স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘ঠায় দাঁড়িয়ে দশ ঘণ্টা’ (৩-৫) লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পাশাপাশি অন্য নানা ধরনের সমস্যার কথাও লেখাটিতে আলোচিত হয়েছে, এবং সমস্যার সমাধান হিসেবে রাজ্যকে নতুন আইন আনার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে জানাই, রাজ্য নতুন আইন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করতেই পারে, কিন্তু সেটা বড়ই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বিধানসভাতে বিল পাশ করানো, তার পর রাজ্যপালের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠানো। তা ছাড়া, আইন বা চুক্তি হলেই সমস্যার সমাধান হয়, এমনটা নয়। লেখক চটশিল্পে চিনা মেশিনের কথা বলেছেন। তাতে শ্রমিক-জীবনের সমস্যার কথাও লিখেছেন। শ্রমিক-মালিক উভয়পক্ষের মধ্যে চুক্তি হলেও, সম্পর্কের জায়গা থেকে যার শক্তি বেশি, তার পক্ষেই যায়। শ্রম-দফতর সাধারণত মালিকদের পক্ষেই দাঁড়ায়। ২০২৪-এর জানুয়ারিতে যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়, তাতে এমন কিছু বিষয়ে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন ও রাজ্য সরকার অনুমোদন দিয়েছে, যা চটশিল্পের মালিকদের পক্ষে যায়। এতে শ্রমিকদের অবস্থা খারাপ হয়েছে। যেমন, চুক্তিতে চটশিল্প আধুনিকীকরণে অবাধ লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন মিলে চিনা মেশিন অবাধে বসানো হয়েছে, যার ফলে ব্যাপক কাজের বোঝা বেড়েছে শ্রমিকদের উপর। তা ছাড়া, শ্রমিকদের এক বিভাগ থেকে পাঠানো হচ্ছে অন্য বিভাগে। ২০ বছর তাঁতঘরে কাজ করার পর যদি বলা হয় স্পিনিংয়ে কাজ করুন, শ্রমিকরা পারেন নাকি?
গোটা চটশিল্পে শ্রমিকদের সঙ্ঘবদ্ধতা যে কমেছে, নিঃসন্দেহে এ তারই মাসুল। সমস্যাটা শুধু আইন করে সমাধান করা যাবে না। আইন হতেই পারে। তবে, সমস্যা অন্যত্র। যাঁদের সমস্যা তাঁরা যদি সঙ্ঘবদ্ধ ও প্রতিবাদী না হন, অধিকারের লড়াই না লড়েন, তা হলে এই যন্ত্রণা মুখ বুজে মেনে নিতে হবে। এমনকি আইন প্রণয়ন করার জন্যও লড়াইটা করতে হবে। আইন হয়ে গেলে আইন কার্যকর করার জন্যও লড়াই ও সংগঠন গড়তে হবে— এ এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তবু উদ্যোগ সেই ভুক্তভোগীদেরই নিতে হবে, যাঁরা দশ ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে কাজ করে যান।
কুশল দেব নাথ, কলকাতা-২৪
প্রতিষ্ঠাতা নন
রণবীর চক্রবর্তীর ‘বঙ্গাব্দ বিতণ্ডার ইতিবৃত্ত’ (১৪-৪) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। প্রবন্ধের গোড়াতেই তিনি বলেছেন, বঙ্গাব্দের সূচনা বিষয়ে “...গত বছরদশেক ধরে লাগাতার যে সব কথা কানে আসছে, তাতে পেশাদারি ইতিহাসচর্চার নিরিখে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।” এ সব কথার কিছু কিছু আমার কাছেও এসেছে। কাজেই পেশাদার ইতিহাসবিদ হিসাবে এ ব্যাপারে আমার অভিমত স্পষ্ট করে জানানো প্রয়োজন মনে করি। আরও একটি কারণ আছে। আমি এবং শুভ্রা চক্রবর্তী এক সঙ্গে হিস্টোরিক্যাল ডিকশনারি অব দ্য বেঙ্গলিজ় (দ্য স্কেয়ারক্রো প্রেস, ল্যানহ্যাম, নিউ ইয়র্ক, ২০১৩) বলে একটি বই লিখি। তাতে ‘ক্যালেন্ডার’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ বিবরণীতে নিম্নলিখিত বাক্যটি আছে— “কিং শশাঙ্ক ইজ় ক্রেডিটেড উইথ ইন্ট্রোডিউসিং দ্য বেঙ্গলি ক্যালেন্ডার” (পৃ ১১৪)। এর অর্থ, রাজা শশাঙ্ককে বাংলা ক্যালেন্ডার (অর্থাৎ বঙ্গাব্দ) প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব কেউ কেউ দিয়ে থাকেন। এটা আমার এবং শুভ্রার ব্যক্তিগত অভিমত নয়। শশাঙ্ক বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা এই জনশ্রুতির পক্ষে আমরা কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণও পেশ করিনি। যদি এটা আমাদের মত হত, তা হলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখতাম “কিং শশাঙ্ক ইন্ট্রোডিউসড দ্য বেঙ্গলি ক্যালেন্ডার।” ‘ইজ় ক্রেডিটেড উইথ’ যোগ করার প্রয়োজন হত না। অর্থাৎ ‘ক্রেডিট’-টা আমরা দিইনি, অন্য কেউ বা কারা দিয়েছেন। অভিধান বলেই এ রকম একটা প্রান্তিক মতও যে কোনও কোনও মহলে প্রচলিত আছে, সেটা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করেছিলাম।
বরং এই অনুচ্ছেদেই আমরা বিশদে আলোচনা করেছিলাম কেন এবং কবে মোগল সম্রাট আকবর রাজজ্যোতিষী ফাতুল্লা শিরাজিকে ইসলামি হিজরি চান্দ্র সময়গণনার পদ্ধতি ও ভারতে প্রচলিত সৌর সময়গণনার পদ্ধতির সমন্বয়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন (পৃ ১১৪)। চাষিরা ফসল ঘরে তোলার পর এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নতুন বছর শুরু হত বলে একে ফসলি সনও বলে, এ কথারও উল্লেখ করেছিলাম। সেই সময় থেকেই বাংলায় এই নতুন অব্দ প্রচলিত হয়। তার ফলে কী করে এখন আমরা ১৪৩২ বঙ্গাব্দে বাস করছি সেটা হিসেব কষে রণবীর দেখিয়েছেন। আমরা লিখেছিলাম, সেই সময় থেকেই এই বর্ষগণনার রীতি পুরো মোগল সাম্রাজ্য জুড়ে গৃহীত হয়েছিল এবং পশ্চিমবঙ্গে তা আজও প্রচলিত আছে। বরং মহম্মদ শহিদুল্লার নেতৃত্বে গঠিত ১৯৬৬ সালের কমিটির সুপারিশক্রমে বাংলাদেশে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে এই ক্যালেন্ডারে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়, যা পশ্চিমবঙ্গ গ্রহণ করেনি (পৃ ১১৪-৫)।
কাজেই এই অব্দ শশাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করতেই পারেন না। ভারতের ইতিহাসে, বোধ হয় সমগ্র পৃথিবীতেই, এমন উদাহরণ নেই যেখানে কোনও রাজা বা সরকার একটি নতুন অব্দের প্রতিষ্ঠা করলেন, কিন্তু তাঁদের আদেশে জারি হওয়া নিজস্ব রাজকীয় বা সরকারি নথিপত্রে কোথাও তার কোনও উল্লেখ থাকল না। শশাঙ্কর রাজত্বে উৎকীর্ণ তাঁর তাম্রশাসনগুলির একটিতেও যে বঙ্গাব্দের উল্লেখ নেই, বরং একটিতে গুপ্তাব্দ অনুসৃত হয়েছে, এই আশ্চর্য তথ্য রণবীর বিস্তারিত আলোচনা করে দেখিয়েছেন।
শশাঙ্ক নিজ গুণে উজ্জ্বল, তাঁকে বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা প্রমাণ (প্রমাণ তো নেই, দাবি) করে আরও আলোকিত করার প্রয়াস যে ইতিহাসবিরুদ্ধ— রণবীরের এই অভিমতের সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত। আমাদের ডিকশনারিতে শশাঙ্ক শীর্ষক বিবরণীতে (পৃ ৪৩৩) তাঁর রাজত্বকালের বিস্তৃত আলোচনা করেছি, বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা বলে এক বারও দাবি করিনি। বইয়ের শুরুতে কালপঞ্জি অংশে সপ্তম শতাব্দী প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্কের তাৎপর্য গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছি, কিন্তু বঙ্গাব্দের কোনও উল্লেখ তাতে নেই। রণবীরকে অনুসরণ করেই বলি, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার, দীনেশচন্দ্র সরকার, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতো বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের দিকপালরা যে অভিমত প্রকাশ করেননি, আমাদের মতো সামান্য গবেষকরা তা করব, এত দুঃসাহস আমাদের নেই।
নতুন কোনও গুরুতর তথ্য আবিষ্কৃত না হলে বঙ্গাব্দের সূচনা নিয়ে আরও আলোচনার আর কোনও অবকাশ নেই। তবু যদি কেউ এই বিতর্ক আবার খুঁচিয়ে তুলতে চান, তাঁদের প্রতি অনুরোধ, আমাদের নাম তাতে জড়াবেন না। নির্দ্বিধায়, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাচ্ছি, শশাঙ্ক বঙ্গাব্দের সূচনা বা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই অভিমত আমরা স্বীকার করি না।
কুণাল চক্রবর্তী, কলকাতা-৩৯
টিকিট ফাঁকি
‘পুঁজিবাদের স্বার্থে’ (৩-৪) শীর্ষক চিঠিতে রতন রায়চৌধুরী লিখেছেন, মেট্রোযাত্রীরা যে যন্ত্রটিতে স্মার্ট কার্ড, টোকেন বা কাগজের বারকোড-যুক্ত টিকিট ব্যবহার করেন, সেটিকে যন্ত্রমেধার ক্ষুদ্রতম উদাহরণস্বরূপ ধরা যেতে পারে। এই যন্ত্রটিকে ফাঁকি দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করা কিংবা স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার উপায় থাকে না।
আমি মেট্রো রেলের নিত্যযাত্রী। এই যন্ত্রকে ফাঁকি দেওয়া যে খুব সহজ, তা বহু বার দেখেছি— দু’জন এক সঙ্গে সফর করার সময় তাঁরা এই যন্ত্রের সামনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াচ্ছেন। এক জন টিকিট পাঞ্চ করছেন, এবং ঢোকার বা বেরোনোর পথ খুলে যাওয়া মাত্র, এক জনের বদলে দু’জন দ্রুত সেই পথ দিয়ে ঢুকছেন বা বেরিয়ে যাচ্ছেন। যন্ত্রের বদলে এখানে দায়িত্ববান কর্মী নিয়োগ করা হলে, বিনা টিকিটের যাত্রীদের পক্ষে তাঁকে এ ভাবে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হত না।
ভাস্কর রায়, কলকাতা-৭৭
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)