দেবজ্যোতি মিশ্রের “‘ভারতভাগ্যবিধাতা’র গান” (২৫-১) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে জানাই যে, ১৯১১-র ২৬-২৮ ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’-এর ২৬তম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন (২৭ ডিসেম্বর) গানটি প্রথম জনসমক্ষে সমবেত ভাবে গাওয়া হলে, পরের দিন দ্য বেঙ্গলি পত্রিকা গানটির ইংরেজি অনুবাদ-সহ এ সংবাদ প্রচার করেছিল। জানা যায়, ডা. নীলরতন সরকারের হ্যারিসন রোডের বাড়িতে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে এ গানের রিহার্সাল হয়েছিল। মনে করা হয়, ১৯৩৬-এর ২৮ অক্টোবর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এ গানকে জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি দিয়েছিল। গানটিকে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণের প্রস্তাব উঠলে বিরোধীরা প্রচার করেন, গানটি পঞ্চম জর্জের ভারতে আগমন উপলক্ষে রচিত। সম্রাটের প্রশস্তি হিসাবে অনেকে গানটি সাব্যস্ত করলে কবি অত্যন্ত ব্যথিত হন। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্র পুলিনবিহারী সেন গানটি রচনার উপলক্ষ জানতে চেয়ে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি দিলে উত্তরে তিনি লিখেছিলেন, “...সে বৎসর ভারতসম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনো বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি জনগণমন অধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয় ঘোষণা করেছি, পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থায় যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথি, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক, সেই যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জই কোনোক্রমেই হতে পারেন না সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন।...” পরে সুধাময়ী দেবী-সহ অনেককে রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে চিঠিপত্র লিখেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ এক বিপুল সাঙ্গীতিক পরিবেশের আবহে লালিত হয়েছিলেন। নিজস্ব প্রতিভায় তিনি সঙ্গীত সৃষ্টিতে কুশলতা অর্জন করেছিলেন। প্রয়োজনে এ দেশের সঙ্গীতের সঙ্গে মিলিয়েছিলেন বিদেশের ছন্দ। তাঁর এ গান আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম করে হয়ে উঠেছিল সব মানুষের সামগ্রী, ভিন্ন ভাষাভাষীদের কাছেও সমাদৃত। পরাধীন দেশে আমাদের জাতীয় সংহতিবোধকে সংগঠিত করেছিল। আজকের দিনেও এই বিপন্ন সংহতির সংশয়-সমস্যায় এ গান আমাদের জাগায় ও উদ্দীপিত করে। এ জন্যই তো বাংলাদেশের গায়িকা সনজীদা খাতুন বলেছেন, সমগ্র জাতিসত্তার ঐক্যবদ্ধ জাগরণের দিনে রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালিকে গাইতেই হয়। আমরাও আমাদের উৎসবে, আনন্দে, সমন্বয়ে, সঙ্কটে জনগণমঙ্গলদায়িনী দেশমায়ের জয়গান গাই। অভিভূত হই গানের সুর ও অর্থগৌরবে।
সুদেব মাল, তিসা, হুগলি
প্রার্থনামন্ত্র
দেবজ্যোতি মিশ্র তাঁর প্রবন্ধে “‘ভারতভাগ্যবিধাতা’র গান” আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের নান্দনিক রূপটি ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করেছেন। আজকের স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ গানটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ইংরেজ সরকারের বঙ্গভঙ্গ রদ করে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য একটি অখণ্ড প্রদেশকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার পরে। সেই হিসাবে ২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথের জনগণমন অধিনায়ক গানের একশো বছর পূর্ণ হয়েছে। ১৯১১-র ২৭ ডিসেম্বর কলকাতার প্রকাশ্য সভায় সরলা দেবী চৌধুরাণীর নেতৃত্বে সমবেত কণ্ঠে প্রথম গীত হওয়ার পর থেকেই ঐতিহাসিক এই গানটির জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছিল। পরের মাঘোৎসবেও (১৯১২-র ২৫ জানুয়ারি) গানটি ব্রহ্মসঙ্গীত হিসেবেই গীত হয়। ব্রহ্মসঙ্গীত বিভাগের অষ্টম অধ্যায়ে ১৩২৭ সংখ্যক গান হিসাবে ‘জনগণমন’ গানটি লিপিবদ্ধ করা হয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সে দিন শুধু গানটি গাননি, গানের শেষে তিনি ‘জনগণমন’-র উদ্দেশ্য এবং ‘স্পিরিট’ বিষয়ে বিশদে ব্যাখ্যা করেন ও বলেন, “আমাদের যাহা কিছু আছে সমস্তই পণ করিয়া ভূমার পথে নিখিল মানবের বিজয় যাত্রায় যেন সম্পূর্ণ নির্ভয়ে যোগদান করতে পারি।...”
সুভাষচন্দ্র বসুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গানটি জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদায় যন্ত্রসঙ্গীত সহযোগে প্রথম পরিবেশিত হয়েছিল ‘ইন্দো জার্মান কালচারাল সোসাইটি’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, হামবুর্গে। এই ঐতিহাসিক দিনেই ভারতের জাতীয় পতাকা বিদেশের মাটিতে প্রথম বারের জন্য উত্তোলিত হয়েছিল। পরে জওহরলাল নেহরু নিজেও বলেছিলেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আজ়াদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রামের সময় ‘জনগণমন-অধিনায়ক’ সঙ্গীতটি জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদায় সেনানীরা বার বার গেয়েছিলেন। গান্ধীজি লিখেছিলেন, এ তো শুধু গান নয়— সমগ্র জাতির প্রার্থনামন্ত্র।
পরে গণপরিষদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জওহরলাল নেহরু একটি বিবৃতিতে স্বীকার করেছেন যে সাবলীল অর্কেস্ট্রা ও যন্ত্রসঙ্গীতের মাধ্যমে সুরের আবহ সৃষ্টি ও প্রয়োগ নৈপুণ্যে গানটি শ্রেষ্ঠতম। নিজেদের জাতীয় সঙ্গীতকে সব দেশের মানুষই এক শ্রদ্ধামিশ্রিত উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠা করেন, গানের অন্তর্নিহিত বাণীর দ্যোতনা পরম বিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করেন। কিন্তু ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিশেষ গৌরব হল গানের স্রষ্টার প্রতি মানুষের আনুগত্য ও শ্রদ্ধাবোধ। এই পরম সত্যটি নেহরু শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। তাঁর কথায়, এই সঙ্গীতের নির্বাচন অত্যন্ত শ্লাঘার। যত বার এই বিশেষ জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হবে তত বারই দেশবাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথকে। নেহরুর এই পরম উপলব্ধি আমাদের জাতীয় সঙ্গীতকে এক অনতিক্রম্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সৌম্য বটব্যাল, দক্ষিণ বারাসত, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
ভারতচিত্র
দেবজ্যোতি মিশ্রের “‘ভারতভাগ্যবিধাতা’র গান” প্রবন্ধ প্রসঙ্গে জানাই, মিলনের সাধনা ছিল রবীন্দ্রজীবনের মূল মন্ত্র। স্বাধীন ভারতে গানটির প্রথম স্তবক জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গৃহীত হয়। গানটির প্রথম স্তবকের দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে উল্লিখিত প্রদেশগুলি ভারতের পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ হয়ে পূর্ব দিক ধরে উত্তর দিকে এগিয়েছে, গানের বাণীতে আঁকা হয়েছে ভারতের মানচিত্র। ‘সিন্ধু’ প্রদেশ বর্তমান ভারতের অন্তর্ভুক্ত নয়। কেউ কেউ অভিমত দিয়েছেন, ‘সিন্ধু’র বদলে জাতীয় সঙ্গীতে উল্লেখহীন প্রদেশের নাম সংযোজিত হোক। কিন্তু এতে রাজ্যগুলির ক্রমের শৃঙ্খলাভঙ্গ হবে, আবার অখণ্ড ভারতের স্মৃতিটাও হবে বিলীন।
অনেকেই দুটো শব্দের, বলা ভাল দুটো প্রদেশের নাম ভুল উচ্চারণ করি। ‘পঞ্জাব’-এর স্থানে ‘পাঞ্জাব’ এবং ‘মরাঠা’-র স্থানে ‘মারাঠা’ বলেন অনেকে। জাতীয় সঙ্গীতে ভুল উচ্চারণ মানে দেশের প্রতি শ্রদ্ধা অস্বীকার। ‘পঞ্জাব’ শব্দটির উৎস— পঞ্চ+অপ (জল), অর্থাৎ শতদ্রু প্রভৃতি পাঁচ নদীবেষ্টিত দেশ। ‘মরাঠা’ শব্দটি সংস্কৃত মহারাষ্ট্র থেকে আগত। অবাঙালিরা ঠিক উচ্চারণ করেন। জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে চিহ্নিত প্রথম স্তবকটি ৫২ সেকেন্ডের মধ্যে গাওয়াই বিধি। দু’-একটি পঙ্ক্তি ব্যতীত তৎসম শব্দে রচিত। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের বোধগম্য। গানের প্রথম স্তবকে ভূগোল, দ্বিতীয় স্তবকে ধর্ম, পূর্ব ও পশ্চিমের সমন্বয়ে গাঁথা প্রেমহারের কথা উল্লেখ করেছেন। তৃতীয় ও চতুর্থ স্তবকে পতন-অভ্যুদয় বন্ধুর পথের পথিকদের রথযাত্রায় চিরসারথি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পঞ্চম স্তবকে প্রভাতের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নবজীবনের আশাবাদ হয়েছে ধ্বনিত, “নিদ্রিত ভারত জাগে”। গানের মধ্যে ফুটে উঠেছে ভারতের অবয়ব। একবিংশ শতাব্দীতে অন্ধ জাতীয়তাবাদের ভ্রান্তিবিলাসে মিলন ঐতিহ্যের ভারতবোধ বাধাপ্রাপ্ত। তাই শিক্ষা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে গানটির পুরো পাঁচ স্তবক লেখা চললে এবং ‘পঞ্জাব’, ‘মরাঠা’ যথাযথ উচ্চারণের অভ্যাস করলে ভাল হয়।
আশিস ত্রিপাঠী, পশ্চিম মেদিনীপুর
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)