E-Paper

পশ্চিমবঙ্গ শুধু পিছিয়েছে

এ কথা ঠিক যে, মাথাপিছু আয় উন্নয়নের অগ্রগতির একমাত্র মাপকাঠি নয়। কিন্তু সাধারণ ভাবে, বাকি সব কিছু সমান থাকলে, কমের তুলনায় বেশি মাথাপিছু আয় কাম্য।

অশোক কুমার লাহিড়ী

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:৫৯

কোনও রাজ্যের স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (এসডিপি) বা অভ্যন্তরীণ উৎপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আমলে কোন রাজ্যকে কত অর্থ দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি ছিল এটি। অর্থ কমিশন এখনও বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে রাজস্ব বণ্টনের অনুপাত স্থির করার সময় এই পরিসংখ্যান ব্যবহার করে। সুতরাং, এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ভারতের ২৮টি রাজ্যের উন্নয়নের মূল্যায়ন অর্থবহ। কিন্তু, রাজ্যগুলির আয়তন এবং জনসংখ্যা যে হেতু খুব বেশি রকম আলাদা, তাই মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের তুলনা করা মুশকিল— যেমন, সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশের জনসংখ্যা সিকিমের ৩৪০ গুণ। বরং, মাথাপিছু নেট স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট— এই লেখায় আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা যাকে মাথাপিছু আয় বলব— তার তুলনা করা ভাল।

এ কথা ঠিক যে, মাথাপিছু আয় উন্নয়নের অগ্রগতির একমাত্র মাপকাঠি নয়। কিন্তু সাধারণ ভাবে, বাকি সব কিছু সমান থাকলে, কমের তুলনায় বেশি মাথাপিছু আয় কাম্য। বেশি মাথাপিছু আয় মানুষের বিকল্পের পরিধিকে প্রসারিত করে— অর্থাৎ, আমরা কী খেতে পারি, কোন ধরনের বাড়িতে থাকতে পারি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবায় কতটা ব্যয় করতে পারি, এমনকি সরকারকে কতটা কর দিতে পারি যাতে রাস্তা-ঘাট, স্কুল, হাসপাতাল নির্মাণ করা যায় এবং সমাজের দুর্বল অংশগুলিকে কল্যাণমূলক ভাতা দেওয়া যায়, তার পরিধিটি বাড়ায়। সুতরাং, মাথাপিছু আয় অনুযায়ী র‌্যাঙ্কিং এবং সময়ের সঙ্গে তার পরিবর্তন একটি রাজ্যের অর্থনৈতিক অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক।

১৯৮০-৮১ থেকে ২০২৩-২৪, এই মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে দেশের ২৮টি রাজ্যের তুলনামূলক অবস্থান কেমন? বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান কোথায়? অন্য রাজ্যগুলিরই বা কেমন উন্নতি বা অবনতি ঘটেছে? মাথাপিছু আয়ের দৌড়ে প্রথম, দ্বিতীয় ইত্যাদি স্থান কাদের? দৌড়ে সবার শেষে, সবার পিছনেই বা কে রয়ে গেল? দৌড়ের শুরুতে, ১৯৮০-৮১ সালে, গোয়া ছিল প্রথম স্থানে। এবং, শুধুমাত্র ২০২১-২২ ছাড়া, ২০২৩-২৪ পর্যন্ত প্রতিটি বছর গোয়া তার প্রথম স্থান ধরে রেখেছিল। দৌড়ে কিছু রাজ্য অনেক এগিয়ে গেছে। যেমন, সিকিম ১৯৮০-এর দশকের প্রথমার্ধের দশম-দ্বাদশ স্থান থেকে ২০০৯-১০’এ উঠে আসে দ্বিতীয় স্থানে; ২০২১-২২ সালে এমনকি গোয়াকেও টপকে প্রথম স্থানে পৌঁছে যায়।

কিছু রাজ্য দৌড়ের শুরুতে শেষের সারিতে ছিল, এবং শেষেও সবার নীচেই থেকে গেছে। যেমন বিহার, যার মাথাপিছু আয় ১৯৮০-৮১’তে সর্বনিম্ন ছিল, ২০২৩-২৪’এও একেবারে নীচেই রয়ে গেছে। তেমনই, উত্তরপ্রদেশ ১৯৮০-৮১ সালে শেষ থেকে তৃতীয় স্থানে শুরু করার পর, আরও কমে শেষ থেকে দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছয়, এবং ১৯৯৬-৯৭ সালে শেষ থেকে চতুর্থ স্থানে ছিল। বাকি ৪৩ বছরের মধ্যে ৩৪ বছরই এই রাজ্য ছিল দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্তরে।

দেশের গড় মাথাপিছু আয়ের তুলনায় বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের মাথাপিছু আয় দেখলেও একই চিত্র উঠে আসে। ১৯৮০-৮১ সালে বিহারের মাথাপিছু আয় ছিল দেশের মাথাপিছু আয়ের ৫২.৭%, সেটা নেমে ২০২৩-২৪’এ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩১.৯ শতাংশে। উত্তরপ্রদেশের ক্ষেত্রেও এই একই নিম্নমুখী প্রবণতা— রাজ্যের মাথাপিছু আয় ১৯৮০-৮১ সালে সর্বভারতীয় মাথাপিছু আয়ের ৭৩.৪% থেকে ২০২৩-২৪’এ ৪৯.৪% হয়েছে। ভারতের প্রতি চার জন নাগরিকের এক জন হয় বিহার নয়তো উত্তরপ্রদেশে বাস করেন। এই দু’টি রাজ্যের উন্নতি না ঘটলে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির আখ্যানটি কিছুতেই পূর্ণতা পাবে না।

রাজ্যগুলির অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করলে দেখা যায় যে, দক্ষিণ ভারত, অর্থাৎ অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, কেরল, তামিলনাড়ু এবং তেলঙ্গানা, এই পাঁচটি রাজ্য মাথাপিছু আয়ের দৌড়ে গড়ে ৫.৪ স্থান উপরে উঠেছে। দক্ষিণী পাঁচটি রাজ্যের উন্নয়নের দৌড়ে তারকা হল কর্নাটক ও তামিলনাড়ু। কর্নাটক ২০১১-১২ থেকে মাথাপিছু আয়ের তালিকায় দ্রুত উন্নতি করেছে। অন্য দিকে, ১৯৮০-৮১’তে তামিলনাড়ু ছিল ত্রয়োদশতম স্থানে— ১৯৯০-এর দশকের শেষে রাজ্যটি উঠে আসে ষষ্ঠ স্থানে, মাঝের কয়েক বছরে কিছু অবনতি সত্ত্বেও শেষ চার বছরে রাজ্যটি ষষ্ঠ স্থানেই আছে। কর্নাটক ও তামিলনাড়ুর বৃদ্ধির চরিত্র ভিন্ন ছিল। কর্নাটকে সার্ভিসেস বা পরিষেবা খাত ছিল অগ্রগামী; আর তামিলনাড়ুতে আর্থিক বৃদ্ধি চালিত হয়েছে ইন্ডাস্ট্রি বা বহুমুখী শিল্পখাতের দ্বারা। দু’টি আঞ্চলিক দল— কখনও ডিএমকে, আর কখনও এআইএডিএমকে— দ্বারা শাসিত তামিলনাড়ুর দ্রুত উন্নয়ন কি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কার্যকারিতার প্রমাণ?

দক্ষিণের পরেই রয়েছে গোয়া, গুজরাত, মহারাষ্ট্র এবং রাজস্থানকে নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল। পশ্চিমাঞ্চলের গড় অবনতি ০.২৫ শতাংশ। রাজ্যগুলির মধ্যে রাজস্থান ১৯৮০-৮১ সালে ছিল ২৪তম স্থানে, ২০২৩-২৪’এ ১৭তম স্থানে উন্নীত হয়েছে।

তার পরে রয়েছে অরুণাচল প্রদেশ, অসম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজ়োরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম এবং ত্রিপুরাকে নিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চল। মাথাপিছু আয়ের নিরিখে সিকিমের অসাধারণ এবং মিজ়োরাম ও ত্রিপুরার যথেষ্ট ভাল উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু, অন্য রাজ্যগুলি তেমন ভাল না করায় গড়ে অঞ্চলটির আপেক্ষিক অবস্থানের সামান্য অবনতি ঘটেছে। এটি একটি ইতিবাচক সূচক, যা এই বহুলপ্রচলিত বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করে যে, হিমালয়সংলগ্ন ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব রাজ্যই আর্থিক বৃদ্ধির নিরিখে পিছিয়ে। আর একটি হিমালয়সংলগ্ন রাজ্য উত্তরাখণ্ডও মাথাপিছু আয়ের দৌড়ে সাতটি ধাপ এগিয়ে গেছে। আইন-শৃঙ্খলার গুরুত্ব স্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হয়েছিল মিজ়োরামে— ১৯৮৬ সালের ৩০ জুন ভারত সরকার ও মিজ়ো ন্যাশনাল ফ্রন্টের মধ্যে শান্তিচুক্তির পর, রাজ্যটি ১৯৮৫-৮৬ সালে ১৭তম স্থান থেকে পরের বছরই অষ্টম স্থানে উঠে আসে।

ছত্তীসগঢ় ও মধ্যপ্রদেশ নিয়ে মধ্যাঞ্চলের গড় র‌্যাঙ্কের অবনতি হয়েছে দেড় ধাপ। ২০০০-০১ সালে মধ্যপ্রদেশের থেকে আলাদা হওয়া ছত্তীসগঢ় ক্রমতালিকায় তিন ধাপ উঠে এলেও মধ্যপ্রদেশের অবনমন ঘটেছে ছ’ধাপ। তারই সম্মিলিত ফল এই অঞ্চলের গড় অবনতি।

হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, পঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড ও উত্তরপ্রদেশ নিয়ে উত্তর অঞ্চলের গড় র‌্যাঙ্কের অবনমন ঘটেছে ৩.৪ ধাপ। উত্তরাখণ্ড এবং হরিয়ানা ছাড়া উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি রাজ্য হয় ক্রমতালিকার নীচের দিকে স্থবির থেকেছে, অথবা পিছিয়ে পড়েছে। হরিয়ানা, যা ১৯৬৬ সালে পঞ্জাব থেকে পৃথক হয়েছিল, একটি সাফল্যের কাহিনি। ১৯৮০-৮১ থেকে ২০০১-০২ পর্যন্ত ক্রমতালিকায় তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানে থাকার পরে হরিয়ানা ২০০২-০৩ থেকে ২০০৫-০৬ পর্যন্ত এমনকি দ্বিতীয় স্থানও অধিকার করেছিল। সেখানে পঞ্জাব দ্বিতীয় স্থান থেকে নেমে গিয়েছে ১৫তম স্থানে।

পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি রাজ্য— বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ— ক্রমতালিকায় পিছিয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ১৩ ধাপ পিছিয়ে যাওয়ায় পঞ্জাবের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। দেশের এক কালের তুলনামূলক ভাবে ‘সমৃদ্ধ’ দু’টি রাজ্য— উত্তরে পাকিস্তান-সীমান্তবর্তী পঞ্জাব এবং পূর্বে বাংলাদেশ-সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ— মাথাপিছু গড় আয়ের ক্রমতালিকায় যে ভাবে পিছিয়ে পড়েছে, তা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য উদ্বেগজনক। সত্যিই, উভয় রাজ্যই দেশভাগের মারাত্মক ধাক্কা সহ্য করেছিল। কিন্তু ৭৮ বছর একটি দীর্ঘ সময়। দক্ষিণ কোরিয়া বা তাইওয়ানের মতো দেশ, যেগুলি এক কালে দেশভাগের সম্মুখীন হয়েছিল, সেগুলি সেই বেদনা থেকে শুধু ঘুরে দাঁড়ায়নি, হয়ে উঠেছে উন্নত দেশ।

পঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গ উভয়ই সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে— পঞ্জাব ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে নাটকীয় ভাবে; আর পশ্চিমবঙ্গ ধীরে ধীরে, চরম খাদ্যসঙ্কট ও উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সঙ্কটের সময়কার আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭০-এর দশকের নকশাল আন্দোলন পর্যন্ত। বিদ্রোহ ছাড়াও, পঞ্জাব আটকে পড়েছিল সবুজ বিপ্লবের ফাঁদে— বার বার বিনামূল্যের বিদ্যুৎ দিয়ে অস্থিতিশীল ভাবে ভূগর্ভস্থ জল পাম্প করে আরও বেশি উচ্চফলনশীল গম ও ধান উৎপাদনে, এবং সেই ফসল সরকারি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে বিক্রি করায়। অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গ কি আটকা পড়েছিল তার অতীত গৌরবে? আজ এই প্রশ্নগুলোর সামনে না দাঁড়িয়ে আর উপায় নেই।

বিধায়ক, বিজেপি, পশ্চিমবঙ্গ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Income Economy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy