নিউ ইয়ার্স রেজোলিউশন নেওয়ার পর ঠিক চারটে মাস কেটে গেছে। প্রতিজ্ঞাগুলো আদৌ মনে আছে? বেশির ভাগই করে উঠতে পারেননি, তাই তো? উঁহু, আপনার দোষ নয়। দোষ মনের। মনস্তত্ত্ববিদরা যে দোষের নাম দিয়েছেন প্ল্যানিং ফ্যালাসি।
অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী মনস্তত্ত্ববিদ ড্যানিয়েল কানেম্যান তাঁর একটা গল্প শুনিয়েছিলেন। তিনি ইজরায়েলি প্রশাসনকে বলেকয়ে রাজি করিয়েছিলেন, হাইস্কুলের সিলেবাসে জাজমেন্ট এবং ডিসিশন মেকিং ঢোকাতে হবে। প্রশাসন রাজি হল। তাঁর ওপর সিলেবাস ঠিক করার, উপযুক্ত পাঠ্য বই তৈরি করার দায়িত্ব পড়ল। তাঁর টিমের সদস্য হলেন বেশ কিছু অভিজ্ঞ শিক্ষক, কানেম্যানের কয়েক জন ছাত্রছাত্রী এবং হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এডুকেশনের তত্কালীন ডিন, সেমুর ফক্স। পাঠ্যক্রম নির্মাণে তিনি বিশেষজ্ঞ।
বছরখানেক ধরে কাজ চলল। সবাই সন্তুষ্ট, কাজ দিব্যি এগোচ্ছে। এক দিন মিটিংয়ে আলোচনা চলছিল, কী ভাবে কোনও অনিশ্চিত বিষয়ের পরিমাপ করা সম্ভব, তা নিয়ে। হঠাৎ কানেম্যানের মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল এই যে তাঁদের কাজ, এটা কত দিনে শেষ হবে, সেটাও তো অনিশ্চিত। দেখা যাক, টিমের প্রত্যেক সদস্য নিজের মনে সেটা কী ভাবে মাপছেন। তিনি সবাইকে বললেন, হিসেব-টিসেব করে একটা কাগজে লিখে ফেলুন, আপনার মতে আমাদের এই কাজ শেষ হতে কত দিন সময় লাগতে পারে। প্রত্যেকে লিখলেন। দেখা গেল, দলের সবার মতের গড় নিলে আরও দু’বছরের মধ্যে কাজটি শেষ হওয়ার কথা। যাঁরা রক্ষণশীল, তাঁরা বলেছেন বছর আড়াই, আর যাঁরা সাহসী, তাঁদের মতে বড় জোর দেড় বছর।
এ বার কানেম্যান তাকালেন সেমুর ফক্সের দিকে। তিনি পাঠ্যক্রম নির্মাণ বিশেষজ্ঞ। কানেম্যান জানতে চাইলেন, আচ্ছা, এ রকম আর কোনও পাঠ্যক্রম স্থির করার টিমে কাজ করার অভিজ্ঞতা আপনার আছে নিশ্চয়ই। ফক্স জানালেন, বিলক্ষণ আছে। কানেম্যান বললেন, আমাদের দলটা যতখানি এগিয়ে গিয়েছে, এই অবস্থা থেকে কাজ শেষ করতে অন্য দলগুলোর কী রকম সময় লেগেছে বলুন তো?
ফক্স খানিক ক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘আশ্চর্য, আমি তো এটা জানি, অথচ ভেবে দেখিনি যে আজ আমরা যে অবস্থায় আছি, যতগুলো দল অতীতে এত দূর এগিয়েছিল, তারা সবাই শেষ পর্যন্ত কাজটা শেষ করতেই পারেনি। একটা বড় অংশ মাঝপথেই হাল ছেড়ে দিয়েছে।’ কানেম্যান জানতে চাইলেন, মোটামুটি কত শতাংশ মাঝপথে কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল? উত্তর এল, ‘৪০ শতাংশ। আর, যারা শেষ পর্যন্ত কাজটা শেষ করতে পেরেছিল, তাদের কী রকম সময় লেগেছিল? ফক্স উত্তর দিলেন, অন্তত সাত বছর তো বটেই। তবে, দশ বছরের বেশি কারও সময় লাগেনি।’
কানেম্যানের এই দলে ছিলেন তিনি নিজে, বেশ কয়েক জন অতি অভিজ্ঞ শিক্ষক, মনস্তত্ত্বের গবেষক, এবং পাঠ্যক্রম নির্মাণের খ্যাতনামা এক বিশেষজ্ঞ। অথচ তাঁরাও হিসেবে কী মারাত্মক ভুল করেছিলেন! তাঁরা যে ব্যর্থ হতে পারেন, এটা তাঁদের মনেও হয়নি। তাঁদের মতো দক্ষতার অন্য দলের যে কাজ শেষ করতে কম পক্ষে সাত বছর সময় লেগেছিল, তাঁরা সম্মিলিত ভাবে ধরেই নিয়েছিলেন সেই কাজ তাঁরা বছর দুয়েকে শেষ করে ফেলবেন।
মনস্তত্ত্বের দুনিয়ায় এই সমস্যাটি পরিচিত। এর মূলে কাজ করে একটা বিশ্বাস অবচেতনে তৈরি করে নেওয়া বিশ্বাস যে, আমি যে কাজটা করব, তাতে কোনও বাধাবিঘ্ন আসতে পারে না। এবং, আর পাঁচ জনের তুলনায় আমি কাজটা অনেক ভাল ভাবে করতে পারি।
বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বারে বারেই একটা খুব সহজ এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে। যাঁরা গাড়ি চালান, তাঁদের জিজ্ঞেস করা হয়েছে, আপনার শহরে যত লোক গাড়ি চালান, তাঁদের মধ্যে দক্ষতার তুলনায় আপনি গড়ের ওপরে, না নীচে? অন্তত নব্বই শতাংশ মানুষ নিজের দক্ষতাকে গড়ের চেয়ে বেশি বলে জানান। সেটা হওয়া নিতান্ত পাটিগণিতের হিসেবেই অসম্ভব। অর্ধেক মানুষকে তো গড়ের নীচে থাকতেই হবে। কিন্তু কেউই নিজের মনে মানতে রাজি নন, তাঁর দক্ষতা গড়ের চেয়ে কম। নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন অঞ্চলে খোলা রেস্তোরাঁর মালিকদের ক্ষেত্রেও এই প্রবণতা দেখিয়েছিল আর একটা এক্সপেরিমেন্ট। সেখানে নতুন রেস্তোরাঁ খুলে সেটা চালানো খুব কঠিন কাজ। দশটা রেস্তোরাঁ খুললে অন্তত ন’টাই বন্ধ হয়ে যায় অল্প দিনের মধ্যে। কিন্তু তবুও যাঁরা নতুন রেস্তোরাঁ খোলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই বিশ্বাস করেন যে তাঁদেরটা বন্ধ হবে না কোনও মতেই।
একেবারে নভিস রেস্তোরাঁমালিক অথবা আনাড়ি গাড়িচালক যে ভুলটা করেন, নোবেলজয়ী মনস্তত্ত্ববিদও সেই ভুলই করেছিলেন। অর্থাৎ, মানুষ হিসেবে আমরা এই ভুলের কাছে নিতান্ত অসহায়।
কানেম্যানদের বই, সে দিনের আলোচনার পরেও, শেষ হয়েছিল। তবে, সময় লেগেছিল আরও আট বছর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy