ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে প্রায় হেরে যাওয়া চতুর্থ টেস্ট ড্র করল ভারত। শুধু এই ম্যাচটিতে নয়, এ বারের ভারত-ইংল্যান্ডের সিরিজ়ের প্রতিটি টেস্ট ম্যাচ টানটান উত্তেজনা বজায় রেখেছে। ভারতের টিভি চ্যানেলের টিআরপি তো বেড়েছেই; স্টেডিয়াম উপচে পড়েছে দর্শকে। টেস্ট ক্রিকেটের চমৎকার বিজ্ঞাপন, সন্দেহ নেই।
গত শতাব্দীর আশি-নব্বইয়ের দশকের আগে যাঁরা ক্রিকেট দেখেছেন, তাঁদের কাছে ক্রিকেট মানেই ছিল টেস্ট ক্রিকেট। আমাদের মধ্যে অনেকেই আজও মনেপ্রাণে চাই যে, টেস্ট ক্রিকেটের জয় হোক। কিন্তু আবেগ হেরে যায় বাজারের কাছে— আধুনিক অর্থনীতিতে স্মৃতির কোনও বিক্রয়মূল্য নেই। আইপিএল-এর মতো টি২০ প্রতিযোগিতার অর্থনৈতিক মডেল ক্রিকেটবিশ্বকে শাসন করছে এবং করবে— এটাই বাস্তব। সাদা বলের ক্রিকেট এখন আলাদা একটা পণ্য, যার চাহিদা টেস্ট ম্যাচের থেকে অনেক গুণ বেশি। অতএব, অর্থনীতির পুস্তকের সহজ তত্ত্ব অনুযায়ী টেস্টের বিক্রয়মূল্য তাই কম। ধোনির মতো খেলোয়াড়রা তাই টেস্ট থেকে অনেক আগেই অবসর নিলেও, আইপিএল খেলতে থাকেন, আমরাও ফি-বছর একই রং আর রঙ্গ দেখতে মাঠে যাই, টিভির সামনে বসি।
টেস্ট ক্রিকেটকে পুনরায় আকর্ষণীয় করে তুলতে সম্প্রতি আইসিসি বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছে। দু’বছর ধরে পয়েন্ট-ভিত্তিক বিশ্ব টেস্ট চাম্পিয়নশিপ চালু হওয়াতে প্রতিটি টেস্ট ম্যাচে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। টেস্ট পরিচালনার ক্ষেত্রেও অনেক নিয়মকানুন বদলেছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে খেলার মাঠ ও পিচ রক্ষণাবেক্ষণে উন্নতি হয়েছে; অতিবৃষ্টির পরেও মাঠ তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়, খেলা বেশি ক্ষণ বন্ধ থাকে না। এ সব কারণে আজকাল টেস্ট ম্যাচে ড্র হয় কম; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খেলা শেষে, এমনকি নির্ধারিত পাঁচ দিনের অনেক আগেই, ফলাফল মেলে। খেলোয়াড়রাও আজকাল মেরে খেলেন। কয়েক দশক আগের তুলনায়, টেস্টে গড়ে ওভার প্রতি রান অনেক বেশি হয়। বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ ধরার নতুন কসরত পাঁচ দিনের ম্যাচেও আজকাল হামেশাই দেখা যায়। দর্শকরাও অনেক বেশি মাঠে যাচ্ছেন টেস্ট ম্যাচ দেখতে। এবং তা কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট দলের জন্য নয়, গোটা দুনিয়াতেই এই প্রবণতা বাড়ছে।
টেস্ট ম্যাচকেও যে নতুন অর্থনীতির মোড়কে পেশ করা যায়, তার প্রমাণ মিলছে। স্মৃতি বা আবেগের বাজার না থাকলেও, আধুনিক ভোগবাদে ঐতিহ্য ও পরম্পরার একটা মূল্য আছে। ‘হেরিটেজ টুরিজ়্ম’-এর মতোই টেস্ট ক্রিকেটকে ঐতিহ্যময় করে তুললেই চাহিদা বাড়বে। ইংল্যান্ডে ঠিক এ ভাবেই সাদা বলের পাশাপাশি টেস্ট ক্রিকেটও দিব্যি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। পিছনের অর্থনৈতিক মডেলটা স্পষ্ট। ইংল্যান্ডে ক্রিকেট খেলার ‘প্রাইমটাইম’ হল গ্রীষ্মকাল— ক্রিকেট দুনিয়ার ক্যালেন্ডারে যে দেশে যা-ই ঘটুক না কেন, ওই কয়েক মাসে ইংল্যান্ডে দুটো টেস্ট ম্যাচ সিরিজ় হবেই, এটাই পরম্পরা। যেমন, টেনিসের উইম্বল্ডন জুলাইয়ে হবেই।
এ-হেন ঐতিহ্য আমাদেরও ছিল। ছোটবেলায় শীতের ছুটির অন্যতম অঙ্গ ছিল ইডেনের টেস্ট। ১৯৫৯ থেকে ১৯৮৭, এই আটাশ বছরে ইডেনে ১৯টা টেস্ট ম্যাচ হয়েছিল; তার মধ্যে ষোলোটাই হয়েছিল শীতের মরসুমে— ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে। আমরা এই পরম্পরা ধরে রাখিনি— রাখতে চাইনি, বা পারিনি। আগামী ১৪ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সিরিজ়ের প্রথম টেস্ট ম্যাচ ইডেনে হবে। আমাদের ঘরের মাঠে শেষ বার টেস্ট হয়েছিল ২০১৯-এর ২২ নভেম্বর, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০২৫, এই আটাশ বছরে ইডেনে এ বারের টেস্টটা ১৫তম। এই পনেরোটার মধ্যে একটাও খেলা শীতের দু’মাসে হয়নি। আমরা আইপিএল-কে রক্ষা করার তাগিদে ইডেনের টেস্টকে বলি দিয়েছি।
এই একই পর্বে লর্ডস-এর টেস্ট ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে ১৯৯৮, ১৯৯৯-এ একটা করে টেস্ট হয়; তার পরে, ২০০০ থেকে প্রতি বছর— কোভিডের জন্য ২০২০ বাদ দিলে— দুটো করে টেস্ট। পরম্পরার আর এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ মেলবোর্নের ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট ম্যাচ— ১৯৯০ থেকে প্রতি বছর, ২৬ ডিসেম্বর শুরু হয়েছে, এমনকি কোভিডের মধ্যেও।
সময় ছাড়াও, পরম্পরার আর এক অঙ্গ হল স্থান। লর্ডস-এর মাঠে যেমন প্রতি বার টেস্ট হবেই, ঠিক তেমন এজবাস্টন, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে টেস্ট ম্যাচ প্রতি বছর আসবেই। ভারত-অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ় যে দলই খেলুক না কেন, বার্মিংহামের পঁচিশ হাজারি মাঠ তাই প্রতি বছরই ভর্তি হয়। ১৯৯৮ থেকে ২০২৫— এই পর্বে বার্মিংহামের এজবাস্টনে চার বার টেস্ট হয়নি, বাকি চব্বিশ বারই হয়েছে। তুলনায়, আমাদের দেশে টেস্ট খেলার কেন্দ্র সংখ্যায় অনেক বেড়েছে; ফলে ইডেনের মতো ঐতিহ্যময় কেন্দ্রে ম্যাচ কমেছে।
টেস্ট ম্যাচ কিন্তু এখনও দর্শক টানতে সক্ষম। অনেকেই আজও পাঁচ দিনের ম্যাচের লড়াই দেখতে চান। প্রতি বলে ব্যাট হাঁকড়ানো নয়, বরং লাইন-লেংথ বুঝে ঠিক সময়ে ব্যাট সরিয়ে নিয়ে বল ছাড়তে দেখলে হয়তো অনেকেরই মনে পড়ে জীবনের কথা। তাঁদের জন্য টেস্ট ম্যাচ বাঁচবে। তবে, ভারতেও বাঁচবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর দেশের ক্রীড়া প্রশাসনকেই খুঁজতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)