কোভিড লকডাউন সময়কালে নানা রাজ্যে আটকে পড়েছিলেন যে পরিযায়ী শ্রমিকরা, তাঁদের খোঁজখবর নিয়েছিল একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন— স্ট্র্যান্ডেড ওয়ার্কার্স অ্যাকশন নেটওয়ার্ক। সেই সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন (২০২০) থেকে দেশবাসী জানতে পারেন, কী দুর্বিষহ দিন কাটিয়েছেন শ্রমিকরা, তাঁদের অধিকার কী ভাবে নস্যাৎ করেছিল রাষ্ট্র। এই শ্রমিকদের সঙ্গে পূর্বের যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে সম্প্রতি আর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করল এই সংগঠনটি। বিষয়, ভোটার তালিকার ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন’ (এসআইআর)। ১৯-২১ জুলাই বিহারের ৩৩৮ জন পরিযায়ী শ্রমিকের মধ্যে একটি ‘দ্রুত সমীক্ষা’ (র্যাপিড সার্ভে) করা হয়। স্বেচ্ছাসেবকরা দূরভাষে জানতে চান, বিহারের নির্বাচন-পূর্ববর্তী ভোটার তালিকায় এসআইআর পদ্ধতিতে সংশোধন বিষয়ে তাঁরা আদৌ অবগত কি না, এবং প্রয়োজনীয় এগারোটি নথির মধ্যে কতগুলি তাঁদের কাছে আছে।
বিহারের নির্বাচন কমিশন এসআইআর ঘোষণা করে ২৪ জুন। তার পর থেকে এই প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা, বিরোধিতা, আদালতে আবেদন, সবই চলছে। লক্ষণীয়, এসআইআর-এর সময়সীমা ছিল ২৫ জুলাই, কিন্তু ১৫ জুলাইয়ের আগে পর্যন্ত বিহার থেকে ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কোনও বিশেষ ঘোষণা, বা নাম অন্তর্ভুক্তির বন্দোবস্ত করা হয়নি। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী বিহার থেকে যাঁরা অন্য রাজ্যে যান, তাঁদের ৫৫ শতাংশ পাড়ি দেন কাজের জন্য। ২০১১ সালে বিহার থেকে অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৫ লক্ষ। বর্তমানে নিশ্চয়ই তার কয়েক গুণ।
এসআইআর শুরু হওয়ার কুড়ি দিন পরে, ১৫ জুলাই, বিহারের মুখ্য-নির্বাচন আধিকারিক দিল্লির সংবাদপত্রে হিন্দিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানান, পরিযায়ী ভোটাররা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাঁদের আবেদনপত্র অনলাইনে জমা করতে পারবেন। দ্রুত-সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, বিহারের বাইরে থাকা দশ জন শ্রমিকের ন’জনই এসআইআর সম্পর্কে অবহিত নন, ৬৮ শতাংশ জানেন না এসআইআর প্রক্রিয়ায় কী কী নথি প্রয়োজন। বিজ্ঞপ্তিতে যে নথিগুলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে (পাসপোর্ট, শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ, বসবাসের আদেশনামা, জাতিগত শংসাপত্র, রাজ্য সরকারের দেওয়া শংসাপত্র, নাগরিকপঞ্জি, বন অধিকার শংসাপত্র ইত্যাদি), মোট শ্রমিকের ৩৫ শতাংশের কাছে সেগুলির একটিও নেই।
অন্য দিকে, তাঁদের প্রায় সকলের কাছেই আধার কার্ড আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমিশনের পক্ষ থেকে আবেদনপত্রের সঙ্গে ভোটার ও আধার কার্ডই সংগ্রহ করা হয়েছে। যদিও সেই নথিগুলি এ পর্যন্ত এসআইআর তালিকার বাইরে। মাত্র এক জন পরিযায়ী শ্রমিক অনলাইন আবেদন করেছিলেন। বাকিদের মধ্যে মাত্র ১৪ শতাংশ অনলাইন প্রক্রিয়ার কথা শুনেছেন, করতে পারেননি। গবেষকদের সঙ্গে আলাপে এক মুসলমান শ্রমিক অনলাইনে পরিচয়পত্র পেতে গিয়ে বারংবার হয়রানির কথা জানান। বলেন, “ফোন যেমন করে বার বার ‘রিফ্রেশ’ করতে হয়, তেমন করেই বার বার শংসাপত্র জোগাড় করতে হচ্ছে।” তাঁরা জানিয়েছেন, আবেদনপত্র জমা দিতে শ্রমিকরা বাধ্য হচ্ছেন কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বাড়ি ফিরতে। ভয়, নথি না দেখাতে পারলে তাঁরা হারাবেন ভোটাধিকার।
স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে নাগরিকদের হুমকি-সদৃশ আদেশ দেওয়া হচ্ছে। ভোটার তালিকা সংশোধন নয়, যেন নাগরিকপঞ্জিই ঘুরপথে তৈরি করা হচ্ছে এই এসআইআর-এর মাধ্যমে, এই অভিযোগ বার বার উঠছে। এ যেন নাগরিকের অধিকার খর্ব করার অভিসন্ধি। কেবল পরিযায়ী শ্রমিক নয়, সকল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ভোটাধিকারে আঘাত এই এসআইআর।
অন্য দিকে, ভোটার কার্ড আধার কার্ড থাকা সত্ত্বেও বাংলাভাষী, প্রধানত মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থার সংবাদ এখন প্রতি দিন মিলছে। ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, হরিয়ানা, দিল্লি, অসম, গুজরাত, রাজস্থানে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের আটক করা হচ্ছে। কোথাও চারশো, কোথাও তিনশো শ্রমিককে বন্দি করে রাখা হচ্ছে থানায়, স্কুলবাড়িতে, ডিটেনশন সেন্টারে। ২০২২ সালে বর্ধমানের দম্পতি পলাশ ও শুক্লা অধিকারী, তাঁদের শিশুসন্তান-সহ বন্দি হন বেঙ্গালুরুতে। ৩০১ দিন পরে মুক্তি পান। ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড, প্যান কার্ড, বাইকের রেজিস্ট্রেশন, জীবনবিমার নথি, সব থাকা সত্ত্বেও।
জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন, চাষের আয় কমে যাওয়া, নদীর ভাঙন, নানাবিধ কারণে গরিব মানুষ অন্য রাজ্যে পাড়ি দেন রোজগার করতে। কিন্তু আয়ের সঙ্গে নথির সম্পর্ক যে ওতপ্রোত। যে পরিবার যত বেশি আয় করে, তাঁদের তত অধিক জমি ও সম্পত্তির দলিল, শিক্ষাগত শংসাপত্র, পুরাতন নথির রক্ষণাবেক্ষণ। ভারতে সর্বাধিক প্রচলিত দুই পরিচয়পত্র, ভোটার ও আধার কার্ডকে এসআইআর এবং নাগরিকত্বের আওতার বাইরে রাখার মানে তাই দাঁড়ায়, গরিব মানুষ, বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নেওয়া।
কোভিডের সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা ভারতীয় গণতন্ত্রের ব্যর্থতাগুলি নিজেদের দেহে বহন করে পথ হেঁটেছিলেন। তাঁদের মৃত্যুর পরিসংখ্যান রাখতেও রাজি হয়নি রাষ্ট্র। সেই ‘নেই’ হয়ে যাওয়া আবার ফিরে এল। এসআইআর এবং বাংলাভাষী শ্রমিকের উপর নানা রাজ্যে আক্রমণ নাগরিকত্বের সঙ্কটকে ফের দেশের সামনে তুলে ধরল।
ইংরেজি বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)