Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Indian Economy

পরিকাঠামোর কোন দিকে খরচ বাড়ালে অতিমারি-জনিত ক্ষয়ক্ষতি কাটাবে ভারত?

মানবোন্নয়নের দু'টি মূল জায়গা— শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ভারত পিছিয়ে পড়ছে। কোন উপায়ে এ থেকে উত্তরণ সম্ভব?

অতিমারির পরে কোন খাতে উন্নয়ন?

অতিমারির পরে কোন খাতে উন্নয়ন? প্রতীকী ছবি।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৫:৫৮
Share: Save:

কোভিড অতিমারির যে মাঝারি সময়পর্বের ক্ষয়ক্ষতির প্রবাহ বিভিন্ন দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল, ভারত তার বাইরে ছিল না। এই ক্ষয়ক্ষতির এক পূর্ণাঙ্গ হিসাব নিতে গেলে দেখা যায়, ২০২০ এবং ২০২১-এর মধ্যে দেশগুলির ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স’ (এইচডিআই) বা মানবোন্নয়নের সারণি (যার মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং আয়কে একত্রে ধরা হয়) এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। কয়েক দশকব্যাপী ধীর অথচ নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতির পর ভারত সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল ও শিক্ষা— এই ক্ষেত্র দু’টিতে বিশেষ করে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ২০২১-এ এইচডিআই সূচকে পতন ২০২০-র থেকে বেশি ছিল। এই মুহূর্তে ভারত এইচডিআই সূচক অনুযায়ী ২০১৫ সালের নিরিখে সামান্য উপরে রয়েছে।

এই সব ক্ষয়ক্ষতির কিছুটা দ্রুত পূরণ করা সম্ভব। কোভিডের ফলে তৈরি হওয়া মৃত্যুতরঙ্গের স্ফীতি কমলে দু’বছরের মধ্যে সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল সংক্রান্ত ক্ষতি পূরণ হওয়া অসম্ভব নয়। সে তুলনায় শিক্ষাক্ষেত্রে ধস সামলে দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার বিষয়টি বরং বেশ দুরূহ। মানবোন্নয়নের সারণি সংক্রান্ত কিছু বিষয়ের ক্ষয়ক্ষতি হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু তাতে অন্য দেশগুলির তুলনায় ভারতের অবস্থানের তেমন হেরফের হবে বলে মনে হয় না। ২০২১ থেকে ছ’বছর পিছিয়ে গিয়ে হিসাব নিলে দেখা যাবে, সারণিতে ভারত ১৩১ থেকে ১৩২-এ নেমে এসেছে। এটিকে কখনই কোনও বড় পতন বলা যায় না। এ থেকে এ-ও বোঝা যায় যে, সারণিতে পূর্বতন অবস্থান থেকে নেমে আসার বিষয়টি পরিস্থিতির সাপেক্ষে স্বাভাবিকই ছিল। আসলে, কোভিড পরিস্থিতির মোকাবিলায় বহু দেশ সফল হয়েছে। আবার অনেকেই এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

আরও দু’টি বিষয় লক্ষ করার মতো। প্রথমত, বাংলাদেশের মতো দেশ আয় ছাড়া অন্য ক্ষেত্রগুলিতে সারণির বেশ খানিকটা উপরের দিকেই থাকে। সে ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ঠিক বিপরীত। সুতরাং যখন বাংলাদেশে আয়ের পরিমাণ স্বল্প ছিল, ভারত তখন সারণিতে বেশ কিছুটা উপরেই ছিল। আবার কোভিডপর্বে মানবোন্নয়ন সংক্রান্ত সূচকগুলির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুব বেশি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়নি বলা যায়। তুলনায় ভারত স্বাস্থ্য ও আয়ের ক্ষেত্রে খুব খারাপ অবস্থানে রয়েছে। আয়ের ক্ষেত্র বাদ দিলে ভারতের অবস্থান সারণিতে ছয় ধাপ নীচে নেমে আসবে। সে দিক থেকে দেখলে এ কথা বলা যেতেই পারে যে, আয়স্তরের তুলনায় ভারতের গণস্বাস্থ্য এবং শিক্ষাগত অবস্থান যে মাত্রায় পৌঁছনোর কথা ছিল, তা ঘটেনি। অন্তত কিছু সময়ের জন্য এ তথ্য সত্য তো বটেই।

দ্বিতীয়ত, ভারত যেখানে মানবোন্নয়নের নিরিখে একটি ‘মধ্যম মান’-এর দেশ হিসাবে থেকে গিয়েছে, ভিয়েতনাম সেখানে ‘উচ্চ’ পর্যায়ে উঠে এসেছে। মালয়েশিয়া বা তাইল্যান্ডের মতো অন্যান্য এশীয় প্রতিবেশী দেশ ‘অত্যুচ্চ’ স্তরে পৌঁছে গিয়েছে। যদি ভারতকে তার প্রাক্‌-অতিমারি পর্বের সূচকে উঠে আসতে হয়, তা হলে এই ‘মধ্যম’ থেকে ‘উচ্চ’ পর্যায়টিতে পৌঁছতে ২০৩০ পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। অন্য ভাবে দেখলে, সারণিতে ভারতের অবস্থান মোটামুটি ভাবে সেখানেই, যেখানে এই শতক শুরু হওয়ার সময়ে চিন অবস্থান করছিল। সেই হিসাবে দেখলে ভারত দু’দশক পিছিয়ে আছে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে তার এই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফারাক এতখানি বেশি যে, দেশ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি বৃত্তে অবস্থান করছে বললে ভুল হবে না।

তা সত্ত্বেও আয়ের তুলনায় স্বাস্থ্য আর শিক্ষার ক্ষেত্রে ফারাক কমানোর দিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। সেই সঙ্গে নিছক অর্থনৈতিক বৃদ্ধির থেকে বৃহত্তর কিছুর দিকে প্রাথমিক লক্ষ্য স্থির করাও জরুরি। এই মুহূর্তে ভারত বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলির মধ্যে দ্রুততম বৃদ্ধির দেশ। সে তুলনায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে তার উন্নতির ছবিটি কিন্তু বছরে বছরে তেমন উল্লেখযোগ্য ভাবে বদলায় না। সার্বিক ভাবে সামর্থ্যকে গড়ে তোলার যে বর্ণনা উন্নয়নের বিষয়ে অমর্ত্য সেন রেখেছেন, সেই বিষয়টিকে এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার।

এই বিষয়ে তর্কবিতর্ক থেকে বার বার স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয়ের ঘাটতির কথা উঠে আসে। এই দুই ক্ষেত্রেই ভারত পিছিয়ে থাকা একটি দেশ। এখানে বেসরকারি পক্ষের ব্যয় সরকারি খরচকে ছাপিয়ে যায়। অর্থনৈতিক ভাবে খানিক পিছিয়ে থাকা মানুষের ক্ষেত্রে তা অসুবিধার কথাই তুলে ধরে। অন্য দিকে আঞ্চলিকতার বিষয়টিকেও মনে রখতে হবে, যেখানে ‘বিমারু’ (বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশ নিয়ে গঠিত অঞ্চল। এই বিশেষ অভিধাটি ১৯৮০-র দশকের মধ্যভাগে তৈরি করেছিলেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আশিস বসু। এখানে ‘বিমার’ বা ‘ব্যাধিগ্রস্ত’ শব্দটির সঙ্গে অভিধাটির ধ্বনিগত সাযুজ্য লক্ষণীয়) হিসাবে পরিচিত অঙ্গরাজ্যগুলি দুর্বলই থেকে যায় এবং জাতীয় স্তরে গড় হিসাব গ্রহণের সময় পরিসংখ্যানকে নিম্নগামী করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তামিলনাড়ুর তুলনায় বিহারে শিশুমৃত্যুর হার আড়াই গুণ বেশি।

সকলের জন্য স্বাস্থ্যবিমার (যা তা বহন করতে অপারগ মানুষের জন্যও প্রযোজ্য) মতো উদ্যোগ অবশ্যই অবস্থার উন্নতি ঘটাবে। কিন্তু খুব বেশি ঘটাবে কি? সুতরাং যখনই সরকারি ব্যয়ের কথা উঠে আসে, নরেন্দ্র মোদীর সরকার সামাজিক পরিকাঠামোর চেয়ে অনেক বেশি করে ‘ফিজিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ (কোনও দেশের অর্থনীতির টিকে থাকার জন্য যা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। যেমন— সড়ক, যোগাযোগ, জল সরবরাহ, নিকাশিব্যবস্থা, শক্তি সরবরাহ ইত্যদি)-এর উপর জোর দেয়। এই বিষয়টি পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। সাম্প্রতিক কালে ফিজিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচারের উন্নয়নে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করা হচ্ছে। এটি যে খুব ভাল উদ্যোগ, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সামাজিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাসে ব্যয়ের বিষয়টিকেও অবহেলা করা যায় না। এই দুই ক্ষেত্রেরই উন্নয়নের প্রয়োজন থেকে যাচ্ছে। অমর্ত্য সেন-বর্ণিত ‘কেপেবিলিটি বিল্ডিং’ বা ‘সামর্থ্য নির্মাণ’ (অর্থাৎ, মানসিকতা, আচরণ এবং দক্ষতার পুনর্বিন্যাস ও ক্ষমতায়ন দ্বারা সামগ্রিক অর্থে সামর্থ্যের সম্ভাবনাকে বার করে আনা) বিষয়টিকে যথাযথ ভাবে বোঝা ও তাকে পূর্ণ অর্থে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা এই মুহূর্তেই প্রয়োজন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE