E-Paper

নদীতল চুরির বৃত্তান্ত

২০২১-পরবর্তী নতুন নীতি অনুযায়ী, কর্পোরেশনের ‘এক্সক্যাভেশন ডিভিশন’ বালি তুলবে, ‘স্টোরেজ ডিভিশন’ বালি জমা করবে। ‘এনফোর্সমেন্ট ডিভিশন’ নজরদারি করবে।

অনিতা অগ্নিহোত্রী

শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৩৩

শীতের নদীকে বর্ষায় চেনা যায় না। শীতে জলতল নীচে, শান্ত ভাবে নিশ্চুপ পড়ে থাকা জল দেখে কে ভাবতে পারবে তিন মাস টানা বর্ষণের পর কী ভাবে খরজল এসে মিশে যাবে নদীর ধারায়! সোনামুখীর রণডিহাতে ‘অ‍্যান্ডারসন উইয়ার’ তৈরি হয়েছিল ১৯৩২ সাল। উদ্দেশ‍্য, বন‍্যা নিয়ন্ত্রণ। আজও সেই নিচু বাঁধের এক দিক দিয়ে উপচে পড়ে ধরা জল।

ভাদ্রের দামোদর যেন এক বিশাল জলখেলার আঙিনা। তিন মাস একটানা বৃষ্টিতে চাষের ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। পটল, চিনাবাদামের ফসল নষ্ট হয়েছে। দামোদর ব‍্যারাজের জল এ অঞ্চলের চাষের কাজে আসে না। এখানে জল ওঠে শ‍্যালো আর সাবমার্সিবলে। চার দিকে ধান। ধানের লকলকে শিস সবুজ আস্তরণে মুড়ে রেখেছে আদিগন্ত পৃথিবী। ভাদ্রের মাঝামাঝি তখনও মেঘের জন‍্য শস‍্য ধরেনি ধানের শিসে, আরও কিছু দিনের অপেক্ষা। দামোদরের জল চাষের কাজে না এলেও ব‍্যারাজ থেকে জল ছাড়লে বানভাসি অবস্থা তৈরি হয়। মানুষ যেমন নদীর উপর নির্ভরশীল, নদীও তেমন যথাসাধ্য চেষ্টা করে মানুষের জীবনকে ধরে রাখতে।

বিকেলের রণডিহার ঘাটে নৌকো খেয়া পারাপার করছে, সাঁতার দিয়ে মাছ ধরছে জেলে। স্নান করার সময় গামছায় ছোট মাছ ধরছে গৃহস্থ। জেলের নাইলন জাল থেকে ছোট মাছ রক্ষা পায় না, ফলে খুদে চিংড়িও উঠে আসছে মৌরলা-বাটা ইত‍্যাদির সঙ্গে। পারে বসেই বিক্রিবাটা চলছে, সকালের বাজারেও মাছ আসে। আমি যাঁদের অতিথি, সেই কৃষাণ দম্পতির সংসারে ছায়া ফেলেছে সদ‍্য-ঘটা পটল আর চিনাবাদাম চাষের ক্ষতি। এতে শীতকালে আলুর চাষ মার খাবে।

মেঘের জন‍্য ধানে শস‍্য আসেনি, কিন্তু পাশের পড়শির বাঁধানো উঠোনে চলছে গোলায় রাখা ধান সেদ্ধ, ধান শুকোনোর কাজ। গায়ে পায়ে কাদা মেখে লাঙল ঘাড়ে চললেন কর্তা। সামনের জমিতে ট্রাক্টর চলেছে একটু আগে, মাটি তৈরি হয়েছে। ওই জমিতে বানের জল ঢুকেছিল, এখনও ডোবার মতো জল জমে আছে। নদীর চলনপথ ছিল যে সব জায়গা, সে সব জমি বুজিয়ে এখন চাষ হয়। বান এলে নদী দু-কূল ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

আশপাশের ছয়-সাতটা গ্রাম নিয়ে সমিতি মানা, অর্থাৎ মানা পঞ্চায়েত সমিতি। মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের মধ‍্যপ্রদেশে যেখানে নিয়ে বসত করানো হয়েছিল, সেই মানা ক‍্যাম্পের স্মৃতিতে। এখানে আসা কৃষক পরিবারগুলো আগে ছিল বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলীতে। তারও আগে বাংলাদেশে, সেখান থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে চলে আসে তারা। যাঁরা প্রথম এসেছিলেন, সেই পূর্বজদের কথা এখন তাঁদের মনেও নেই আর। দামোদরের ধারে বসত করতে এসে প্রায় সবাই ডেকে এনেছেন নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের।

কলকাতা থেকে দামোদরের ধারে সমিতি মানার কাছে আসতে পথের চেহারা বদলায়। এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে যায় খানাখন্দ-ভরা স্টেট হাইওয়ে, তার পর গ্রামীণ পথ। সিঙ্গুরে আ-চষা পাথুরে মাটির বুকে কাশফুলের হাসি দেখলে মনে হয়, আন্দোলন বলে কিছু যেন হয়নি এখানে।

দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে এখন মাখনের মতো নরম, তার উপর দুই দিকে ‘বেরিয়ার’, তাকে দু’ধারের গ্রাম-মফস্‌সল থেকে সাবধানে আলাদা করে রেখেছে। বড়জোড়ায় দামোদরের ব‍্যারাজ, এখান থেকে ক‍্যানাল গেছে সোনামুখী। দামোদরের জল পায় বর্ধমান, বাঁকুড়া পায় না। বড়জোড়ার পর পথ শীর্ণতর হয়েছে, হাট আশুরিয়ার মোড় দিয়ে পখন্না, তার পর কুলডাঙ্গা, রাঙামাটি, সমিতি মানা।

কুলডাঙা পার হওয়ার পর দিগন্তে লিপ্ত হলুদরঙা পাহাড়ের বিস্তার দেখে হাড় হিম হয়ে আসে। এ যেন সেই রূপকথার গল্পের হাড়ের পাহাড়, কড়ির পাহাড়— বালি খাদান। এত বালি তোলা হয়েছে দামোদরের বুকের ভিতর থেকে। তার পর চষা খেতের উপর সেই বালির পাহাড় গড়ে উঠেছে একটু করে। খাদান প্রায়ই খবরে আসছে আজকাল। ভারতীয় সংবিধানের মতে, নদীর বালি কার্যত জনসম্পদ। কিন্তু খাদানগুলি তৈরি হওয়ার পর নিজের প্রয়োজনের সামান্যতম বালি, ঘর তৈরি বা অন‍্য কাজে নিতে পারছেন না স্থানীয় মানুষ।

অথচ ২০২১ সালে বাংলায় নতুন বালি খাদান নীতি অনুযায়ী নদীর স্বাস্থ্য, তার স্বাভাবিক গতি বজায় রাখতে বালি তোলার সব দায়িত্ব ন‍্যস্ত হয়েছে রাজ‍্যের মিনারাল ডেভলপমেন্ট অ‍্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশনের উপর। এর ফলে নদী থেকে অবৈধ বালি তোলা বন্ধ হওয়ার কথা ছিল। আগে পুরো ব‍্যাপারটা ছিল বেসরকারি হাতে। নদীঘাটের বালি নিলাম হত। অসংখ্য ছোট নিলামদার যন্ত্রপাতিতে যথেষ্ট বিনিয়োগ না করে বালি তুলত। পরিবহণ খরচ কম রাখতে চাইত ছোট ‘লিজ়-হোল্ডার’রা, ফলে নদীর ধার থেকে যথেচ্ছ বালি-পাথর তোলা হত। ভাঙনের সম্ভাবনা বেশি হত। যথেষ্ট রাজস্ব পেত না রাজ‍্য, নদীরও ক্ষতি হত।

২০২১-পরবর্তী নতুন নীতি অনুযায়ী, কর্পোরেশনের ‘এক্সক্যাভেশন ডিভিশন’ বালি তুলবে, ‘স্টোরেজ ডিভিশন’ বালি জমা করবে। ‘এনফোর্সমেন্ট ডিভিশন’ নজরদারি করবে। নদীর বুক থেকে বালি তোলায় নদীতীরের ভাঙনের সম্ভাবনা কমবে। খাদানের সাইজ় অনুযায়ী নানা রকম নিয়ন্ত্রণ ব‍্যবস্থা রাখা হবে। পুরো ব‍্যবস্থাটি হবে একটি কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইট থেকে, বালি পরিবহণের ‘ই-চালান’ও সেখান থেকে আসবে।

অথচ নদী থেকে কত বালি তোলা যেতে পারে তার কোনও পরিমাপ আছে বলে মনে হয় না। গত অগস্ট মাসে জম্মু ও কাশ্মীর সম্পর্কিত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, নদীর বালি পুনঃসৃজন করার ক্ষমতা পরিমাপ করেই যেন বালি তোলা হয়। বালি তোলার জন‍্য পরিবেশের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক, তার জন‍্য দরকার একটি বৈধ জেলা সার্ভে রিপোর্ট। কেন্দ্রীয় সরকারের ২০২০-এর বালি খননের নির্দেশিকাতে বলা হয়েছে, অপরিমিত ও বেআইনি বালির খনন নদীর স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। কাজেই নদীর বালির পরিমাণকে পুনর্জায়িত করার ক্ষমতা অনুযায়ীই কেবল বালি তোলা যেতে পারে।

এই আদেশের উল্লঙ্ঘন চলেছে সর্বত্র। কেবল বাংলা নয়। সারা ভারতে দেখেছি নদীর এই লুণ্ঠন। বালি পুনর্জায়নে নদীর ক্ষমতা নিয়ে কেউ ভাবিত নয়, যত ভাবনা বালি ব‍্যবসায়ের অবৈধ লাভ নিয়ে। নর্মদা, তাপী, গোদাবরী, কাঁসাই, দামোদর, এমনকি বোলপুরের ছোট নদী কোপাই-ও। মেদিনীপুর গিয়ে স্থানীয় মানুষের কাছে শুনলাম, কাঁসাই থেকে এত বালি তোলা হয়েছে যে নদীর বুক খালি, কেবল এঁটেল মাটি পড়ে আছে তলায়। বালি তোলার আগে জেলা সার্ভে রিপোর্ট বানিয়ে পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়ার রীতি বাংলায় নেই। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ কিন্তু সারা দেশেই প্রযোজ‍্য।

কিন্তু ২০২১ সালে সরকারি কর্পোরেশনের হাতে কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণের সুফল ফলেছে কি? নীতিতেই আছে, কর্পোরেশন বালি তোলা, পরিবহণের কাজে এজেন্ট নিয়োগ করতে পারবে। রহস্য কি সেখানেই? ট্রাক-পিছু রয়‍্যালটি যা পাওয়ার কথা, তা কি পাচ্ছে রাজ‍্য? যে টাকা ফাঁকি পড়ছে তার যাত্রাপথ কত দূর? সত্যিই কি অবৈধ খাদানগুলি বন্ধ হয়েছে? বৈধ খাদানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ নতুন নীতি অনুযায়ী হচ্ছে? সম্প্রতি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার নজরে পড়েছে খাদান মালিকদের হিসাব-বহির্ভূত আয়। চলছে ধরপাকড়। হঠাৎ-ভাঙা ঘুম, না কি নির্বাচনের প্রয়োজনে রাজস্ব নিয়ে দুই পক্ষের দড়ি টানাটানি?

সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ মেঘভাঙা বৃষ্টি আর হড়পা বানের পর উঠে এসেছে বালি ও পাথর তুলে নদীগুলিকে কার্যত হত‍্যা করার বৃত্তান্ত। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারে নদীগুলির উপর অন্তত ৫০০ বালিখনি আছে। ২০২০ সালে ‘সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অব ড‍্যামস, রিভারস অ‍্যান্ড পিপল’ রিপোর্টে বলা হয়েছে, মহানন্দা, মেচি, চেঙ্গা, রক্তি, বালাসন সব নদী থেকেই তোলা হয় অপরিমিত বালি ও পাথর। বন‍্যার পর জনজীবন স্বাভাবিক হলে এই প্রশ্নগুলিও সুদূর হয়ে যাবে।

দামোদরের তীরে আবার ফিরে আসি। নদী তার নিজের মতো করে জনজীবন গড়তে চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা কি নদীকে ভালবাসি?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

River sand mine

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy