Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Quackish Doctor

সম্পাদক সমীপেষু: গ্রামীণ চিকিৎসা

শহরে বসবাসকারী মানুষের নাগরিক চাহিদার সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের চাহিদার কোনও মৌলিক পার্থক্য নেই।

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৭:১২
Share: Save:

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নার্সদের জন্য নতুন পদ ‘প্র্যাকটিশনার সিস্টার’ সৃষ্টি করে রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নার্সদের সেই পদে উন্নীত করতে চান। সাধু উদ্যোগ, সন্দেহ নেই। কারণ, নার্সরা পূর্ব থেকেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে দীর্ঘ দিন কাজ করার সুবাদে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায় ভরপুর। তাঁরা চিকিৎসক না হলেও তাঁদের ‘প্রায় চিকিৎসক’ বললে অত্যুক্তি হয় না। সর্বোপরি, এক জন নার্স তাঁর ট্রেনিং পর্বে হাতেকলমে পাঠ নেওয়া ছাড়াও চিকিৎসা সংক্রান্ত অনেক জটিল ও কঠিন বিষয় অধ্যয়ন করেন, ও সবশেষে যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই ওই পদে বহাল হন। অতএব তাঁদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী।

কিন্তু গ্রামে পল্লি চিকিৎসকদের দিয়ে প্রাথমিক পরিষেবা দেওয়ার যে ঘোষণা ওই দিন মুখ্যমন্ত্রী করেছেন, তা বাস্তবায়িত হলে কতটা বিপজ্জনক আকার ধারণ করতে পারে, সম্ভবত তিনি অনুমান করেননি! শহরে বসবাসকারী মানুষের নাগরিক চাহিদার সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের চাহিদার কোনও মৌলিক পার্থক্য নেই। বিশেষ করে স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে। যাঁদের এই পরিষেবা দেওয়ার কাজে নিয়োগ করা হবে, তাঁদের নির্বাচনের পদ্ধতিটিও সুস্পষ্ট নয়। গ্রামীণ চিকিৎসক বা ‘হাতুড়ে’ ডাক্তার! অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এ পেশায় যাঁরা নিয়োজিত, তাঁরা কোনও চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা বড়জোর মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক। তবে বেশির ভাগেরই টেনেটুনে ক্লাস নাইন অথবা টেন। এঁরা গ্রামে চেম্বার খুলে সাধারণ জ্বর সর্দিকাশির চিকিৎসা থেকে গর্ভপাতের মতো ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসাও করে থাকেন। বিপদে যে পড়েন না, এমনটা নয়। পড়লে পলায়ন ও পত্রপাঠ চেম্বারের ঝাঁপ বন্ধ। বাস্তবে গ্রামীণ মানুষের চিকিৎসার অপ্রতুলতার জন্য এ এক নির্মম পরিহাস! অন্য দিকে, বিশ্ব জুড়ে অ্যান্টিবায়োটিক্সের প্রতি প্রতিরোধ জন্মানো শিরঃপীড়ার কারণ। এখন এই গ্রামীণ চিকিৎসকরা অজানতেই কত মানুষকে ভুল অ্যান্টিবায়োটিক্স প্রয়োগে বিপদগ্রস্ত করেছেন, তা আমরা জানি না। তাঁরাই যদি সরকারের সহযোগিতা ও স্বীকৃতি পেয়ে যান, তা হলে গ্রামীণ মানুষের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার বিষয়টি সেই তিমিরেই থেকে যাবে।

রাজা বাগচি, গুপ্তিপাড়া, হুগলি

শূন্য পদ

২০০৫ সালে আমাদের রাজ্যে নার্স প্র্যাকটিশনার ইন মিডওয়াইফারি (এনপিএম) নিয়ে এক পাইলট স্টাডি হয়। পাঁচ জন নার্স কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন। তবে পরবর্তী কালে তাঁদের মধ্যে এক জন মাত্র নার্স প্র্যাকটিশনার পদে যোগ দেন। ছ’বছর পর ২০১১ সালে ১১ জন নার্সিং-এ স্নাতক কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এক বছরের ‘নার্স প্র্যাকটিশনার ইন মিডওয়াইফারি’র প্রশিক্ষণ নিয়ে পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া ও জলপাইগুড়ির বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত। ডিরেক্টরেট হেলথ সার্ভিস-এর নার্সিং বিভাগ ২৯ মে ২০১৩-র একটি নির্দেশিকায় এনপিএম-দের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ৩১টি বিষয় নির্দিষ্ট করে দেয়। ওই প্রশাসনিক নির্দেশিকায় রয়েছে, এনপিএমদের ২৪ ঘণ্টা আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য হাসপাতালে থাকতে হবে। মাত্র ১১ জন এনপিএম-এর পক্ষে ৭ জেলায় ছড়িয়ে থেকে ২৪ ঘণ্টা উপস্থিত থাকা বাস্তবে সম্ভব নয়। তাঁদের প্রশিক্ষণ ২০১১-র পর কেন বন্ধ হল, ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে। ভারত সরকারের ‘গাইডলাইনস অন মিডওয়াইফারি সার্ভিসেস ইন ইন্ডিয়া, ২০১৮’ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে বার্ষিক প্রসব সংখ্যার অনুপাতে ধাত্রীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এই হিসেব অনুযায়ী, এ রাজ্যে ধাত্রী বা দাইয়ের প্রয়োজন ৫৭৬০ জন।

ভারতের মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ বাস করেন গ্রামীণ এলাকায়। ‘ন্যাশনাল হেলথ প্রোফাইল ২০১৯’ অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালে মোট শয্যা সংখ্যার ৩৭ শতাংশ রয়েছে গ্রামীণ ভারতে। ২১৪০৩টি গ্রামীণ হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ২,৬৫,২৭৫টি। অন্য দিকে, ৪৩৭৫টি নগর হাসপাতালে ৪,৪৮,৭১১টি। রোগী পিছু চিকিৎসকের সংখ্যায় গ্রাম ও শহরে পার্থক্য বেশ প্রকট। যেমন, আমাদের রাজ্যের শহর ও গ্রামে চিকিৎসক পিছু রোগীর অনুপাত যথাক্রমে ১:৭০০ এবং ১:৫০০০। দেশে এই অনুপাত হল ১:১৫৪১, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাম্য অনুপাত ১:১০০০ থেকে অনেকটা পিছনে। এই রকম পরিস্থিতিতে ‘নার্স প্র্যাকটিশনার ইন মিডওয়াইফারি’-সহ অন্যান্য বিভাগে নার্স প্র্যাকটিশনার নিয়োগ কিছুটা হলেও চিকিৎসা পরিষেবার উন্নতি ঘটবে বইকি।

নন্দগোপাল পাত্র, সটিলাপুর, পূর্ব মেদিনীপুর

দাইয়ের ভূমিকা

পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় জনস্বাস্থ্য পরিষেবার প্রাথমিক স্তরে রয়েছে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র। ১৯৮১ সালে প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার জনসংখ্যায় একটি করে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র সরকার চালু করে। বর্তমানে এখানে এক জন এএনএম, এক জন সেকেন্ড এএনএম ও চার-পাঁচ জন আশাকর্মী এবং এক জন দাই দিদি, সরকারি ভাবে কর্মরত। এই স্বাস্থ্যকর্মীরা স্বাস্থ্য বিভাগের অন্যান্য কাজ করলেও মূলত গর্ভবতী মায়েদের পরিষেবা দান, জন্মনিয়ন্ত্রণের কাজ এবং শিশুদের পোলিয়ো থেকে শুরু করে সমস্ত রকম টিকা দান করেন। প্রতিটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে, এলাকা থেকে এক জন করে দাই দিদি সরকারি প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়োগ করা হয়েছিল, গর্ভবতী মায়েদের বাড়িতে গিয়ে প্রসব করানোর জন্য। কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগে স্বাস্থ্য ভবনের সরকারি নির্দেশিকায় গর্ভবতী মায়েদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাড়িতে প্রসব যাতে না হয়, সেই নির্দেশ জারি হয়। সেই মতো সরকারি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গর্ভবতী মায়েদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে। ফলে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দাই দিদিরা এখন প্রসব করানোর কাজে আর নেই। তাঁরা প্রতি দিন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র খোলা ও বন্ধ করা, পরিষ্কার করা, পানীয় জল তোলা এবং অন্যান্য কাজে যুক্ত রয়েছেন। বেতন হিসাবে মাসে তাঁদের মাত্র ৫৫০ টাকা দেওয়া হয়, তাও তিন-চার মাস অন্তর অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। এই দাই দিদিদের প্রতি সরকারের নজর টানতে চাই।

পরেশ নাথ মণি, বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

এম এসসি ডোম

নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডোম (ল্যাবরেটরি অ্যাটেন্ড্যান্ট) পদে চাকরির আবেদনকারীদের যোগ্যতার বহর দেখে চমকে উঠতে হয় (‘ডোম-পদ চান, বাড়িতে বলেননি এম এসসি প্রার্থী’, ১-৯)। মাত্র ছ’টি ফাঁকা পদের জন্য যাঁরা আবেদন করেছেন, তাঁদের মধ্যে জৈবপ্রযুক্তিতে এম এসসি, এডুকেশন এবং বাংলায় এম এ ডিগ্রিধারীর সংখ্যা কম নয়। নিয়োগকর্তা যদি যোগ্যতম প্রার্থীদের বহাল করতে চান, তা হলে এই কাজের উপযুক্ত প্রার্থীরা হয়তো সুযোগ পাবেন না। কম যোগ্যতা মানের চাকরিগুলি যদি অনেক উঁচু যোগ্যতাধারীরা ছিনিয়ে নেন, তা হলে কম যোগ্যতার লোকেরা যাবেন কোথায়? এ দেশে কখনওই যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থান হত না। আবার, ঊর্ধ্বতন পদাধিকারীর অধীনে তার চাইতে উঁচু ডিগ্রি পাওয়া কর্মী কাজ করলে দু’তরফেই নানা মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। সে সব অসুবিধাও নাহয় আলোচনায় কমিয়ে আনা গেল। কিন্তু সরকারি ব্যবস্থায় একটি পড়ুয়াকে উচ্চশিক্ষিত করতে অনেক খরচ, পরোক্ষ ভাবে যা করদাতাদেরই বহন করতে হয়। উচ্চশিক্ষিত হয়েও কম যোগ্যতার কাজ করলে সেই অর্থ এবং অর্জিত ক্ষমতার অপচয় হয়। যোগ্য হাতে যোগ্য কাজ— এই নীতি না মানা গেলে জাতীয় উৎপাদনশীলতা কমবে, জন্মাবে সামাজিক অসন্তোষ।

বিশ্বনাথ পাকড়াশি, শ্রীরামপুর, হুগলি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Quackish Doctor Mamata Banerjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE