শান্তিনিকেতনে প্রথম মুসলমান ছাত্র সৈয়দ মুজতবা আলি যে বছর ভর্তি হলেন, সেই ১৯২০ সালেই মহাত্মা গান্ধী আসেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ তখন বিদেশে। জরুরি কাজে আলি ভ্রাতাদের এক জন শওকত আলি এলেন আশ্রমে, এক দিনের জন্য। তখন পর্যন্ত আশ্রমের কিচেনে কোনও অ-হিন্দু খাননি। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী রীতি ভেঙে শওকতকে কিচেনে নিয়ে গিয়ে খাওয়ান। দীনবন্ধু এন্ডরুজ় রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন, আশ্রমের কিচেনে ব্রাহ্মণদের জন্য পৃথক পঙ্ক্তির রীতি আর টিকে রইল না। এর নয় বছর আগে মুসলিম পরিবারের একটি ছেলেকে তার বাবার আগ্রহ সত্ত্বেও ব্রহ্মবিদ্যালয়ে ভর্তি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গভীর উদ্বেগে আশ্রমের শিক্ষক নেপালচন্দ্র রায়কে তিনি লিখেছিলেন, “এক সঙ্গে হিন্দু মুসলমান কি একই শ্রেণিতে পড়িতে কিম্বা একই ক্ষেত্রে খেলা করিতে পারে না?... প্রাচীন তপোবনে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খাইত, আধুনিক তপোবনে যদি হিন্দু-মুসলমানে একত্রে জল না খায় তবে আমাদের সমস্ত তপস্যাই মিথ্যা।”
শওকত আলিকে আশ্রমের কিচেনে খেতে দেওয়ায় কয়েকজন ক্ষুব্ধ অভিভাবক তাঁদের ছেলেদের আশ্রম থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। আমাদের মনে পড়ে, এ ঘটনার ছয় বছর আগে ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “হিন্দু মুসলমানের পার্থক্যটাকে আমাদের সমাজে আমরা এতই কুশ্রীভাবে বেআব্রু করিয়া রাখিয়াছি যে, কিছুকাল পূর্বে স্বদেশী অভিযানের দিনে একজন হিন্দু স্বদেশীপ্রচারক এক গ্লাস জল খাইবেন বলিয়া তাঁহার মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া হইতে নামিয়া যাইতে বলিতে কিছুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করেন নাই।” উন্মোচিত করেন এক রাজনৈতিক দ্বিচলন: ভাষায়, আচরণে, রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে সংখ্যালঘুকে আলাদা ভাবে দাগিয়ে দেওয়া, সমাজমনে গেঁথে যাওয়া এক অপরায়নের অভ্যাস।
বিভাজনের এই লক্ষ্মণরেখা মোছার লড়াই রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন আরও আগে, শিলাইদহের কাছারিবাড়িতে ঠাকুরবাড়ির জমিদার হিসেবে প্রথম এসে পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে হিন্দু-মুসলমানের, এমনকি হিন্দু প্রজাদের মধ্যেও ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ উঁচু-নিচু আসনের ব্যবস্থা তুলে দিয়ে। নায়েব-গোমস্তাদের প্রবল প্রতিরোধের সামনে নতুন বাবুমশাইয়ের আহ্বানে প্রজার দল এক সঙ্গে মেঝেতে ফরাসে বসে পড়লেন, মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ।
‘দেশ’ বলতে আজীবন তিনি বুঝতেন দেশের মানুষকে, ‘ধর্ম’ বলতে মানুষের ধর্মকে। অথচ নিবিড় ভাবেই সকল ধর্মের ভিতরের সত্যকে পাঠ করেছেন তিনি। ১৯৩৪ সালে হজরত মহম্মদের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর একটি বার্তা রেডিয়োতে সম্প্রচারিত হয়। তিনি লিখলেন, “ইসলাম পৃথিবীর মহত্তম ধর্মের মধ্যে একটি। এই কারণে তাঁর অনুবর্তীগণের দায়িত্ব অসীম, যেহেতু আপন জীবনে এই ধর্মের মহত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁদের সাক্ষ্য দিতে হবে।”
দেশপ্রেমের উন্মাদনার আড়ালে দেশবাসীর মধ্যে গভীর অনৈক্য, গোপন হিংসার ইশারা দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হিন্দু-মুসলমান উভয়কেই তিনি তাই মনে করিয়ে দেন তাঁদের নিজস্ব ধর্মের গভীর বাণী। গোঁড়া হিন্দুয়ানির বিরুদ্ধে বার বার কলম ধরছেন গল্প উপন্যাস কবিতা প্রবন্ধে, আবার মুসলমান সমাজকেও বলছেন, “পবিত্র পয়গম্বরের প্রদর্শিত পথ যাঁরা অনুসরণ করছেন, আধুনিক ভারতবর্ষের সুসভ্য ইতিহাস রচনা করে তাঁরা যেন জীবন সম্পর্কে তাঁদের গভীর আস্থা এবং পয়গম্বরের প্রদত্ত শিক্ষাকে যথাযথ মর্যাদা দেন।... এমনভাবে ইতিহাসকে গড়ে তোলেন যাতে আমাদের জাতীয় জীবনে শান্তি ও পারস্পরিক শুভেচ্ছার বাতাবরণটি অটুট থেকে যায়।” (দিল্লির জামা মসজিদ প্রকাশিত ‘পয়গম্বর’ সংখ্যার জন্য ১৯৩৬-এ পাঠানো শুভেচ্ছাবার্তা)। ১৯২৬-এ যখন বাংলার রাজনীতিতে ভাষিক মৌলবাদ মাথাচাড়া দেয়, মুসলমানদের মধ্যে এক দল বলেন উর্দুই তাঁদের নিজস্ব ভাষা, রবীন্দ্রনাথ সিউড়িতে এক সভায় বলেন, “চীনে মুসলমানের সংখ্যা যথেষ্ট। কিন্তু সেখানে আজ পর্যন্ত কেউ এমন কথা বলেন নি যে চীনা ভাষা না ছাড়লে তাঁদের মুসলমানত্ব খর্ব হবে।” বলেন, “হিন্দু মুসলমানকে যাঁরা কৃত্রিম বেড়া তুলে আলাদা রাখার চেষ্টা করছেন, তাঁরা মুসলমানেরও বন্ধু নন।”
ঠাকুরবাড়িতে কিশোর রবির পোশাকে গলাবন্ধ কুর্তা, চাপকান, মখমলি টুপি, মুসলমান ঘরানার সাজ-প্রভাব এসেছে। শান্তিনিকেতনে আশ্রমজীবনে রবীন্দ্রনাথ উচ্চবর্ণের হিন্দু ভদ্রলোকের পোশাকের মান্য রূপটি ভেঙে ফকির সুফিদের মতো আলখাল্লা বা জোব্বা পরছেন, কালো সিল্কের লুঙ্গি ও পার্সি টুপি পরে মেলার মাঠে বেড়াচ্ছেন এমন এক সময়ে, যখন বাঙালি হিন্দু গেরস্তবাড়ির পুরুষের কাছে লুঙ্গি-পাজামা প্রায় অস্পৃশ্য। ব্রাহ্ম সংস্কৃতিতে গানে মৃদঙ্গ-পাখোয়াজের আদর, তবলা অনাদৃত, হয়তো বাইজিদের ঘরের বাজনা বলে। কিন্তু ১৯৩৭-এ আশ্রমে শ্যামা নৃত্যনাট্য তৈরির সময় উত্তর ভারতের ছাত্রী আশা ওঝার নৃত্যনির্মাণে কত্থকের ব্যবহার হবে বলে রবীন্দ্রনাথ লখনউ থেকে তবলিয়া আনছেন। উদয়ন বাড়িতে গেদু মিঞাকে পাচক হিসেবে নিয়োগ করে তাঁকে বলছেন, “কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি, তুই বাঙালি, রবীন্দ্রনাথের ধর্মই তোর ধর্ম।” আজ যখন রাষ্ট্রের ধর্ম ও ভাষা প্রতিষ্ঠার রাজনীতি পেশি ফোলাচ্ছে, তখন আমরাও যেন বলতে পারি, আমরা বাঙালি, রবীন্দ্রনাথের ধর্মই আমাদের ধর্ম।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)