E-Paper

জনস্বাস্থ্য বনাম মুক্ত বাণিজ্য

খাদ্যের পাশাপাশি কৃষিও চাপে পড়ছে। এফটিএ-র দ্বারা বিদেশি পণ্য আমদানির কারণে স্থানীয় কৃষিপণ্যের বৈচিত্র কমছে, উন্নত বিশ্বের বাজারের কঠোর মানদণ্ড ছোট কৃষকদের রফতানি থেকে দূরে ঠেলছে।

অমিতাভ সরকার

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:২৭

ভারত আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এক দিকে দ্রুতগতির অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন, অন্য দিকে জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ। সাম্প্রতিক কালে ভারত একের পর এক ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এফটিএ) বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করছে— ব্রিটেন, ইউরোপীয় মুক্ত বাণিজ্য সংস্থা, গাল্‌ফ দেশ, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া— তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে, রফতানির বাজার খুলছে, কর্মসংস্থানের আশা জাগছে। শুনতে ইতিবাচক হলেও প্রশ্ন জাগে, এই প্রবৃদ্ধির আসল খেসারত কি আমাদের স্বাস্থ্যকে দিতে হবে? অর্থনৈতিক উন্নয়ন যদি হাসপাতালে বিছানার সংখ্যা বাড়ায়, তবে তা কি সত্যিই উন্নয়ন?

বিশ্ব খাদ্যব্যবস্থা এর স্পষ্টতম উদাহরণ। বৈশ্বিক খাদ্য বাজার দেখায়, কী ভাবে বাণিজ্য সরাসরি জনস্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। বহুজাতিক খাদ্য কোম্পানির প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই) বিশ্ব জুড়ে অতিরিক্ত চর্বি, চিনি ও লবণসমৃদ্ধ এবং অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারের বিস্তার ঘটিয়েছে। মেক্সিকো, চিলি, তাইল্যান্ডে দেখা গেছে, এ সব খাবার ঐতিহ্যবাহী খাদ্যাভ্যাস পাল্টে স্থূলতা ও অ-সংক্রামক রোগ বাড়িয়েছে। ভারতও একই পথে হাঁটছে। ডব্লিউএইচও-আইসিআরআইইআর-এর শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, ২০১১-২০২১ সালের মধ্যে ভারতে এ ধরনের খাবারের বিক্রি বছরে গড়ে ১৩ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। ভারতের উচিত সামনের প্যাকেটে লেবেল, চিনি কর, বিপণন সীমাবদ্ধতা ও স্কুলের খাবারের মান নিশ্চিত করার মতো পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা। প্রশ্ন হল, মুক্ত বাণিজ্য চাপের মুখে ভারত কতটা দৃঢ় থাকবে?

খাদ্যের পাশাপাশি কৃষিও চাপে পড়ছে। এফটিএ-র দ্বারা বিদেশি পণ্য আমদানির কারণে স্থানীয় কৃষিপণ্যের বৈচিত্র কমছে, উন্নত বিশ্বের বাজারের কঠোর মানদণ্ড ছোট কৃষকদের রফতানি থেকে দূরে ঠেলছে। কৃষকের আয় কমছে, সুস্থায়ী কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ কঠিন হচ্ছে। কৃষকেরাই টিকতে না পারলে খাদ্য নিরাপত্তা কতটা স্থায়ী হবে?

এফটিএ শুধু ওষুধ বা খাদ্য নয়, স্বাস্থ্যব্যবস্থার আর্থিক কাঠামোও নাড়িয়ে দিতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রিটেনের সঙ্গে আলোচনায় দেখা গেছে, পরিষেবা খাতে আরও গভীর প্রতিশ্রুতির চাপ আসছে যা হাসপাতাল, বিমা, এবং রোগনির্ণয়কারী পরীক্ষানিরীক্ষার ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ইইউ-ভারত আলোচনায় এক সময় বিমা খাতে ১০০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের দাবি উঠেছিল। যদিও ভারত ২০২১-এ সীমা ৭৪ শতাংশে বেঁধে দেয়, তবু ইইউ-ভারত আলোচনায় এফটিএ আলোচনার চাপে আবার উদারীকরণের বিতর্ক শুরু হয়। ২০২৫-এর কেন্দ্রীয় বাজেটে সেই সীমা মুছে ১০০% এফডিআই অনুমোদিত হয়েছে, যদিও শর্ত হিসেবে সব প্রিমিয়াম ভারতের মধ্যে বিনিয়োগ করতে হবে। ব্যক্তিগত বিমা বাড়লে চিকিৎসা অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার প্রবণতা বাড়ায়, ফলে পরিবারগুলোর খরচ বাড়ে। ‘আয়ুষ্মান ভারত’-এর মতো প্রকল্প যেখানে সরকারি খরচে বাজারজাত চিকিৎসার পরিধি বাড়াচ্ছে, সেখানে দুর্নীতির ঝুঁকিও থেকে যায়— অডিটে ভুয়ো বিল, অযথা অস্ত্রোপচার আকছার ধরা পড়ছে। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাও উদ্বেগজনক। বহুজাতিক বিনিয়োগকারী যদি মনে করে যে, সরকারি নীতি তাদের মুনাফা কমাচ্ছে, তারা এফটিএ-কে হাতিয়ার করে সরাসরি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে।

ওষুধ শিল্পে ঝুঁকি আরও স্পষ্ট। ভারত-ব্রিটেন এফটিএ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংক্রান্ত ‘ট্রিপস’ চুক্তির এমন কিছু শর্তকে দুর্বল করছে, যেগুলো দরিদ্র দেশগুলোকে জরুরি অবস্থায় সস্তায় ওষুধ তৈরি বা ব্যবহারের সুযোগ দিত। এর ফলে সস্তা ওষুধ ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বিশ্ব জুড়ে মানুষের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। এর সঙ্গে যদি ওষুধের মেধাস্বত্ব সুরক্ষার মেয়াদ বাড়ানো হয়, তবে ভারতের মতো দেশে, যেখানে এখনও ৬০ শতাংশের মতো স্বাস্থ্যব্যয় আসে মানুষের পকেট থেকে, তা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।

ভারত ব্রিটেনের সঙ্গে এফটিএ এগিয়ে নিচ্ছে, ইউরোপীয় মুক্ত বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা করছে— এই পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় চারটি পদক্ষেপ জরুরি। এক, এফটিএ আলোচনার শুরু থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা, শিক্ষাজগৎ, নাগরিক সমাজ, রোগী সংগঠন ও রাজ্য সরকারকে আলোচনায় যুক্ত করতে হবে। দুই, প্রতিটি চুক্তির স্বাস্থ্য প্রভাব মূল্যায়ন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ হওয়া দরকার। তিন, সংসদে নিয়মিত বিতর্ক ও তদারকি প্রাতিষ্ঠানিক করতে হবে। চার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্বাধীন সংস্থা গঠন করতে হবে, এফটিএ-সংক্রান্ত সব চুক্তির স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রভাব নিয়মিত পর্যবেক্ষণে যার যথেষ্ট ক্ষমতা ও অর্থ থাকবে।

শুধু জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় নয়, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তুলতেও এরা অপরিহার্য। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্য প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। স্বচ্ছতা ও বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন থাকলে বাণিজ্য চুক্তি জীবনের মানও উন্নত করবে, নয়তো ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য সঙ্কট ডেকে আনবে।

টাম্পেরে ইউনিভার্সিটি, ফিনল্যান্ড।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Health Food Safety Trade Deal

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy