Advertisement
E-Paper

কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে

অজানা জায়গায় যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ভাড়া করতে গেলে আপনি দর কষাকষিটা করবেন কিসের ভিত্তিতে?

বিকল্পবিধান: ন্যায্য বেতন ও স্থায়ী চাকরির দাবিতে প্যারাটিচারদের সমাবেশ, কলকাতা, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বিকল্পবিধান: ন্যায্য বেতন ও স্থায়ী চাকরির দাবিতে প্যারাটিচারদের সমাবেশ, কলকাতা, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৫:২২
Share
Save

এখানে বিশুদ্ধ ঘি পাওয়া যায়: দোকানের বাইরে এমন লেখা দেখে এক বিদেশিনি নাকি জানতে চেয়েছিলেন এখানে অশুদ্ধ ঘি-ও পাওয়া যায় নাকি। এই লেখা জুড়ে নানা রকম বৈধ বিষয়ের কথা আলোচনা শুরু করার আগে সেই শিরোনামটা মনে পড়ে যাচ্ছে। কী করে, সে কথায় আসার আগে কয়েকটা ছবি দেখে নেওয়া যাক।

রুবি হাসপাতাল মোড়ে মালপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটি একটি ট্যাক্সি ধরার আকুল চেষ্টা করছিলেন। অ্যাপের গাড়ি বার বার নাকচ করছে অথচ দু’পা দূরে দাঁড়িয়ে যে দুটো ট্যাক্সি তাঁরা যাবেন না। কেন? কারণ তাঁরা ৫০০ টাকা ভাড়া চাইছেন, যা অ্যাপের গাড়ির চেয়েও অনেক বেশি। ‘মিটার’ অনুসারে ওই ১৪-১৫ কিলোমিটারের বৈধ ভাড়া উঠবে দু’শো টাকার কিছু বেশি। আড়াই গুণ ভাড়া দিতে কে-ই বা রাজি হবেন। মেয়েটি তাঁর গন্তব্যের দূরত্বটা জানেন, তাই দর কষাকষি করতে পারছেন। কিন্তু অজানা জায়গায় যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ভাড়া করতে গেলে আপনি দর কষাকষিটা করবেন কিসের ভিত্তিতে?

বাসে উঠে যাত্রী কুড়ি টাকার একটা নোট দিলেন; কন্ডাক্টর পনেরো টাকার টিকিট দিলেন, পাঁচ টাকা ফেরত। এই দূরত্বের জন্য কবে থেকে পনেরো টাকা ভাড়া ঠিক হল, এই প্রশ্ন করতে যাত্রী সাহস পেলেন না, কারণ বেশ কয়েক বছর ধরে বাসের ভাড়া সংশোধন না হওয়ায় বাস মালিক ইচ্ছে মতো দশ বা পনেরো টাকা ভাড়া চেয়ে নিচ্ছেন, যাত্রীরাও ‘তেমন অসুবিধে হচ্ছে না’ বলে ব্যাপারটা নিয়ে শোরগোল করছেন না। সঙ্গের শিশুটি জানতে চাইল বাসের ভাড়া কোথায় লেখা থাকে? থাকে না। অথচ দূরত্ব অনুসারে বাসের ভাড়ার পরিবর্তনের মোটের উপর যুক্তিযুক্ত একটি তালিকা কয়েক বছর আগেও বাসের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় টাঙিয়ে রাখা হত। ভাড়া কম-বেশি নেওয়া নিয়ে তর্কাতর্কি তখনও চলত, কিন্তু বৈধ নিয়ম একটা ছিলই।

এই ভাবে পরিস্থিতির চাপে চালু ব্যবস্থাগুলোর এক-একটা সমান্তরাল ব্যবস্থা নিজে থেকেই গড়ে ওঠে। কিন্তু এইখানে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি এই ব্যবস্থাগুলো যেন সরকারি বদান্যতায় গড়ে উঠছে আর তার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। গত দশ বছরে ট্যাক্সি ভাড়া বৈধ ভাবে একটুও বাড়েনি, তেলের দাম বেড়েছে বহু দূর। স্বাভাবিক ভাবেই ‘মিটার’ নির্ধারিত আদ্যিকালের ভাড়া নিলে বাস ও ট্যাক্সি মালিকদের চলবে কী করে। অগত্যা ট্যাক্সির মিটার, তার সঙ্গে লাগানো রসিদের প্রিন্টার, নিয়মিত মিটার যাচাই করার নিয়ম, সব কিছু অর্থহীন করে গোটা ব্যবস্থাটা একটা দর কষাকষির উপর দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সরকার ধীরে ধীরে গণপরিবহণের উপর থেকে হাত তুলে নিচ্ছে এবং ইচ্ছেমতো লুটেপুটে খাওয়ার বৈধ অধিকার হাতে তুলে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে অ্যাপ-নির্ভর বেসরকারি পরিবহণ ব্যবস্থার যাবতীয় অনিশ্চয়তাকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

কিন্তু সমান্তরালের জাল আরও গভীরে ছড়িয়ে পড়ছে। গত দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইস্কুলে সরাসরি নিয়োগ বন্ধ, অথচ স্বাভাবিক নিয়মে অবসর নেওয়া তো চলছেই। মানে, শূন্যপদগুলো শূন্যই পড়ে থাকছে। কিন্তু প্রয়োজনই উদ্ভাবনের জননী, অগত্যা ইস্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁদের সাধ্যমতো সাম্মানিকের বিনিময়ে কিছু অস্থায়ী বা আংশিক সময়ের শিক্ষক নিযুক্ত করছেন। মাঝে-মাঝেই আমরা এই রকম বিজ্ঞাপন দেখে শিউরে উঠি, যেখানে মাসে দুই বা তিন হাজার টাকা দক্ষিণায় শিক্ষক নিয়োগ করতে হচ্ছে। নিন্দায় সরব হয়ে উঠতে উঠতে আমরা ভুলে যাই, কেন এই ভাবে শিক্ষক নিয়োগ করতে হচ্ছে। আমরা ভুলে যাই যে, এইটুকুই ওই ইস্কুলের কর্তৃপক্ষের দেওয়ার ক্ষমতা। অনেক শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের সামনেও ওই প্রস্তাব গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা নেই।

একই অবস্থা কলেজেও। কলেজে ‘স্টেট এডেড কলেজ টিচার’ উদ্যোগের অধীনে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থা চালু হয়েছে, যেখানে ইউজিসি-র সব শর্ত পূর্ণ না করলেও প্রার্থীদের শিক্ষকতায় নিযুক্ত করার উপায় রয়েছে। কলেজ সার্ভিস কমিশনের একটি সমান্তরাল ব্যবস্থা বলা যায় একে, যার অধীনে সর্বোচ্চ বেতন মাসে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা (১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে) এবং সর্বনিম্ন কুড়ি হাজার। কলেজ সার্ভিস কমিশনের (সিএসসি) নিয়োগের অনিশ্চয়তার কারণে স্যাক্ট শিক্ষক ছাড়া কলেজ অচল, অথচ একটি কলেজের কোনও বিভাগে স্থায়ী ও স্যাক্ট মিলে নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষক থাকলে তাঁরা আর স্থায়ী শিক্ষকের জন্য আবেদন করতেই পারেন না। ‘স্যাক্ট’-এর অধীনে কর্মরত থাকলে সেই শিক্ষকের পক্ষেও পরবর্তী ইন্টারভিউতে কলেজে স্থায়ী চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সিএসসি-র কাছে যে কোনও বিষয়ে অনেক কম শূন্যপদের হিসেব পৌঁছচ্ছে। খুব কমসংখ্যক প্রার্থী সুযোগ পাচ্ছেন। এই ভাবে কলেজে (এবং ইস্কুলে) নির্দিষ্ট বেতনক্রমের স্থায়ী শিক্ষকের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। এখনকার তরুণ কলেজ-শিক্ষকদের মধ্যে বেশির ভাগই স্যাক্ট শিক্ষক, ইস্কুলের শিক্ষকরা ‘প্যারাটিচার’ বা অন্য কিছু। অর্থাৎ এক জন ছাত্র গবেষণা করার সময় যে বৃত্তি পাচ্ছেন, ‘স্যাক্ট’-এর আওতায় তার চেয়ে অনেক কম বেতনে তিনি চাকরি জীবন শুরু করছেন, কারণ উন্নততর বিকল্প তাঁর কাছে নেই এবং সেটাই তাঁর স্থায়ী জীবিকা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এই ভাবে বেতনক্রমের চূড়ান্ত বৈষম্যের অদৃশ্য রেখায় বিভক্ত হয়ে থাকে ইস্কুল-কলেজের ‘টিচার্স রুম’। আংশিক সময়ের আংশিক বেতনের শিক্ষক তাঁর দ্বিগুণ তিন গুণ বেতনের শিক্ষকদের সমান দায়িত্ব নিতে চাইবেন না, সেটা তাঁর শর্তেও নেই। আবার সেই নিয়ম মেনে চললে একটি-দু’টি স্থায়ী শিক্ষকের উপর অত্যধিক চাপ পড়ে যায়। দুই দল শিক্ষক পরস্পরের দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকান, দায়িত্বের ‘পিঠে ভাগাভাগি’ হয়ে চলে, বাদ পড়ে যায় ছাত্রছাত্রীগুলো। এই ভাবে একেবারে বৈধ পদ্ধতিতেই ইস্কুল-কলেজের পড়াশোনার ভরকেন্দ্রটি স্থানচ্যুত হয়ে যাচ্ছে— এটা কিন্তু অনেক বড় ক্ষতি।

সমান্তরালের খেলা আরও আছে। স্নাতকোত্তরের পর যাঁরা পিএইচ ডি ডিগ্রি পেতে চান, তাঁদের কিছু পরীক্ষা দিয়ে বৃত্তি জোগাড় করতে হয়। তার পর গাইডের নির্দেশিত রাস্তায় কাজ করে, কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশ করে চার বা পাঁচ বছরের শেষে ডিগ্রি পান। কিন্তু যাঁরা সে ভাবে কাজ করার সময় পাচ্ছেন না, অথচ ডিগ্রিটা দরকার তাঁদের জন্য আছে সমান্তরাল ব্যবস্থা। বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চ মূল্যের বিনময়ে তাঁরা নাম লেখান, যেখানে তিন বা চার বছরের শেষে তাঁদের ডিগ্রি পাইয়ে দেওয়াটা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। ‘স্যাক্ট’ শিক্ষকরা অনেকেই এই ব্যবস্থার সুযোগ নিতে বাধ্য হন যাতে তাঁদের বেতনক্রম কিছুটা সংশোধন হয়। এই পদ্ধতিকে কখনওই ‘ডিগ্রি কেনা’ জাতীয় দুর্নীতির সঙ্গে তুলনা করা যাবে না, কিন্তু শিক্ষাগত যে উত্তরণের জন্য ছাত্ররা পিএইচ ডি-র মতো একটি কঠিন ও সময়সাপেক্ষ কাজ শুরু করেন, যে রকম প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন, এই পদ্ধতিতে তার খুব সামান্য অংশই সম্পন্ন করা যায়।

এই ভাবে সমাজের মৌলিক প্রয়োজনগুলোকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সমান্তরালে এক-একটি চক্র বৈধ ভাবেই ঘুরে চলেছে। বিভিন্ন সরকারি দফতরেও স্থায়ী নিয়োগ বন্ধ হয়ে এই রকম চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা সামান্য বেতনে কাজ করে চলেছেন। গ্রামাঞ্চলে ডাক্তারের অভাবে কাজ করছেন ‘প্যারামেডিক্যাল’ কর্মীরা। সিভিক ভলান্টিয়ারদের কোনও অপকর্ম প্রকাশ্যে এলে তখনই আমরা জানতে পারি যে এঁরা আমাদের আশেপাশে থেকে আছেন, নানা দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। পরীক্ষা ছাড়াই এঁরা একটা মাসমাইনের চাকরি পেয়েছেন, এটা এঁদের লাভ। আর সরকার এক জন স্থায়ী কর্মীর বেতনে তিন-চার জনকে চাকরি দিতে পারছে, সেটা তাদের লাভ। এই ভাবে সমান্তরাল ব্যবস্থা উভয়ের পক্ষেই ‘সুবিধাজনক’। সবাই সেটাকেই নিয়ম বলে ধরে নেয় (দুর্নীতি নয়)। আর সেই সুবিধায় অভ্যস্ত হয়ে যায়।

একের পর এক হেলে পড়া বাড়ি, পোড়া বাজিঘর, বোজানো পুকুর আর অসহায় চাকরিপ্রার্থীদের দিকে তাকিয়ে আমরা বুঝি— এই সবই নানা রকম সমান্তরাল ব্যবস্থার পরিণাম। কিন্তু বৈধতার ছদ্মবেশে সমান্তরাল ব্যবস্থার দুর্নীতি যখন জাল বিস্তার করে, তাকে সহজে চেনা যায় না। গোটা ব্যবস্থায় গোপনে ঘুণ ধরিয়ে দেয়, যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া ‘সহজ নয়, সহজ নয়!’

রসায়ন বিভাগ, সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Society Teachers Recruitment Professor Recruitment Public Transport Education system

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}