Advertisement
E-Paper

তখন মসজিদ ছিল মিলনক্ষেত্র

‘মসজিদ’ শব্দটি আরবি, আভিধানিক অর্থ ‘সিজদা দেওয়ার জায়গা’, উপাসনাগৃহ, ইত্যাদি। ধর্মীয় উপাসনার কাজে প্রধানত ব্যবহৃত হলেও, ‘মসজিদ’ আদতে মিলন ক্ষেত্র।

সাবির আহমেদ

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৮ ০১:০২

ইদের প্রস্তুতি। মেরামতির কাজ শেষ হয়েছে কলকাতার নাখোদা মসজিদে। সদ্য চাপানো লাল রঙের ছোঁয়া তাকে দিয়েছে বিশেষ মর্যাদা। বাদশা আকবরের স্মৃতিসৌধের আদলে গড়ে ওঠে এই মসজিদ। গুজরাত থেকে আসা মেমন পরিবারের ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে এর পত্তন। মসজিদে হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা এত ভাল যে, বাইরে যখন আগুনের হলকা, এখানে তখন অযান্ত্রিক শীতল আরামের ছোঁয়া। প্রাক-মাইক যুগে ইমামের আজান বা নমাজ পড়ার আওয়াজ প্রতিটি তলায় স্বচ্ছন্দে পৌঁছে যেত। রমজান মাসে ইফতারের খবর দিত মিনারের লাল বাতি। আধুনিক মসজিদে মসৃণ পাথরের ব্যবহার, কিন্তু নাখোদা-র ওজুখানায় ঘষা পাথরের ব্যবহার, জলে ভিজে থাকা এলাকায় বয়স্ক মুসল্লিদের (যাঁরা মসজিদে নমাজ পড়তে আসেন) পিছলে পড়া আটকাতে।

‘মসজিদ’ শব্দটি আরবি, আভিধানিক অর্থ ‘সিজদা দেওয়ার জায়গা’, উপাসনাগৃহ, ইত্যাদি। ধর্মীয় উপাসনার কাজে প্রধানত ব্যবহৃত হলেও, ‘মসজিদ’ আদতে মিলন ক্ষেত্র। নমাজের জন্য মানুষ মিলিত হন, নমাজ শেষে নানা সামাজিক, রাজনৈতিক আলোচনা। শুক্রবার মসজিদে বড় জমায়েত হয়, এই উপলক্ষ কাজে লাগিয়ে সামাজিক বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা হত। সময়ের ধারায় এই আলোচনার পরম্পরা কমে এসেছে; অনেক মসজিদই শুধুমাত্র পাঁচ বার নমাজ পড়ার কেন্দ্র।

ফেরা যাক কলকাতার মসজিদের কথায়। শহরের সঙ্গে মুসলমানদের যোগাযোগ গোড়া থেকেই। পলাশি যুদ্ধের আগে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা দখল করে শহরের নামকরণ করেন ‘আলিনগর’। ইংরেজ-অধিকারে ফিরে আসার পর আস্তে আস্তে বাসিন্দাদের চাহিদা অনুসারে বিভিন্ন প্রান্তে মসজিদগুলো গড়ে ওঠে। সরকারি তথ্য, শহরের ১৪২টা ওয়ার্ডে বর্তমানে প্রায় সাড়ে পাঁচশোর মতো মসজিদ। কিছু সংশয় থাকলেও অনেকে মনে করেন চিৎপুরের বশিরি মসজিদই কলকাতার প্রথম মসজিদ। দেশভাগের আগে মসজিদের সংখ্যা প্রায় এখনকার দ্বিগুণ ছিল।

বর্তমান মসজিদের তালিকার দিকে তাকালেও সামাজিক ইতিহাসের একটা দিক ফুটে ওঠে। সে কালের কলকাতায় সামাজিক সৌহার্দ্যের বাতাবরণও অনুমান করা যায়। অথচ আজকের দিনে এক জন মুসলমানকে অ-মুসলমান পাড়ায় ঘর ভাড়া নিতে বা কিনতে কী পরিমাণ বেগ পেতে হয়, এমনকি খ্যাতনামা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও, তা আমাদের জানা। পুরনো মসজিদগুলোর অবস্থান দেখে বোঝা যায়, শহরের যে কোনও প্রান্তেই মুসলমানরা বসবাস করতে পারতেন। একটা উদাহরণ, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে বর্তমানে প্রায় ছ’টা মসজিদের হদিস পাওয়া যায়। এর অন্যতম মৌলানা আজ়াদের বাড়ি, অধুনা মৌলানা আবুল কালাম মিউজ়িয়ামের অদূরে মৌলানা আজ়াদ মসজিদ। নগরাঞ্চলে মিশ্র এলাকার নানান সুবিধা আছে, এই বিষয়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় এক প্রবন্ধে গৌরকিশোর ঘোষ লিখেছেন, “দেশ ভাগের আগে কলকাতা শহরে মুসলমান অধিবাসীর সংখ্যা এখনকার চাইতে অনেক বেশি ছিল বলেই বিভিন্ন মুসলিম মহল্লায় মুসলিম পরব যে সব অনুষ্ঠিত হত, সেগুলো এখনকার চেয়ে অনেক বেশি হিন্দুর নজরে পড়ত...। এখন যেটা আমাকে কষ্ট দেয়, সেটা হল হিন্দু এবং মুসলমানের একেবারে ওয়াটার টাইট কম্পার্টমেন্টের মনোভাব। মনে হয় কেউ কাউকে ভাল ভাবে চেনে না।’’ অবশ্য তিনি দেশভাগের আগে মুসলমান জনসংখ্যার ব্যাপারে দৃষ্টিপাত করেছেন। জনগণনার তথ্য অনুসারে, ১৯০১-এ জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই মুসলমান (৪৪.৯%), ১৯৪১-এ ৩২.৫%, আর ১৯৫১ সালে কেবলমাত্র ১৪.৪%। বর্তমান কলকাতার অভিজাত এলাকা সাদার্ন অ্যাভিনিউ বা বালিগঞ্জে মুসলমান বসতির কথা ভাবাও কষ্টকর, অথচ ১৮২৪-২৫ সালে শেখ জ়াহিরুদ্দিন রবীন্দ্র সরোবরের মাঝে লেক মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। শৌখিন প্রকৃতির মানুষ শেখ জ়াহিরুদ্দিন নৌকায় করে মগরিবের নমাজ পড়তে যাবেন বলেই নািক এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এক দিকে এই ধরনের শৌখিনতা প্রকাশের যেমন সুযোগ ছিল, তেমনই ছিল সহিষ্ণু সহাবস্থান।

আবার বিশেষ চাহিদার কারণেই শহরে বেশ কিছু মসজিদ গড়ে উঠেছিল। ফোর্ট উইলিয়ামের অদূরে ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত লস্কর মসজিদ মূলত মুসলমান সেনাকর্মীদের জন্য তৈরি হয়; গড়ে ওঠে খিদিরপুর মোড়ের লাল মসজিদ বা দু’শো বছরের বেশি পুরনো আলিপুর পুলিশ কোর্ট বা ১৯১৬ সালে ভবানীপুরে কলকাতা পুলিশের মসজিদ। মহাকরণেও এক প্রাচীন মসজিদের কথা জানা যায়।

কলকাতার মসজিদের কথা হবে আর টিপু সুলতান মসজিদের কথা হবে না, তা হয় না। টিপু-পুত্র প্রিন্স গোলাম মহম্মদের তৈরি ধর্মতলা ও টালিগঞ্জের দু’টি মসজিদ অনন্য স্থাপত্যের নিদর্শন।

শেষ করি লখনউ থেকে আসা নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ-র মসজিদ নিয়ে। অওধের তখ্ত থেকে ক্ষমতাচ্যুত নবাব মেটিয়াবুরুজে ১৮৫৬-৫৭ সালে গড়ে তোলেন শাহি মসজিদ। মসজিদ-লাগোয়া সাজানো বাগান, সঙ্গে বাঁধানো ওজুখানা।

দেশভাগের পর কলকাতার জনবিন্যাস এক নতুন রূপ পায়, মুসলমানরা আপাত নিরাপদ মুসলমান পাড়ায় অথবা পূর্ব-পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হন, ফলে সে সব এলাকার মসজিদ বেদখল হয়েছে— ২০১০-১১ সালে বিধানসভায় এই রকম প্রায় ৫১টি মসজিদের তালিকা পেশ করা হয়। ধর্মীয় প্রার্থনাগৃহ ছাড়া এগুলির স্থাপত্যকলাও ইতিহাসের উপাদান। ওয়াকফ বোর্ডের সহযোগিতায় এই মসজিদের সংরক্ষণ আশু প্রয়োজন।

পাঁচ–ওয়াক্ত নমাজের বাইরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য রক্ষায় মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন, চেন্নাইয়ের মসজিদে চলছে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। কোচবিহারে নতুন মসজিদ কমিটির গড়ে তোলা কমিউনিটি লাইব্রেরি বা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র একই আলো দেখাচ্ছে। মোমিনপুরের বুড়ি মসজিদের ইমাম আশরাফ কাসমী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে ‘আও মিল ব্যয়ঠো’ নামে একটা কর্মসূচি চালাচ্ছেন। মসজিদের অতীত মানবসভ্যতার গৌরব— তার বর্তমান তা থেকে বঞ্চিত হতে পারে না।

প্রতীচী ইনস্টিটিউট-এ কর্মরত

Mosque Glory Eid
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy