Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

১৬৬০ সালের মানচিত্রে দেখা মিলল জলঙ্গি নদীর

ভেন-ডেন-ব্রুক সাহেব তাঁর প্রকাশিত মানচিত্রে জলঙ্গি নদীর ধারাকে চিহ্নিত করছেন। তিনি এই ধারাটির নাম দেন ‘দি গ্যালগাটিস স্প্রুইস’। লিখছেন সুপ্রতিম কর্মকারডাচ সাহেবেরা বাংলা পরিভ্রমণ করছেন। বাণিজ্যের জন্য তাঁদের উপযুক্ত পথ খুঁজতে হবে। আর তাই তাঁরা চষে ফেলছেন বাংলার নদীপথ, উপকূল ভাগ। সঙ্গে তৈরি করা শুরু হল বাংলার নদীর মানচিত্র।

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৯ ০২:২৯
Share: Save:

সালটা ১৪৯৮। কম্পাস আবিষ্কার হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে দিক নির্ণয় করতে অসুবিধা হবে না। আর এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বড় জাহাজে চেপে পর্তুগিজরা বেরিয়ে পড়েছিল বাণিজ্যে। হঠাৎ তারা আবিষ্কার করে ভারতবর্ষকে। বাণিজ্যই তাদের একমাত্র ভাবনা। কাজেই তাদের মাথায় ছিল পাকাপাকি বসবাসের একটা জায়গা গড়ে তুলতে হবে। এই ভাবনাকে মাথায় রেখে তারা ১৫১০ সালে গোয়াতে ঔপনিবেশিক কলোনি গড়ে তুলল। আর চট্টগ্রাম ও হুগলিতে ১৫৫০ সালে।

ডাচ সাহেবেরা বাংলা পরিভ্রমণ করছেন। বাণিজ্যের জন্য তাঁদের উপযুক্ত পথ খুঁজতে হবে। আর তাই তাঁরা চষে ফেলছেন বাংলার নদীপথ, উপকূল ভাগ। সঙ্গে তৈরি করা শুরু হল বাংলার নদীর মানচিত্র। ভূবিদ্যার অন্য খুঁটিনাটি বিষয়কে নিয়ে ডাচরা মাথা ঘামায়নি। কেবল মাত্র নৌ চলাচলের পথকেই তারা খুঁজেছিল। সঙ্গে খুঁজেছিল নদী বন্দরগুলোকেও।

বাংলার প্রাচীনতম মানচিত্রের মধ্যে যা পাওয়া যায়, তা হল জ্যাও-ডি-ব্যারোসের মানচিত্র। ১৫৫০ সাল থেকে ১৬১৫ সাল পর্যন্ত সময়কালের নদীর পথকে এই মানচিত্রের মধ্যে ধরা রয়েছে। ব্যারোস তাঁর এই বাংলার মানচিত্রের নাম দিয়েছিলেন ‘ডেস্ক্রিপকাও ডু রিন ডি বেঙ্গালা’। যার বাংলা অর্থ হল বাংলা প্রদেশের বর্ণনা। এই মানচিত্রটি প্রকাশ পায় ১৭১৫ সালে। এ দিকে সুইজারল্যান্ডের বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবাস্টিয়ান সাহেব মানচিত্রের সংস্কারের কাজে হাত লাগিয়েছেন। তিনি একাধারে যেমন গণিতজ্ঞ তেমন একজন ভূগোলবিদও। ১৫৪০ সালে তিনি প্রকাশ করলেন ‘জিওগ্রাফিয়া ইউনিভার্সিলা’ নামের এক যুগান্তকারী গ্রন্থ। যে গ্রন্থে প্রকাশ পেল ‘তাবুয়া আসিয়াই এক্স’ শীর্ষক একটি মানচিত্র। যে মানচিত্রে গঙ্গা ও সিন্ধু নদীর সম্পূর্ণ পথ আঁকা ছিল। এই মানচিত্রটি ছিল টলেমির মানচিত্রের একটি সংস্কার। যেটি করেন সিবাস্টিন মান্সটার নামে এক জন জার্মান কার্টোগ্রাফার। এই কার্টোগ্রাফার জন্মেছিলেন মেইঞ্জ শহরের কাছে নেইদারলিংঙ্গিহিম গ্রামে ২০ জানুয়ারি, ১৪৮৮ সালে। গ্রামটি খুব বিখ্যাত হয়ে ওঠে ১৪৬০ সালে। কারণ, এই গ্রামটাতেই গুটেনবার্গ আবিষ্কার করেছিলেন ছাপার পদ্ধতি। মান্সটারের সংস্কার করা মানচিত্রে গঙ্গা ‘সাবারাক্স’ নামের একটি জাগায় দু’টি ধারায় বিভক্ত হচ্ছে। তার পরে কিছুটা দূর গিয়ে গঙ্গা পাঁচটি ধারায় ভাগ হয়ে মিশছে সাগরে। কিন্তু জলঙ্গি নদীর কোনও চিহ্ন এখানে পাওয়া যাচ্ছে না।

‘ইন্ডিয়ান ওরিয়ান্টালিস’ শীর্ষক মানচিত্রটি প্রথম প্রকাশিত হচ্ছে ১৫৯৮ সালে। বার্তিয়াস ও হন্ডিয়াস সাহেব যুগ্ম ভাবে এই মানচিত্রটি প্রথম প্রকাশ করেন। তার পরে ১৬১৬ সালে আমস্টারডাম শহর থেকে ‘তাবুলাই জিওগ্রাফিকাই কন্ট্রাকটাই’ এই গ্রন্থে আবার এই মানচিত্রের পুনর্মুদ্রণ হয়। পূর্বভারতের দুষ্প্রাপ্য মানচিত্র এটি। এই মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে গঙ্গার একটি ধারা একেবারে সরাসরি বঙ্গোপসাগরে মিলিত হচ্ছে। গঙ্গার ধারাটির সঙ্গে কোনও উপনদী এখানে মিলিত হতে দেখা যাচ্ছে না। ১৬৬০ সালে ভেন-ডেন-ব্রুক সাহেব তাঁর প্রকাশিত মানচিত্রে জলঙ্গি নদীর ধারাকে চিহ্নিত করছেন। তিনি এই ধারাটির নাম দিয়েছেন ‘দি গ্যালগাটিস স্প্রুইস’। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিপ মার্চেন্ট ছিলেন এই ব্রুক সাহেব।

এই একই কোম্পানির ভেন লিলান আর একটি মানচিত্র তৈরি করেন। এই মানচিত্রটির শিরোনাম ছিল ‘নাইউইকার্ট ভ্যান্ট কোনিনকারিক বেঙ্গালা’। ১৭২৬ সালে আমস্ট্রারডাম থেকে এই মানচিত্রটি প্রকাশিত হয়। এই মানচিত্রটিকে ব্রুক সাহেবের তৈরি মানচিত্রের সংস্করণ বলা যায়। ব্রুক ও লিলান দুই সাহেবের মানচিত্রেই ভাগীরথী থেকে জলঙ্গি নদীকে আমরা বেশ পুষ্ট দেখতে পাই। একই সঙ্গে জলঙ্গি নদীর উৎসমুখকে পদ্মার কাছে অনেক চওড়া দেখা যাচ্ছে। ১৬৭৫ সালে আর একটি মানচিত্র প্রকাশিত হয় জন থ্রনটনের। মানচিত্রটির শিরোনাম ছিল ‘এ ম্যাপ অব দ্যা গ্রেটার রিভার গ্যাঞ্জেস অ্যাজ ইট এমটিথ ইট সেলফ এইটু দ্যা বে অব বেঙ্গল’। এই মানচিত্রটি তুলনায় অনেক নির্ভুল ছিল। মানচিত্রটি প্রকাশিত হয় লন্ডন থেকে। এই মানচিত্রেই দেখা যাচ্ছে প্রায় সরলরেখা বরাবর জলঙ্গি নদীটি ভাগীরথীতে গিয়ে মিশছে। ভাগীরথী যে পরিমাণ জল বহন করছে ঠিক সম পরিমাণ জল বহন করছে জলঙ্গি। এই মানচিত্রে জলঙ্গির উৎসমুখটি কিছুটা সঙ্কীর্ণ দেখাচ্ছে।

জেন ব্যাপ্টিস বারগুইগন ডি’ এনভিল ছিলেন ফ্রান্সের এক জন ‘রয়েল জিওগ্রাফার’ ও এক জন বিশিষ্ট কার্টোগ্রাফার। তাঁর জীবন কাল ১৬৯৭ থেকে ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ১৭৫২ সালে তিনি প্রকাশ করলেন ‘কার্টি ডি এল’ইন্ডি’ শীর্ষক একটি বই। এই বইটির ভিতরে স্থান পায় একটি মানচিত্র। যার নাম ছিল ‘কার্টি ডি লা’ইন্ডি ডেসি পপুর লা’কম্পাগনাই ডেস ইন্ডিস’। এই নামটির বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়াবে, ভারতের মানচিত্রের বর্ধিত বর্ণনা।

এই মানচিত্র তৈরির সময় এনভিল সাহায্য নিয়েছিলেন টলেমির মানচিত্রের, ভারতীয় ভূগোল সম্পর্কে তুর্কিদের বিভিন্ন বর্ণনা, ১৭১৯ সালের বুচেটের ও ১৭৩৪ এর বুডিরের মানচিত্রের। কাজের এই মানচিত্র ছিল অনেকটা নির্ভুল। এই মানচিত্রে জলঙ্গির ধারাকে আঁকাবাঁকা একটি ধারা হিসাবে দেখা যাচ্ছে। একই সঙ্গে ভাগীরথীর থেকে জলঙ্গি নদীর ধারাকে সঙ্কীর্ণ দেখাচ্ছে। তবে পদ্মার সঙ্গে জলঙ্গির উৎস মুখটির সংযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে উৎস মুখটি অনেকটা সঙ্কীর্ণ হয়ে গিয়েছে ১৭২৬ সালের তুলনায়।

এর পর এল সেই সময়। যে সময়টাকে মানচিত্র ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে।

লেখক নদী বিশেষজ্ঞ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

History Jalangi River
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE