Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Violence During Election

ক্ষমতার প্রসাদ

রাজনীতিকদেরও জীবনধারণের জন্য অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু শুধুমাত্র অর্থের তাগিদেই রাজনীতি হলে হিংসা-হানাহানি অনিবার্য হয়ে পড়ে।

চলছে ভোটগ্রহণ।

চলছে ভোটগ্রহণ। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৩ ০৪:২৮
Share: Save:

কুমার রাণা তাঁর প্রবন্ধে (নিহতের আসল পরিচয়, ১-৮) গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন তুলে ধরেছেন, যেগুলি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কিন্তু তিনি দলমত নির্বিশেষে রাজনীতির ঊর্ধ্বে মূল সমস্যার উৎস বা সমাধানের দিকটিতে আলোকপাত করেননি। পঞ্চায়েত নির্বাচনে মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে চাপানউতোর চলে, কিন্তু ‘যুদ্ধ’ কেন হয়? তার একটি প্রধান কারণ দারিদ্র এবং কর্মসংস্থানের অভাব। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া একটি দীর্ঘকালীন এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। পেশাদারি প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ পাওয়ার সুযোগও এ রাজ্যে সীমিত, ব্যবসার সম্ভাবনাও তেমন উজ্জ্বল নয়। অতএব, রাজনীতিতে যোগদান করাই সহজ পথ হিসাবে প্রতিভাত হয়।

এর ফলে আম্বেডকরের মতাদর্শ অনুযায়ী শিক্ষিত-সংগঠিত প্রতিবাদ করার বিষয়টি বাস্তবে রূপ পায় না। কিন্তু যে ছেলেটি নিজের প্রাণ বিপন্ন করে সামান্য টাকার বিনিময়ে বোমা বাঁধতে যাচ্ছে, বা যে ছেলেটি হিংস্র ভাবে অন্যের প্রাণ কাড়তে ব্যস্ত— দু’জনেরই রয়েছে অভাব এবং বেঁচে থাকার তাগিদ।

এটা ঠিকই যে, রাজনীতিকদেরও জীবনধারণের জন্য অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু শুধুমাত্র অর্থের তাগিদেই রাজনীতি হলে হিংসা-হানাহানি অনিবার্য হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য যে, গ্রামে ছোটখাটো ক্ষমতাও কেন্দ্রীভূত থাকে উচ্চবর্ণের মানুষদের হাতে। নিম্নবর্ণের মানুষ বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ সাধারণত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছতে পারেন না। বিভিন্ন নেতাদের অনুচরবৃত্তি করে, সেই প্রসাদেই জীবনধারণ করতে হয়। ভোটের রণাঙ্গনে সম্মুখ সমরে প্রাণ হারালে তাঁদের প্রাপ্য হয় শুধুই খানিক নীরবতা।

এটার একমাত্র কারণ এটাই যে, দলিতরা সঙ্ঘবদ্ধ নন। সম্প্রতি শাসক দলের এক বিধায়ক দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও বিধানসভায় নিজের সম্প্রদায়ের নারীদের অবস্থান নিয়ে সরব হয়েছিলেন। অথচ রাষ্ট্রপতিকে নিমন্ত্রণ না করে সংসদ ভবন উদ্বোধন করার বিষয়টি নিয়ে কোনও জোরালো প্রতিবাদ দলিত সম্প্রদায়ের মানুষকে করতে দেখা যায়নি— এ আমাদের দেশের লজ্জা।

স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে সংরক্ষণের সুবিধা ভোগ করে যে সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে তারা না হয়েছে সংগঠিত না হয়েছে প্রতিবাদী। বর্ণবাদী ব্যবস্থার চাপে শুধুমাত্র নিজেদের সুবিধাটুকুই তাঁরা সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। বাম ও অ-বাম, সমস্ত রাজনৈতিক দল ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রান্তিক মানুষকে কী ভাবে ব্যবহার করে, তা সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন লেখক।

তবুও জীবন কত মূল্যহীন, তা বোঝাতে এক জন প্রান্তিক নারীর স্বামীর হত্যার আশঙ্কার এমন অনায়াস, নির্বিকার উচ্চারণ যেন অবাস্তব বলে মনে হয়। অভাবের তাড়নাতেও প্রেমে-মায়ায় জড়ানো থাকে গ্রামের সংসার জীবন। লেখকের চোখে সমাজবীক্ষণে সহানুভূতি আছে, কিন্তু যেন সমানুভূতির অভাব।

যত দিন না নিজেদের কথা দলিতরা নিজেদের কলমে তুলে ধরতে পারবেন, তত দিন পর্যন্ত তাঁদের মুক্তি মিলবে না।

ইমন মণ্ডল, বটানিক্যাল গার্ডেন, হাওড়া

বঞ্চনার আশঙ্কা

কুমার রাণার প্রবন্ধটি সময়োপযোগী এবং যথার্থ হলেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। জাতিদাঙ্গার এক ভয়ঙ্কর রূপ ধরা দিয়েছিল জীবনানন্দ দাশের ‘১৯৪৬-৪৭’ কবিতায়। কবির অভিব্যক্তি— “যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হয়ে/ বলে যাবে কাছে এসে, ‘ইয়াসিন আমি,/ হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ-/ আর তুমি?’— বলে যাবে গগন বিপিন শশী।” এরা কোথাকার, কেউ খোঁজ রাখে না। “জীবনের ইতর শ্রেণির মানুষ তো এরা সব।” তাই এদের মৃত্যুতে রাস্তা জুড়ে শোকমিছিল বার হয় না। মোমবাতি হাতে কেউ হাঁটে না। গণমৃত্যুতেও সুশীলসমাজ নীরব থাকে। কারণ নেতা-নেত্রী তো ঠিক আছে! ‘শিক্ষাদীক্ষা বর্জিত’দের নিয়ে শাসকেরা ঠান্ডা ঘরে বসে চিরকাল রাজনীতি করে। তাই এদের অন্ধকারে রেখে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করা শাসক দলের ধর্ম। প্রবন্ধকারের মতে, নিহতের আসল সংখ্যা ১৯ বা ৫০, তা নির্ণয় করা কঠিন। কারণ কে বলছে এই মৃতের সংখ্যা, তার উপর নির্ভর করে। ঠিকই তো, গণমাধ্যম বা বিরোধীরা এক রকম বলবেন, শাসকরা বলবেন অন্য রকম। দেখা যাচ্ছে, ভোটে নিহতরা অধিকাংশই শাসক দলের। শাসক দল দেখাতে চায়, বিরোধীদের হাতেই মরেছে। শাসক কি জানেন না দলের কলহ, অন্তর্দ্বন্দ্ব, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা? আসলে মানুষগুলো বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কাই তাদেরকে মরিয়া করে তোলে, সে কারণেই হানাহানি, মৃত্যু। এই সংখ্যা আজও বেড়ে চলেছে।

লক্ষণীয়, শাসক দল বা বিরোধী দলের কাছে এটা একটা পরিসংখ্যান মাত্র। কে মারা গেল, কার সন্তান, কে তার পিতামাতা, প্রতিবেশী? কোনও পরিচয় শাসক বা বিরোধী মনে রাখেন না। গণতন্ত্রকে পদদলিত করে স্বৈরতন্ত্র গড়তে রাজনৈতিক দলগুলি গরিব মানুষগুলোকে ব্যবহার করে কেবল। শাসক বা বিরোধীরা আম-আদমিকে শুধু স্বপ্ন দেখান। আর তারা স্বপ্ন দেখে, তাদের সন্তান যেন দুধে-ভাতে থাকে। মনে আক্ষেপ জমতে থাকে যে তারা সামান্য লোক বলেই উপেক্ষিত। তবু দাবি জানায়, “আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক” (জয় গোস্বামী)।

অতীত খুঁজলে দেখা যায়, বাম আন্দোলন এই নিঃস্ব-রিক্ত মানুষগুলোকে এক সময়ে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তাদের পার্টিমুখী করতে পেরেছিল। কিন্তু ধরে রাখতে পারেনি। কারণ, বাম শাসনও হয়ে উঠেছিল এক অচলায়তন। কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিয়ে তার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল অহংবাদ। আজ বর্তমান শাসকের সেই অহং-ই তাঁদের অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তবুও তার মধ্যেই জন্ম নেয় আশা— শ্রমজীবী মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ হয়, চিরকাল এগিয়ে চলে ভয়হীন ভাবে। সেই গতি রোধ করা যায় না।

সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪

উচ্চশিক্ষার দিশা

‘অনেক আসন ফাঁকা, পোর্টাল খুলল বহু কলেজে’ (২৭-৭) প্রতিবেদনে শিক্ষামহলের একাংশের বক্তব্যে উঠে এসেছে স্কুল শিক্ষকতার পেশায় অনিশ্চিত একটি ভবিষ্যতের কথা, যার মূলে রয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশনের ভূমিকা। স্নাতক পড়ুয়ারা শুধুমাত্র স্কুলে শিক্ষকতার কথা ভেবেই কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা ভাবে কি? আমাদের রাজ্যে উচ্চশিক্ষা অনেকটাই পুঁথিনির্ভর। বিশ্ব জুড়ে কর্মক্ষেত্রে বহুমাত্রিক চাহিদার ফলে এই পাঠক্রম প্রাসঙ্গিকতা হারাতে বসেছে। ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারি’ পাঠক্রম-এর থেকেও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে দরকার বহুমাত্রিক বা ‘মাল্টিডায়মেনশনাল’ পাঠক্রম, যা তিন বছর কলেজ জীবনেই রপ্ত করা সম্ভব। তা মিলছে না। তাই ছাত্র-ছাত্রীরা পেশাভিত্তিক পাঠক্রমের দিকে উৎসাহ দেখাবে বেশি, এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষান্তে একটি চাকরির প্রত্যাশা তারা প্রত্যেকেই করে। তাই সাধ্যের বাইরে হলেও অখ্যাত বেসরকারি কলেজে ভর্তি হতেও পিছপা হচ্ছে না।

অথচ, শিল্পের চাহিদার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ছাত্র-ছাত্রীদের গড়ে তুলতে আগ্রহী নয় কলেজগুলি। মাসান্তে বেতন যেখানে নিশ্চিত, সেখানে হামেশাই কলেজ কর্তৃপক্ষের বিশেষ উদ্যোগ দেখা যায় না। ব্যতিক্রমী আছে অবশ্যই, কিন্তু শহরতলি এবং গ্রামের কলেজগুলিতে উচ্চশিক্ষার পড়ুয়াদের এখন কলেজ যাওয়া-আসাই সার। অথচ, পিপিপি মডেলে প্রযুক্তির পাঠ, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, ইংরেজি ভাষায় সড়গড় করে তোলার জন্যে কলেজগুলিকে বাড়তি খরচের সম্মুখীন হতে হয় না। রাজ্য সরকার এবং উচ্চশিক্ষা দফতরেরও নিষেধাজ্ঞা নেই। তা সত্ত্বেও কলেজগুলির সদর্থক ভূমিকা চোখে পড়ে না। যে ভাবে রাজ্য থেকে সরকারি এবং সরকার-পোষিত স্কুলগুলি বিলুপ্ত হচ্ছে তাতে ভয় হয়, আগামী দিনে কলেজগুলির দশাও না তেমনই হয়।

পিনাকী রুদ্র, কলকাতা-১২৪

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Election Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE