Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Agriculture

দেশি ধানেই বেশি লাভ

কৃষি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে দেশি ধানের চাষ করে লাভবান হচ্ছেন ঝাড়গ্রাম জেলার চাষিরা। এ ক্ষেত্রে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে জেলা কৃষি দফতরও। কৃষি দফতরের তথ্য বলছে, জেলার নয়াগ্রাম, বেলপাহাড়ি ও লালগড় ব্লকে জৈব পদ্ধতিতে দেশি ধান চাষ করে ভাল ফলন হচ্ছে। গত তিন-চার বছর ধরে চার হাজারেরও বেশি চাষি জৈব পদ্ধতিতে দেশি ধান চাষ করছেন। তবে এখনও দেশি ধান চাষের বিষয়ে জানেন না জেলার অনেক চাষিই।

চলছে দেশি ধানের চাষ। (ইনসেটে) চাষ পরিদর্শনে ঝাড়গ্রাম জেলার উপ-কৃষি অধিকর্তা অনুপম পাল। নিজস্ব চিত্র।

চলছে দেশি ধানের চাষ। (ইনসেটে) চাষ পরিদর্শনে ঝাড়গ্রাম জেলার উপ-কৃষি অধিকর্তা অনুপম পাল। নিজস্ব চিত্র।

কিংশুক গুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২০ ০১:৫৭
Share: Save:

রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের প্রয়োগ ছাড়াই মাঠের ধান গোলায় তুলতে পেরে হাসি চওড়া হচ্ছে চাষিদের। গোবর সার, জীবাণু সার, নিমখোল, অ্যাজোলা (জলজ ফার্ন), ধান মিলের ছাই— এ সবই সার ও কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করে একেবারে দেশীয় পদ্ধতিতে ঝাড়গ্রাম জেলায় চাষ হচ্ছে ‘কেরালা সুন্দরী’, ‘কালাভাত’, ‘মল্লিফুলো’-র মতো দেশি ধান। দেশি ধান চাষ করলে কম খরচে অধিক লাভ, সেটা বুঝেছেন ঝাড়গ্রাম জেলার নয়াগ্রাম, বেলপাহাড়ি ও লালগড় ব্লকের চাষিরা। কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, করোনা পরিস্থিতিতে বিষ মুক্ত জৈব ধান রোগ প্রতিরোধে সহায়কও বটে।

কৃষি দফতরের তথ্য বলছে, জেলার নয়াগ্রাম, বেলপাহাড়ি ও লালগড় ব্লকে জৈব পদ্ধতিতে দেশি ধান চাষ করে ভাল ফলন হচ্ছে। গত তিন-চার বছর ধরে চার হাজারেরও বেশি চাষি জৈব পদ্ধতিতে দেশি ধান চাষ করছেন। তবে এখনও দেশি ধান চাষের বিষয়ে জানেন না জেলার অনেক চাষিই। তাই জেলা কৃষি দফতরের খামারে প্রদর্শনমূলক চার ধরনের দেশি ধানের চাষ করানো হচ্ছে। ঝাড়গ্রাম জেলার উপ-কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) অনুপম পাল একজন কৃষি বিজ্ঞানীও। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে দেশি ধান নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন তিনি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে দেশি ধানের বীজও সংগ্রহ করেছেন। বাংলাদেশ, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কায় দেশি ধানের চাষ সরোজমিনে দেখার অভিজ্ঞতাও রয়েছেন তাঁর। এর আগে অনুপম পাল প্রায় দু’দশক নদিয়ার ফুলিয়ায় কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সহ-অধিকর্তা থাকাকালিন ৪০০ রকমের দেশি ধানের চাষের পদ্ধতি এবং ধান সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি ওই দায়িত্বে থাকাকালিন মূলত তাঁরই উদ্যোগে বছর তিনেক আগে ঝাড়গ্রাম জেলায় দেশি ধান চাষ শুরু হয়।

মাস চারেক হল তিনি ঝাড়গ্রাম জেলার উপ-কৃষি আধিকর্তার দায়িত্বে এসেছেন। তিনি জানাচ্ছেন, দেশি ধান চাষের ক্ষেত্রে ঝাড়গ্রাম যথেষ্ট সম্ভাবনাময় একটি জেলা। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে জেলার কমপ্রিহেনসিভ এগ্রিকালচারাল প্ল্যানে বলা হয়েছে, সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থার লক্ষে যথাসম্ভব রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে চাষের জন্য চাষিদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। এ রাজ্যে সাড়ে পাঁচ হাজার রকমের দেশি ধান রয়েছে। অনুপম পাল বলছেন, ‘‘এই অমূল্য সম্ভারের সঠিক মূল্যায়ন আমরা এখনও করে উঠতে পারিনি। প্রতি হেক্টর জমিতে কেরালা সুন্দরী, বহুরূপী, কেশবশাল, মেঘাডম্বরু, মধুমালা, তালমূলির মতো দেশি ধান চাষে সর্বাধিক পাঁচ থেকে ছ’টন পর্যন্ত ফলন হতে পারে।’’ রাসায়নিক সার-কীটনাশক প্রয়োগ করে আধুনিক ধান চাষেও কিন্তু একই ফলন হয়। তা হলে কেন দেশি ধান চাষে এগিয়ে আসছেন না চাষিরা? কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, একাংশ চাষি এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা লাভবানও হচ্ছেন। কিন্তু চাষিদের একটি বড় অংশের ধারণা, দেশি ধান চাষ মানে পিছিয়ে যাওয়া। অথচ বাস্তব গবেষণা বলছে, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ না করেই দেশি ধানে সমান ফলন।

নয়াগ্রাম ব্লকে ‘প্রদান’ নামে একটি সর্বভারতীয় সংস্থার মাধ্যমে ছ’টি গ্রাম পঞ্চায়েতে কেরালা সুন্দরী, মল্লিফুলো, কালাভাত, চমৎকার, সাথিয়া-র মতো নানা ধরনের দেশি ধানের চাষ হচ্ছে। নয়াগ্রাম ব্লকের চার হাজার মহিলা চাষি দেশি ধান চাষ করে রীতিমতো স্বনির্ভর হয়ে উঠেছেন। ওই মহিলাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘আমন’ নামে একটি মহিলা উৎপাদক কোম্পানি। জেলা কৃষি দফতর জানাচ্ছে, দেশি ধানের বীজও কয়েক প্রজন্ম ধরে সংরক্ষণ করে রাখা যায়। এ জন্য অবশ্য চাষিদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনায় গত পাঁচ বছর ধরে এ রাজ্যের ১৬টি জেলার ১৬টি ব্লকে দেশি ধান চাষের প্রসারে কাজ চলেছে। জেলার কয়েকটি ব্লকে কৃষি দফতরের সহযোগিতায় এবং বেসরকারি সংস্থার তত্ত্বাবধানে দেশি ধানের প্রসার ও প্রচারের কাজ চলেছে। উপ-কৃষি অধিকর্তা বলছেন, ‘‘দেশি ধান যাঁরা চাষ করছেন, ফলনের পরে সেই চাষিরা আপ্লুত হচ্ছেন। তাঁদের দেখে এলাকার অন্য চাষিরাও উৎসাহিত হচ্ছেন।’’ দেশি ধানের বীজ প্রতি বছর কিনতে হয় না। দেশি ধান চাষের খরচ অনেক কম। দেশি ধানের চাল সুস্বাদু। ওড়িশার সুগন্ধী ‘মল্লিফুলো’ দেশি ধানের চাষ হচ্ছে নয়াগ্রাম ব্লকে। লম্বাদানার এই ধান ১২৫ দিনের মধ্যে পাকছে। প্রতি হেক্টরে প্রায় চার টন ফলনও দিচ্ছে। সারা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘মল্লিফুলো’ ধানের চাষ হচ্ছে নয়াগ্রাম ব্লকে। এ ছাড়াও নয়াগ্রামে প্রায় পাঁচশো হেক্টর জমিতে সুস্বাদু মোটা দানার ‘কেরালা সুন্দরী’ ধানের চাষও হচ্ছে। ‘কেরালা সুন্দরী’ দেশি ধানটি আদতে পুরুলিয়ার। খরা এবং জলজ দু’রকম এলাকায় এই ধান চাষ করা যায়।

ঝাড়গ্রাম জেলা কৃষি দফতরের খামারে প্রদর্শনমূলক যে চারটি ধানের চাষ হচ্ছে তার অন্যতম ‘খাড়া’ হল বেগুনি পাতার ধান। এটি ছত্তিসগঢ়ের দেশি ধান। যা পাকে ১৪২ দিনের মধ্যে। ওড়িশার একটি কৃষি সংস্থা থেকে বীজ সংগ্রহ করেছেন অনুপমবাবু। এই ধানের ছ’ফুট উচ্চতার চওড়া বেগুনি পাতায় রয়েছে অ্যান্থোসায়ানিন পিগমেন্ট। এটি ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক বলে দাবি করা হয়। খাড়া ধানের কচি পাতা ভেজে পকোড়া করে খাওয়াও যায়। খাড়ার লাল চাল রীতিমতো সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। খাড়া ধানের চাল আয়রন, জিঙ্ক, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স সমৃদ্ধ। কৃষি দফতরের আশা, চলতি মরসুমে জেলায় ১০০ টন মল্লিফুলো ও ৮০ টন কালাভাত উৎপাদন হবে। ঝাড়গ্রাম জেলায় এক সময়ে কবিরাজ শাল, জংলি জটা, কালীচম্পা, দুধের সর-এর মতো বহু দেশি ধান চাষের প্রচলন ছিল। উপ-কৃষি অধিকর্তা জানান, এই সব ধানের চাষ নতুন করে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে। ঝাড়গ্রাম জেলা পরিষদের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জেলায় দেশি ধান চাষ করে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। ফলনও ভাল হচ্ছে।’’

কৃষি দফতরের সহযোগিতায় ‘সবুজ বিপ্লব’ নামেও একটি কৃষি উৎপাদক সংস্থার তত্ত্বাবধানে বেলপাহাড়ি ব্লকের হাড়দা পঞ্চায়েতের কড়াসাই মৌজা ও শিরিষবনি মৌজায় মোট ৩৫ বিঘা জমিতে ২৫ জন চাষি গত তিন বছর ধরে কালাভাত ও মোহনভোগ ধান চাষ করছেন। লালগড় ব্লকের রামগড় পঞ্চায়েতের শালুকা গ্রামের ২০ জন চাষি ২০ বিঘা জমিতে কালাভাতের চাষ করছেন। ‘প্রদান’ সংস্থার নয়াগ্রাম ব্লকের টিম কো-অর্ডিনেটর সৌরাংশু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ‘সবুজবিপ্লব’ সংস্থার অধিকর্তা শ্যামল প্রতিহার বলেন, ‘‘অনুপমবাবু ফুলিয়ার সরকারি কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সহ-অধিকর্তা থাকাকালিনই কয়েক বছর আগে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বীজ দিয়ে তিনি সহযোগিতা করেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Indigenous crops Agriculture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE