত্বে গোটা দেশের বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে শহরের জন্য একটি জলবায়ু পরিকল্পনা তৈরি করেছে। সম্প্রতি তার একটি খসড়া জনসমক্ষে এসেছে। সেই খসড়ায় বিস্তারিত ভাবে উঠে এসেছে জল জমা আটকানো থেকে শুরু করে, সাইক্লোন সামলানো, সব বিষয়ে আশু এবং দীর্ঘমেয়াদি স্তরে কী কী করা উচিত। প্রয়োজন— দ্রুত সেই খসড়াকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক সদিচ্ছা সামনে এনে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় তার রূপায়ণ। আগামী কলকাতা পুরসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলি জলবায়ু বিপন্নতা ও বায়ুদূষণের মতো বিষয়গুলিকে সামনে আনুন— দয়া করে শহরটাকে বাঁচান। না হলে সে দিন আর বেশি দূরে নেই, যখন কলকাতার মহানাগরিককেও ঘোড়ামারার মতোই বাড়ির ছাদে বসে জীবনরক্ষা করতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)