E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: দুর্নীতির আবাসন

প্রায় ৩৫ বছর কেটে গেলে ২০০০ সালের পর থেকে একে একে সমস্ত আবাসন ‘পরিত্যক্ত’ ঘোষিত হয়েছে। এখন রাতের অন্ধকারে ঝোপে ঢাকা এই সব আবাসন হানাবাড়ি বলে মনে হয়।

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২৫ ০৭:৩০

‘ঝুরঝুরে বাড়ি’ (২৭-৩) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, বাড়ির আয়ু হিসাবে তো ৮০-৮৫ বছর ধরা হয়। তবে এই বাড়িগুলো ৩০-৩৫ বছর বয়সেই থুত্থুড়ে হচ্ছে কী ভাবে? এই প্রসঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। স্বল্প আয়ের কল-কারখানার শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য ষাটের দশকে রাজ্যে অনেক ইএসআই হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। এই রকম একটি হাসপাতাল হয়েছে হুগলির শ্রীরামপুরে, জিটি রোডের ধারে চাষের জমিতে, হাসপাতাল প্রাঙ্গণের তিনটি পুকুরকাটা মাটি ভরাট করে।

আমি তখন স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ছাত্র। ছুটির পর দল বেঁধে বন্ধুরা হাসপাতাল তৈরির কর্মকাণ্ড দেখতে যেতাম। দেখতাম, বাড়ি তৈরির সমস্ত উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে অতি নিম্নমানের। ইটগুলোর শক্তি এত কম যে, একটু আঘাত করলেই টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ধুলো আর বালির মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই। কিছু দিন পর সবিস্ময়ে লক্ষ করেছিলাম, সকল শ্রেণির কর্মচারী-আবাসনের ভূমিতল নির্মিত হচ্ছে সামনের জিটি রোডের তল থেকে বেশ কিছুটা নীচে, যে রাস্তার উপর দিয়ে বর্ষাকালে গঙ্গার জোয়ারের লাল জলের স্রোত বয়ে যায়! আমরা কিশোরের দল সেই সময় এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম, কারণ আমরা জানতাম, ভূমিতলের আবাসিকরা বর্ষাকালে অসুবিধার সম্মুখীন হবেন। কিন্তু সেই বয়সে জানতাম না এত দুর্নীতির কথা। এক দিন বিকেলে দেখলাম, জিপ থেকে নেমে সরকারি আধিকারিকরা আবাসনগুলো পরিদর্শন করছেন। তাঁদের সঙ্গে ঠিকাদারের প্রতিনিধিরাও ছিলেন হয়তো। আমরা কয়েক জন বন্ধু অতি উৎসাহে সে দিন তাঁদের সামনে পৌঁছে আবাসনগুলোর ভূমিতলে বর্ষাকালে জল জমে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলতেই তাঁদের মধ্যে দু’জন আমাদের সঙ্গে কেবল খারাপ ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হননি, পুলিশের ভয়ও দেখিয়েছিলেন।

যা আশঙ্কা করেছিলাম, তা-ই হল। ১৯৬৬ সালে হাসপাতালে চিকিৎসা শুরুর সময় থেকেই দেখা গেল ভূমিতলের আবাসিকদের বর্ষাকালে বাস করতে অসুবিধা হচ্ছে। অনেক কর্মচারী এই অসুবিধার কারণে হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। প্রায় ৩৫ বছর কেটে গেলে ২০০০ সালের পর থেকে একে একে সমস্ত আবাসন ‘পরিত্যক্ত’ ঘোষিত হয়েছে। এখন রাতের অন্ধকারে ঝোপে ঢাকা এই সব আবাসন হানাবাড়ি বলে মনে হয়। চিকিৎসক-সহ প্রায় সব কর্মচারী আসেন ট্রেন-পথে। ইতিমধ্যে, গত পঞ্চাশ বছরে জিটি রোডের উচ্চতা বেড়েছে প্রায় দু’ফুট!

জনপ্রতিনিধিগণ দেশের কাজে এতই ব্যস্ত যে, এ সব ছোটখাটো জিনিস দেখার সময় পান না!

প্রসন্নকুমার কোলে, শ্রীরামপুর, হুগলি

ভীতিপ্রদ

‘ঝুরঝুরে বাড়ি’ শীর্ষক সম্পাদকীয়ের সূচনায় সুকুমার রায়ের ‘বুড়ির বাড়ি’ (“ছাদগুলো ঝুলে পড়ে বাদলায় ভিজে, একা বুড়ি কাঠি গুঁজে ঠেকা দেয় নিজে”) ছড়ার অনুষঙ্গে মনে এল অলকা শঙ্কর ও শার্লিন মুকুন্দন-এর লেখা সরস গল্প ‘ইট অল বিগ্যান উইদ ড্রিপ ড্রিপ’-এর কাহিনি— ঝড়বৃষ্টির আঁধার রাতের অঝোর ধারাপাতে এক বুড়ির কুঁড়েঘরের চাল ভেদ করে টুপটাপ শব্দে জল পড়ছে। এ-হেন আওয়াজে ভয় পেয়ে পাশে আশ্রয় নেওয়া একটি বাঘ ভাবছে ওই টুপটাপ শব্দ বোধকরি তার চেয়েও ভয়ানক কোনও জন্তুর গলার স্বর। ইতিমধ্যে অন্ধকারে বাঘটিকে নিজের হারিয়ে যাওয়া গাধা মনে করে জাপটে ধরে বুড়ির ছেলে ভোলানাথ, যার বীরত্ব দেশের রাজাকে মুগ্ধ করে এবং সে সেনাবাহিনীর প্রধান হয়।

ভুক্তভোগীমাত্রেই জানেন, ঘনঘোর বর্ষার এই টুপটাপ শব্দটি কতখানি ভীতিপ্রদ। নড়বড়ে আশ্রয়স্থলের অসুরক্ষিত আচ্ছাদন থেকে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব বহুমাত্রায় আজ প্রকট এ কালের ‘বুড়ির বাড়ি’-র মতো সরকারি আবাসন ভবনগুলিতে। পলেস্তারা খসে পড়া রংহীন জীর্ণ অবয়বে বট, অশ্বত্থের শিকড় গজিয়ে ওঠে, ভাঙা ঘুলঘুলিতে বাসা বাঁধে নাম-না-জানা পাখি, মরচে পড়া সদর দরজার ক্যাঁচ ক্যাঁচ ধ্বনি অস্ফুট স্বরে বলতে চায় অযত্নের সারসত্য কাহিনি।

প্রকৃতপক্ষে, এ বঙ্গের সরকারি আবাসস্থলেই নয়, অবহেলার দগদগে ঘা ফুটে ওঠে বিদ্যালয় গৃহ থেকে ছাত্রাবাস— সর্বত্র। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, রাজ্যের প্রথম সারির এক বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে এই রকম সমস্যা বড় বেশি জানান দিত বৃষ্টির দিনে। তিনতলা বিল্ডিং-এর উপরিভাগের রুমের ভিতরে তখন ছোট ছোট বালতি পাতা হত বৃষ্টির জল থেকে বাঁচার জন্য। পরবর্তী কালে কর্মসূত্রে দেখেছি, গ্রামীণ এলাকার বহু বিদ্যালয়ে নিম্নমানের ইমারতি দ্রব্য ব্যবহার করায় দেওয়াল জুড়ে বিস্তৃত চওড়া ফাটল, হাঁ হয়ে যাওয়া মেঝের করুণ দশা। এই সব সরকারপোষিত শিক্ষালয়ের পাল্লাহীন জানলা-দরজা’সহ চার দেওয়ালের নড়বড়ে কাঠামো থেকে শৌচালয়ের দুরবস্থার সাক্ষী আছেন নির্বাচনী কাজে উক্ত স্থানগুলিতে ডিউটি করা সকল ব্যক্তিই।

লেখার পরিপ্রেক্ষিতে মনে এল, চলতি বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন ছাদের চাঙড় খসে এক পরীক্ষার্থীর জখম হওয়ার মর্মান্তিক খবর। এ কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। বছর কয়েক আগে দিনেদুপুরে বর্ধমান রেল স্টেশনের একটি পুরনো জলের ট্যাঙ্ক হুড়মুড়িয়ে আছড়ে পড়লে চার জনের মৃত্যু হয়। প্রকৃতপক্ষে এ সবই খণ্ডচিত্র মাত্র। দুর্নীতির পূর্ণগ্রাসে আজ নিমজ্জিত পর্যবেক্ষণ ও নিয়মিত নজরদারির আইনিবিধি। সস্তা নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার থেকে অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগ, দায়িত্বহীনতা এবং সর্বোপরি সিন্ডিকেট ও কাটমানির সংস্কৃতির বিস্তারে সাধারণ জনগণ প্রহর গোনে পরবর্তী দুর্ঘটনার।

সুপ্রতিম প্রামাণিক, আমোদপুর, বীরভূম

আর কত মৃত্যু

‘মৃত বেড়ে ৮, প্রশ্নে পুলিশ এবং বিধায়ক’ (২-৪) শীর্ষক সংবাদে উঠে এল, এ রাজ্যে বাজি কারখানায় ফের ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের ঘটনা। পাথরপ্রতিমায় ঢোলাহাট থানার স্থানীয়দের দাবি, বহু বার আপত্তি জানালেও জনবসতির মাঝে দীর্ঘকাল ধরে বাজির অবৈধ কারবারটি চলছিল। খবরে জানা যাচ্ছে, এর আগেও নিষিদ্ধ বাজি ব্যবসার সূত্রে এক বার অভিযুক্ত চন্দ্রকান্ত বণিক পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। মুক্ত হয়ে তিনি ফের পুরোদমে বাজির কারবারে নেমে যান। বসতবাড়ির মধ্যে বাজি তৈরির নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কেন এ ক্ষেত্রে পুলিশ আগেই যথার্থ পদক্ষেপ করল না? স্থানীয় পঞ্চয়েত প্রধান বা সদস্য এবং বিধায়ক— এলাকার সব রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিও কি এর দায় একেবারে এড়িয়ে যেতে পারেন?

২০২৩ সাল থেকে ধরলে বিস্ফোরণে মৃ্ত্যুর তালিকাটি দীর্ঘতর। যেমন— এই সময়কালে এগরায় বাজির বিস্ফোরণে প্রাণ হারান ৮ জন, দত্তপুকুরে ৯, ডায়মন্ড হারবারে ৩, কল্যাণীতে ৫। অথচ, ২০২৩ সালে পূর্ব মেদিনীপুরে এগরায় বাজি কারখানার বিস্ফোরণস্থলে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, বেআইনি নিষিদ্ধ বাজি কারবারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা করা হবে। প্রতিশ্রুতি দেন, সরকারি বিধি মেনে রাজ্যে যথোচিত ভাবে পরিবেশবান্ধব বাজি বা সবুজ বাজির ক্লাস্টার গড়ে তোলা হবে।

উদ্বেগজনক বিষয় হল, এর পরেও, নানা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বেআইনি ভাবে বাজি কারখানা ও বাজির মশলা মজুতের কারবার আজও কোনও ভাবেই বন্ধ করা যায়নি। দেখা যায়, সাধারণ ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে এক শ্রেণির অসাধু কারবারি নিষিদ্ধ বাজি বানাচ্ছেন, যা গোপনে লাভজনক বোমা শিল্পের রূপ নিচ্ছে। আর কর্মহীনতার মুখোমুখি হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ বাজি শিল্পে কাজ করে চলেছেন বহু মানুষ।

প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা ও ঔদাসীন্যের জেরে অবৈধ বাজি কারখানার বিস্ফোরণে আর কত জনের প্রাণ ঝরবে?

পৃথ্বীশ মজুমদার, কোন্নগর, হুগলি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Hospital Building Housing

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy