E-Paper

এক অসহনীয় অপচয়

আজকের লেখাটি দক্ষিণ ভারতের— প্রধানত অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং কর্নাটকের— তোতাপুরি আম সম্মন্ধে।

অশোক কুমার লাহিড়ী

শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২৫ ০৭:১৯

ফলের রাজা আম, আর আমের রাজা ভারত। পৃথিবীর অর্ধেক আম উৎপাদিত হয় ভারতে। আনুমানিক ১,০০০ প্রজাতির আম হয় দেশে। নানান জায়গায় নানান রকমের আম। আম দ্রুত পচনশীল, তাই পরিবহণের, বিশেষত শীততাপনিয়ন্ত্রিত পরিবহণের অভাবে, অদূর অতীতেও স্থানীয় যে আম পাওয়া যায়, আমরা তাই শুধু খেতাম ও জানতাম। আমের মরসুমে বাঙালিরা ল্যাংড়া, হিমসাগর, ফজলি, আম্রপালি, গোপালভোগ ইত্যাদি নিয়ে মশগুল; উত্তর ভারতে বারাণসীর ল্যাংড়া, দসেরি, চৌসা নিয়ে মাতামাতি; মহারাষ্ট্রে আলফনসো বা হাপুসের জয়জয়কার। দক্ষিণ ভারতের অনেক রকম আম, আলাদা আমের জগৎ। তার মধ্যে নীলম, সফেদা, বাদামি, রসপুরি তো ছেড়েই দিন, বাইগানপল্লি এবং তোতাপুরির সঙ্গেও আমাদের পরিচয় সামান্য এবং সাম্প্রতিক।

আজকের লেখাটি দক্ষিণ ভারতের— প্রধানত অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং কর্নাটকের— তোতাপুরি আম সম্মন্ধে। আমটি দেখতে ভারী সুন্দর— লম্বাটে গড়ন, আর সবুজের উপরে হলুদ এবং লালচে আভা। অন্য আমের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভাবে সস্তা হলেও, স্বাদ এবং গন্ধের গুণমানে, পাকা ফল হিসাবে সোজাসুজি খাওয়ার জন্য ভোক্তাদের পাতে খুব একটা পৌঁছতে পারেনি। এর ব্যবহার মূলত বিভিন্ন কারখানায় আমের রস বা পাল্প প্রক্রিয়াকরণের জন্য। আর আমরা খাই সেই ম্যাংগো পাল্প থেকে তৈরি আইসক্রিম, কুলফি, জ্যাম, স্কোয়াশ ইত্যাদি। এই পাল্প প্রক্রিয়াকরণের শিল্পগুলি বেশির ভাগই অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তুর জেলায়।

এ বছর তোতাপুরির একটা সঙ্কট হয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশে তোতাপুরির উৎপাদন হয়েছে ৫.৫ লক্ষ মেট্রিক টন, যেটা রাজ্যের ৩.৩ লক্ষ মেট্রিক টন পাল্প প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। প্রভূত উৎপাদন এবং জোগানে তোতাপুরির দামে ধস নেমেছে। অন্ধ্রের খোলা বাজারে, দাম কিলোপ্রতি ৪-৬ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সেটা বাজারে নিয়ে বিক্রি করার খরচের থেকে কম হওয়ায়, কৃষকরা কোথাও কোথাও তোতাপুরি ফেলে দিচ্ছেন।

সাধারণত, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও কর্নাটকে তোতাপুরির উৎপাদন হত এক-আধ মাস আগে-পরে। তার ফলে প্রক্রিয়াকরণের সংস্থাগুলিতেও এই তিন প্রদেশের আম এক সঙ্গে আসত না, আসত কয়েক সপ্তাহ আগে পিছে। ফলন আগে-পরে হওয়ায় প্রক্রিয়াকরণের সুবিধা হত। এ বছর তিনটি প্রদেশেই তোতাপুরি হয়েছে এবং পেকেছে প্রায় একই সঙ্গে, তার ফলে এত বেশি তোতাপুরি এক সঙ্গে প্রক্রিয়াকরণ অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

তোতাপুরির এই সঙ্কট থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার পাল্প প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির জন্য এই আম কেনার ন্যূনতম মূল্য কিলো প্রতি ৮ টাকা ধার্য করেছে, আর সঙ্গে সরকারের তরফ থেকে কিলোগ্রামপ্রতি ৪ টাকা অনুদান ঘোষণা করেছে। এই নিয়ম ঠিক ভাবে পালিত হলে আম চাষিরা কিলোগ্রামপ্রতি ১২ টাকা পাবেন। তা ছাড়া অন্ধ্রের তোতাপুরির অতিরিক্ত উৎপাদন এবং সরবরাহের সমস্যা যাতে আরও বড় না হয়ে ওঠে, তার জন্য পার্শ্ববর্তী কর্নাটকের জেলাগুলি থেকে তোতাপুরির জোগানের উপরে জেলাশাসকের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। কর্নাটকের চাষিরা, যাঁরা চিরাচরিত ভাবে তাঁদের তোতাপুরী অন্ধ্রের পাল্প কারখানায় পাঠাতেন, এই নিষেধাজ্ঞায় ক্ষুব্ধ। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রীও এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ করেছেন।

আপনাদের কি এ গল্প পুরনো কোনও গল্পের নতুন সংস্করণ মনে হচ্ছে? পশ্চিমবঙ্গে আলুর গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে কি? আলু পর্তুগিজ় এবং ওলন্দাজ ব্যবসায়ীরা মাত্র চার-পাঁচশো বছর আগে এ দেশে প্রবর্তন করে। হলুদ যেমন সব রান্নায় লাগে, তেমনই আলুও মাত্র কয়েক শতাব্দীতে এখন শুধু ভাজায় নয়, ঝোল, চচ্চড়ি, ঘণ্ট, শুক্তো, চপ সব কিছুতেই লাগে। গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে আলুর খুচরো বাজারের দাম কলকাতায় কিলোগ্রামপ্রতি ৪০-৪৫ টাকায় পৌঁছলে রাজ্য সরকার অন্য প্রদেশে আলু বিক্রির উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। প্রতিবেশী ওড়িশা এবং ঝাড়খণ্ড এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে সরব হয়, পশ্চিমবঙ্গের আলুচাষিরাও বিক্ষুব্ধ হন।

এ বছর আলুর অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে কৃষকরা অতিরিক্ত ৫০,০০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করেছেন, এবং ২০২৪-২৫’এ আলুর উৎপাদন ১০ লক্ষ টন বেড়েছে। রাজ্যের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন মেটানোর পর যে ৮০-৮৫ লক্ষ টন উদ্বৃত্ত থাকবে, সেটা রাজ্যের ৪৭৫টি হিমঘরে যে পরিমাণ আলু রাখা যায়, তার তুলনায় অনেক বেশি। এখন আগের ‘অন্য রাজ্যে আলু বিক্রি করা যাবে না’ নীতির আমূল পরিবর্তন করে, অন্য রাজ্যে এবং অন্য দেশে আলু বিক্রিতে উৎসাহ দিতে হবে।

আমাদের নীতির পুনর্বিবেচনা দরকার। কোনও জিনিসের দাম অতিরিক্ত ভাবে কমে গেলে তার ন্যূনতম দাম ঘোষণা করে, এবং কোনও জিনিসের দাম ভয়ানক ভাবে বেড়ে গেলে তার সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দিয়ে সরকার সমস্যার সমাধান করবে, এটা দুরাশা। যুদ্ধ লাগলে, সাময়িক আপৎকালীন অবস্থায়, দেশাত্মবোধের আবেগে এটা কাজ করতে পারে— কিন্তু অন্য সময়ে এর পরিণাম কালোবাজারের রমরমা। অতীতের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছেড়ে দিন, ভাবুন তো, পশ্চিমবঙ্গের সব ধান চাষি কি তাঁদের সব ধান ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস বা এমএসপি) বিক্রি করতে পারছেন? আর, যত ধান এমএসপি-তে বিক্রি হচ্ছে, তার সম্পূর্ণ সুফল কি কৃষকরাই পাচ্ছেন?

প্রাকৃতিক কারণে, যেমন বৃষ্টিপাতের বাড়া-কমায়, কৃষিতে উৎপাদন কখনও বেশি কখনও কম হবেই। উৎপাদন কম হলে দাম বাড়বে, বেশি হলে কমবে। যে-হেতু দামের কমা-বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যদ্রব্যের প্রয়োজন এবং চাহিদার বেশি তারতম্য হয় না, সে-হেতু উৎপাদনের ওঠা নামার সঙ্গে সঙ্গে দাম খুব বেশি রকম ওঠা নামা করে। দাম খুব বেশি বাড়লে উপভোক্তাদের, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের সমস্যা বাড়ে; আর দাম খুব কমে গেলে কৃষকদের মাথায় হাত। এই দামের উথালপাথাল থেকে মুক্তির উপায় হল, যখন অতিরিক্ত উৎপাদন হবে, তখনই সেই উদ্বৃত্তকে পরবর্তী ঘাটতির জন্য সংরক্ষণ করা; এবং প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে আমকে জ্যাম, পাল্প, আমসত্ত্ব, স্কোয়াশ বানিয়ে রাখা, আলুকে চিপস, ভুজিয়া ইত্যাদি বানিয়ে রাখা। আর কোনও বিকল্প রাস্তা নেই।

একটা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় সাড়ে সাত কোটি টন খাদ্যবস্তু নষ্ট হয়। কারণ এই সব খাদ্যসামগ্রী যথাযথ ভাবে— যেমন, যেখানে ইঁদুর খাবে না সে রকম কোনও জায়গায়, বা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গুদামে, এবং কাঁচা আনাজ বা পাকা ফল প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে— সংরক্ষণ করি না; দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেখানে এই সব দ্রব্যের চাহিদা আছে, সেখানে সঠিক পরিবহণের মাধ্যমে পাঠাই না। এই সুবিধাগুলি না থাকাতে, ফসল ওঠার পর কৃষকরা দেরি না করে যে ভাবেই হোক যে দামেই হোক তা বিক্রি করতে উদ্যোগী হন। গ্রামেগঞ্জে যথার্থ দাম না পেলে, তাঁরা নিজের টাকা খরচ করে দূরদূরান্তে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে, অনেক আনাজ, ফলমূল রাস্তায় মাঠে ঘটে ফেলে দেন। এ এক অসহনীয় অপচয়।

অন্ধ্রের তোতাপুরি আমই হোক বা পশ্চিমবঙ্গের আলুই হোক, অন্য প্রদেশের থেকে লেনদেনে এই এক বার চালু এক বার বন্ধ নীতি কৃষির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পরিপন্থী। এর সুচারু সমাধান হবে হিমঘর এবং প্রক্রিয়াকরণ পরিকাঠামো বৃদ্ধি থেকে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বলে, সরকারি সংস্থা দিয়ে এই কাজটি হবে না। সুতরাং, এই ব্যবসায় বেসরকারি বিনিয়োগ কেন এগিয়ে আসছে না, এ বিষয়ে অনুসন্ধান দরকার। সে কারণটি যা-ই হোক, তাকে অবিলম্বে দূর করতে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Conservation

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy