ভারতের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইআইটি-গুলিতে ২০১৯ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত মোট ৩৭ জন পিএইচ ডি গবেষক আত্মহত্যা করেছেন। শুধু ২০২৫ সালেই সংখ্যাটি ১১। কলকাতার অদূরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটস অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার)-এর ল্যাবে ২০২২-এ নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন এক তরুণ গবেষক; মাত্র কয়েক দিন আগে এখানেই আত্মঘাতী হলেন আর এক গবেষক। এই মৃত্যুগুলো কেবল ব্যক্তিগত দুর্বলতার চিহ্ন নয়; এগুলো গোটা উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থার এক গভীর অসুখের লক্ষণ।
বড় মাপের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পিএইচ ডি স্তরের গবেষণা ইচ্ছা করলেই শুরু করা যায় না। তার জন্য প্রথম ধাপ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দ্বারা পরিচালিত ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট (নেট)-এর মতো সর্বভারতীয় পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়া। কিছু প্রতিষ্ঠানে এর বাইরেও থাকতে পারে লিখিত পরীক্ষা ও ইন্টারভিউ। এত কিছুর পরে নির্বাচিত হলে শুরুতে জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ বা জেআরএফ-বাবদ জোটে মাসে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার মতো একটি গবেষণা ভাতা; সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপে টাকার এই অঙ্কটা বাড়ে আরও হাজার পাঁচেক। এই টাকার উপরে নির্ভর করে দিল্লি, বেঙ্গালুরু, বা মুম্বইয়ের মতো শহরে টিকে থাকা দুঃস্বপ্ন। ভাড়া, খাবার, যাতায়াত, বই, গবেষণার কিছু উপকরণ— সব কিছু খরচের পর হাতে প্রায় কিছুই থাকে না। যে গবেষকরা জেআরএফ-এর জন্য মনোনীত হতে পারেন না, তাঁদের সঙ্কট আরও তীব্র।
এর পর আসে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দেরিতে টাকা ঢোকা বা বিনা নোটিসেই না ঢোকা। ২০২২ সালের ইউজিসি-র তথ্য দেখায়, ফেলোশিপের টাকা গড়ে ৩-৬ মাস দেরিতে আসে অনেক প্রতিষ্ঠানেই। এর মানে, গবেষকরা প্রায়ই ধার করে বা পরিবারের থেকে টাকা নিয়ে মাস কাটান। অনেক সময় তাঁরা খাবারের খরচ কমিয়ে বা চিকিৎসকের পরামর্শ এড়িয়ে চলেন, শুধু মাসের শেষ দিনটা অবধি কোনও রকমে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য। আর মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসেন যাঁরা, তাঁদের অবস্থা হয় সবচেয়ে শোচনীয়। চাকরির নিশ্চয়তা ছেড়ে, ২৬-২৭ বছর বয়সে গবেষণায় আসা তাঁদের জন্য স্থায়ী আর্থিক অস্থিরতা। ভারতে এখনও অনেক পরিবার বোঝে না ‘কেন কেউ এত বছর লেখাপড়া করেও’ চাকরি করছে না। অভিভাবকদের অসহায়তা গবেষকদের জন্য শুধু মানসিক চাপ নয়, নিজের পছন্দ নিয়ে অপরাধবোধও তৈরি করে।
বহু ক্ষেত্রেই নতুন গবেষকরা বিবিধ অদৃশ্য র্যাগিংয়ের শিকার হন— সিনিয়র গবেষক বা ল্যাবের সহপাঠীরা ইচ্ছে করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন না; যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে বাধা দেন; গবেষণায় ভুল পথে চালিত করেন। এই পরিস্থিতি আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেয়, বাড়িয়ে তোলে অসহায় একাকিত্ব। দেখেছি, এ দেশে অনেক সুপারভাইজ়ার তাঁদের অধীনে থাকা পিএইচ ডি গবেষকদের কার্যত ক্রীতদাসের মতো ব্যবহার করেন। এই তরুণ গবেষকদের দিয়ে গবেষণাপত্র লিখিয়ে তা নিজের নামে প্রকাশ করা, সে সব পেপার দেখিয়েই গাইডের পুরস্কার, অনুদান কিংবা ফেলোশিপ লাভ করাটা আজ উচ্চ শিক্ষার জগতে একটা অত্যন্ত চেনা ছক। ২০২৩ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ৭৮% ভারতীয় পিএইচ ডি গবেষক মনে করেন যে, তাঁদের সুপারভাইজ়ারের সঙ্গে সম্পর্ক সরাসরি তাঁদের ভবিষ্যতের চাকরির সম্ভাবনা নির্ধারণ করে। এর সহজ অর্থ, সুপারিশপত্র এবং নেটওয়ার্কিং প্রায়ই দক্ষতা ও যোগ্যতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানেই সুপারভাইজ়ারের নিরঙ্কুশ শোষণ-ক্ষমতা। প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ শুধু নিখুঁত অভিনয় করে যান ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকায়।
সম্প্রতি কিছু প্রতিষ্ঠানে নতুন নীতি চালু হয়েছে— পিএইচ ডি শিক্ষার্থীদের প্রতি সিমেস্টারে অন্তত একটি পেপার প্রকাশ করতে হবে। না পারলে তাঁদের মাসিক ভাতাতে কোপ তো পড়বেই, উপরন্তু সংশ্লিষ্ট ডক্টরাল কমিটি যাচাই করে দেখবে যে, এঁরা ওই প্রতিষ্ঠানে আর থাকার যোগ্য কি না। গবেষণাপত্র প্রকাশ অবশ্যই অ্যাকাডেমিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু গবেষণার প্রকৃতি ক্ষেত্রভেদে এবং প্রোজেক্টভেদে বহুলাংশে আলাদা হতে পারে। কিছু গবেষণায় এক সিমেস্টারে বড়সড় ডেটা বা ফলাফল পাওয়া সম্ভব হলেও, অনেক ক্ষেত্রে কেবল তথ্য সংগ্রহ বা প্রাথমিক পরীক্ষা করতেই বছর ঘুরে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতে, এক সিমেস্টারে একটি পেপার প্রকাশের বাধ্যবাধকতা শুধু অবাস্তব নয়, মারাত্মক মানসিক চাপের উৎস। মুক্তচিন্তার বিজ্ঞানমনস্ক গবেষকের বদলে ‘পাবলিশ অর পেরিশ’ সংস্কৃতির বুলডোজ়ার চালিয়ে আমরা কি তবে উৎকর্ষের শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রগুলোতে বহাল করতে চাই এক দল মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত রোবটকে?
এই চাপ গবেষকদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ তৈরি করে। অসুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ এবং গাইডের অসহযোগিতা এই চাপকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ভারতে পরিচালিত একাধিক সাম্প্রতিক সমীক্ষা দেখিয়েছে যে, পিএইচ ডি শিক্ষার্থীরা সাধারণ মানুষের তুলনায় ছ’গুণ বেশি উদ্বেগ ও বিষণ্ণতায় ভোগেন। কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই পর্যাপ্ত মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ব্যবস্থা নেই, অধ্যাপকদের মধ্যেও নেই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা। এই পরিস্থিতি শুধু শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনে নয়, গবেষণার মানেও মারাত্মক প্রভাব ফেলে, হয়ে ওঠে আমাদের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এক বিপদসঙ্কেত।
ব্যতিক্রম কি নেই? এখনও এমন অনেক অধ্যাপক আছেন এই দেশে, যাঁরা শিক্ষার্থীর শুধু গাইড নন, বরং সত্যিকারের বন্ধু ও পরামর্শদাতা। ল্যাবের পরিবেশকে এঁরা পরিবারে পরিণত করেন, যেখানে ভয় নয়, বিশ্বাস আর সহানুভূতি দিয়ে গবেষণা এগিয়ে চলে। কিন্তু এগুলো নেহাত ব্যতিক্রম, নিয়ম নয়।
পিএইচ ডি গবেষকদের জন্য ভাল ও সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এখনই দরকার। প্রথমেই, গবেষণার অগ্রগতি যাচাই করার পদ্ধতিটা নমনীয় করতে হবে। এখন অনেক জায়গায় নিয়ম আছে যে, প্রতি ছ’মাসে বা বছরে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করতেই হবে। সব বিষয়ের গবেষকদের জন্য এক নিয়ম না করে প্রতিটি বিষয়ে আলাদা লক্ষ্য স্থির করা ভাল। দ্বিতীয়ত, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সাহায্য পাওয়া সহজ হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের ভিতরে থাকতেই হবে কাউন্সেলিং সেন্টার। পাশাপাশি, সহপাঠী সহায়তা প্রোগ্রাম বা বন্ধুদের দল গঠন করা যেতে পারে, যাতে কেউ সমস্যায় পড়লে একে অপরের দিকে বাড়িয়ে দিতে পারে সাহায্যের হাত। একটা ২৪ ঘণ্টা খোলা ফোন হেল্পলাইনও রাখা উচিত প্রতিটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। তৃতীয়ত, প্রশিক্ষণ দরকার গাইড বা সুপারভাইজ়ারদেরও। তাঁদের শেখানো উচিত, কী ভাবে এক জন শিক্ষার্থীর মানসিক চাপ বুঝে নিতে হয়, আর কী ভাবে তাঁদের শুধুমাত্র পেপার ছাপার যন্ত্র না ভেবে এক জন মানুষ হিসাবে সম্মান দেওয়া যায়। চতুর্থত, গবেষণায় চূড়ান্ত সাফল্য মানে শুধু কতকগুলো পেপার প্রকাশ হল, তা নয়। বরং দেখা উচিত সেই গবেষণার মান কেমন, সমাজ বা দেশের জন্য কতটা উপকারী, আর গবেষক কাজটি করতে গিয়ে কতটা শিখেছেন বা সমৃদ্ধ হয়েছেন।
পিএইচ ডি চলাকালীন সময়টা সব গবেষকের জন্যই কঠিনতম— তাঁর ভবিষ্যৎ তখনও অনিশ্চিত, বাস্তব নিষ্ঠুর। এই সময় তাঁর প্রয়োজন আশ্রয়, স্নেহ, নিরাপত্তার। আমরা যদি সেটুকুও দিতে ব্যর্থ হই, তরুণ গবেষকরা তবে দাঁড়াবেন কোথায়?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)