Advertisement
E-Paper

বাহা পরবে সাঁওতালদের ফাগুন-বরণ

‘বাহা’ সাঁওতালি শব্দ। বাংলায় তার আক্ষরিক অর্থ হল ফুল। ফুলে থাকে বহু রঙিন পদার্থ। পরব অর্থাৎ উৎসব। অতএব ‘বাহা পরব’ বাংলা অর্থে ‘ফুল নিয়ে পুজো ও উৎসব’। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষগুলি মিশে একাকার হয়ে যায়। লিখলেন সন্ন্যসী লোহার।‘বাহা’ সাঁওতালি শব্দ। বাংলায় তার আক্ষরিক অর্থ হল ফুল। ফুলে থাকে বহু রঙিন পদার্থ। পরব অর্থাৎ উৎসব। অতএব ‘বাহা পরব’ বাংলা অর্থে ‘ফুল নিয়ে পুজো ও উৎসব’। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষগুলি মিশে একাকার হয়ে যায়। লিখলেন সন্ন্যসী লোহার।

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৯ ০০:২০
রীতি: বাড়িতে পালন করা হচ্ছে বাহা পরব।  ছবি: লেখক

রীতি: বাড়িতে পালন করা হচ্ছে বাহা পরব। ছবি: লেখক

বোলপুর শান্তিনিকেতন রেল স্টেশন থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে আছে এক আদিবাসী সাঁওতাল গ্রাম ঘোষালডাঙ্গা। ভাবতে অবাক লাগে, দেখতে দেখতে তিরিশ বছর পূর্ণ হল এই গ্রামের ‘বাহা পরব’ উপলক্ষে সর্বজনীন মেলার। ঘোষালডাঙ্গা এবং লাগোয়া সাঁওতাল গ্রাম বিষ্ণুবাটী, এই দুই গ্রাম মিলে ঐতিহ্যপূর্ণ পরব-মেলার উদ্বোধন হয়ে গেল গত ১৬ মার্চ, ঘোষালডাঙ্গা ফুটবল প্রাঙ্গণে। সারা দিন ও রাতের অনুষ্ঠানটি সাঁওতালি পরম্পরা মেনে সূচনা হয়। দূর-দূরাদূরান্ত থেকে সাড়ে পাঁচ হাজারের ও বেশি দর্শকের সামনে মহিলা ও পুরুষেরা তাঁদের জাঁকজমকপূর্ণ নাচ ও গান পরিবেশন করলেন। এ বছর আদিবাসী মাহালী সম্প্রদায় নিবেদিত কালাচাঁদ মাহালী রচিত ও নির্দেশিত নাটক ‘কুড়বি বাহা’ বহু মানুষের মন জয় করতে পেরেছে। আদিবাসী ও সাঁওতাল জগতের অভিনেত্রী হিসাবে এ বছরের ‘বাহা পুরস্কার’ প্রদান করা হল ঝাড়খণ্ড থেকে আগত বিরবাহা হাঁসদাকে। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন আরও বেশ কিছু গুনীজন।

এই বাহা মেলা আরম্ভ হয়েছিল ১৯৮৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। গুটি কয়েক মানুষ নিয়ে শুরু হয়েছিল পথ চলা। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ঘোষালডাঙ্গা গ্রামের পক্ষ থেকে সর্দার স্বর্গত রেংটু সরেন, সোনা মুর্মু, জার্মানি থেকে আগত রবীন্দ্র গবেষক, সমাজকর্মী ও সাংবাদিক মার্টিন কেম্পচেন (মার্টিনদা), স্নেহাদ্রি শেখর চক্রবর্তী, দেবু মুর্মু গিরি, মোড়ল মুর্মু, গৌতম সেন, স্বর্গত দেবজ্যোতি গঙ্গোপাধ্যায়, স্বর্গত কাঞ্চন ভদ্র, শ্রী অসিম দেব এবং ঘোষালডাঙ্গার আরও কিছু সদস্য।

মেলা ও বাহা পরব, দু’য়ের মধ্যে অনেকটাই ভিন্নতা। মেলা হছে আমজনতার যোগদান, দেখাসাক্ষাৎ এবং আনন্দ বিনোদনের জায়গা। পরব হছে পূজাবিধি, ব্যক্তিগত, পরিবার ভিত্তিক, গ্রাম ভিত্তিক কিংবা জাতি ও সম্প্রদায় ভিত্তিক।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বলা হয়, যখন ফাল্গুন মাস আসার সময় হয়, বন জঙ্গলের মাঝে টুডু সম্প্রদায়ের যুবকেরা রমনীদের নৃত্যরসে আপ্লুত হয়ে নিঃস্বার্থ প্রেমের বিনিময়ে আকৃষ্ট হয় প্রকৃত এক শাল গাছের তলে।

ফাগুন থেকে ফাগ অর্থাৎ রং জাতীয় পদার্থ। ‘বাহা’ সাঁওতালি শব্দ। বাংলায় তার আক্ষরিক অর্থ হল ফুল। ফুলে থাকে বহু রঙিন পদার্থ। পরব অর্থাৎ উৎসব। অতএব ‘বাহা পরব’ বাংলা অর্থে ‘ফুল নিয়ে পুজো ও উৎসব’। আদিবাসী সাঁওতাল সমাজে নানা উৎসব মানেই নাচ-গানের মহড়া। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষগুলি মিশে একাকার হয়ে যায়। এ সময় সাঁওতাল তরুণীরা নতুন নতুন ফুল তাঁদের খোঁপায় গেঁথে আনন্দে নাচে-গানে মেতে ওঠেন। সাঁওতালদের পূর্বপূরুষেরা বলতেন, বাহা পরব এক সময় বনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আদিবাসী মনেও প্রকৃতির সমস্ত বস্তু প্রাণের সম বা ঈশ্বরতুল্য। তারপর আসে পুজো-পার্বণ। খোঁজা হয় বিভিন্ন দেব-দেবীকে। সব দেব-দেবীই আদিবাসী সমাজে নাকি প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুর মাঝেই বিরাজমান। তাই প্রকৃতির সমস্ত সৃষ্টি তাঁরই ইচ্ছায়।

ভারতের বিভিন্ন জেলায় ও রাজ্যে বিশেষ করে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ড, বিহার, অসম এমনকি বাংলাদেশেও সাঁওতাল, ওরাং, মুন্ডা এবং অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায় বাহা পরব উৎসবটি আন্তরিকতার সঙ্গে উদ্‌যাপন করেন। প্রতি বছরই ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের মাঝামাঝি এই পরবটি উদ্‌যাপিত হয়ে থাকে। এই পরব প্রকৃতপক্ষে বসন্ত ঋতুতেই পালিত হয়।

বাংলায় প্রবাদ আছে, বারো মাসে তেরো পার্বণ। বাঙালিদের নববর্ষ হয় বৈশাখে। প্রিয়জনদের জানানো হয় প্রীতি ও শুভেচ্ছা। আদিবাসী সাঁওতাল সমাজে তেরো পার্বণ না থাকলেও বারোটি মাসের কথা সব সাঁওতালরাই জানেন। দীর্ঘদিন ধরে এই বারোটি মাসের উল্লেখযোগ্য পূজো-পার্বণগুলি সাঁওতাল সমাজ পূর্বসূরিদের আমল থেকে পালন করে আসছে। অনেকে বলে থাকেন, সাঁওতালদের বিভিন্ন পরবের মধ্যে সেরা ‘বাঁদনা’, আবার কেউ কেউ বাহা পরবকেই বৃহত্তম উৎসব হিসাবে বিবেচিত করেন। কেননা সাঁওতালদের মাঘ মাস যদি বছরের শেষ মাস হয়, তবে ফাল্গুন মাসটি নিঃসন্দেহে ধরা হয় সাঁওতালিতে ‘নাওয়া সিরমা’ বা নতুন বছর। বাংলা নববর্ষে প্রথম মাসে নতুন করে চাওয়াপাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে, সব কিছুকে ভালভাবে গ্রহণ করার ইচ্ছা হয়।

ঠিক তেমনই সাঁওতালদের ‘নাওয়া সিরমা’য় প্রত্যাশা থাকে, নতুন দিনগুলি অন্যরূপে প্রকৃতিতে দেখা দিক। শীতের পরেই বসন্ত। সেই বসন্তে প্রকৃতিতে ফুটে ওঠা ফুল, লতা ও পাতা সঙ্গে প্রাণী ও জীবকূলের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠুক—এটাও চাওয়া হয়। আদিবাসী সাঁওতাল সমাজে এখনও গ্রাম্য মোড়লগোষ্ঠী দ্বারা নানা সামাজিক আচার-সংক্রান্ত বা অনুষ্ঠানের ক্রিয়াকর্মগুলি পরিচালিত হয়ে আসছে। কথিত আছে, অভ্যর্থনা জানাতে গেলে মোড়লগোষ্ঠীদের সব থেকে বেশি বিধি পালন করতে হয়।

বাহা পরবের জন্য নির্দিষ্ট একটি পুজার স্থান থাকে। একে সাঁওতালেরা ‘জাহের থান’ বলেন। পরবের সূচনায় গ্রামের দু’জন অবিবাহিত পুরুষ পবিত্র দেহ-মনে জঙ্গল থেকে শালফুল সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। মাটির তৈরি ঘটে পরিষ্কার জল কাঁধে নিয়ে জাহের থানে মোড়লদের সঙ্গে গ্রামের লোকজনও হাজির হন। নাইকে বাবা (প্রধান পুরোহিত) পরিষ্কার ধুতি পরে পুজো থানে যান। নাইকের হাতে কাঁসার থালায় থাকে নতুন ফুল। গ্রামের বেশ কয়েকটা বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা মুরগির ছানা বলিদান করে বাহা বঙ্গার আরাধনা করেন নাইকে। পরে গোধূলি বেলায় ‘টামাক’ (নাগরা) বাজিয়ে নাইকে বাবা গ্রামে প্রবেশ করেন। বাড়ির মহিলারা ছোট্ট বাটিতে সর্ষের তেল, একটা কাঁসার থালা অথবা কাঠের তৈরি পিঁড়ে (গাণ্ডু) এবং ঘটিতে জল নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। নাইকে বাবা প্রবেশ করা মাত্র পরিবারের এক জন মহিলা তেল-জল নিয়ে নাইকে বাবা ও অন্যান্যদের পা থালায় রেখে জল দিয়ে ধুয়ে কাপড়ের সাহয্যে পা মুছে তেল মাখিয়ে পরিষ্কার করে দেন। তার পর প্রথা অনুয়ায়ী চলে প্রণাম (ডবঃ) বিনিময়। শেষে নাইকে বাবা পবিত্র শান্তির শালফুল ও জল পরিবারের সদস্যদের শরীরে স্পর্শ করিয়ে আশীর্বাদ নিবেদন করতে থাকেন। এটা বিশ্বাস করা হয়, নাইকে বাবা যে দিক দিয়ে পদচারণ করে বাড়িতে বাড়িতে যান, সেই জায়গার প্রতিটি বস্তু যেন পবিত্র হয়ে যায়।

(লেখক স্কুলশিক্ষক ও চিত্রশিল্পী, মতামত ব্যক্তিগত)

Holi Celebration Holi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy