Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Lord Rama

নেতাজি ও জয় শ্রীরাম

সুভাষচন্দ্রকে লইয়া বাঙালি মননের অতি সংবেদনশীল জায়গাটিতে এক জোরদার আঘাত আসিল।

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:২৬
Share: Save:

স্থানকালপাত্র বিবেচনা একটি অত্যন্ত মৌলিক শিক্ষা। কিন্তু সম্ভবত মৌলিক বলিয়াই তাহা ইদানীং কালে অতি দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য এবং প্রত্যাশাতীত। বিশেষ করিয়া যাঁহারা রাজনীতির কারবারি, তাঁহাদের কাছে এমন বিবেচনা প্রত্যাশা তো আজকাল মূর্খামির পর্যায়ে পড়ে। সম্প্রতি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর সূচনাপর্বে বিজেপি নেতাদের রাম-ধ্বনি বলিয়া দিল, রাজনীতিতে প্রবেশের পূর্বে কেহ তাঁহাদের পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝিয়া কাজ করিবার প্রাথমিক পাঠটুকুও দেয় নাই। কেন্দ্রীয় সরকার আয়োজিত অনুষ্ঠানটিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতার সময় যে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিত হইল, তাহা কি পরিকল্পিত, না কি প্রধানমন্ত্রীকে দেখিয়া তাঁহার দলীয় কর্মীদের উচ্ছ্বাসের নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ, সে বিষয়ে তর্ক চলিতে পারে। কিন্তু একটি কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়: আজীবন যিনি সংহতির পক্ষে মত রাখিয়াছেন, সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে ঘৃণা করিয়াছেন, সেই দেশনায়কের স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানের স্বচ্ছ, সুন্দর পরিবেশটি এই স্লোগানে কলুষিত হইল। সুভাষচন্দ্রকে লইয়া বাঙালি মননের অতি সংবেদনশীল জায়গাটিতে এক জোরদার আঘাত আসিল।

প্রশ্ন হইল, ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তোলা কি ‘অপরাধ’? গণতান্ত্রিক দেশে বিবিধ ধ্বনিই তোলা যায়, সেই স্বাধীনতা নাগরিকের অবশ্যই আছে। তবে কিনা, অপরাধ না হইলেও অনৈতিক বটেই। এবং এই অনৈতিকতা আসিতেছে স্থানকালপাত্র বিবেচনা হইতেই। ‘জয় শ্রীরাম’ একটি ধর্মীয় স্লোগান, কালক্রমে যাহা রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হইয়াছে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ আনুষ্ঠানিক আবহে ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক কোনও স্লোগানই চলিতে পারে না। নেতাজি ভবনের প্রাতিষ্ঠানিক অনুষ্ঠানস্থলের বাহিরেও না। এইখানেই বিজেপির অসংযমের প্রকাশ। বাস্তবিক, বাংলার অরাজনৈতিক মঞ্চে ইহার ব্যবহার এই প্রথম নহে। ইতিপূর্বে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও বিজেপি সমর্থকরা এই স্লোগান দিয়াছিল, ২০১৯ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাতেও। এবং কোনও ক্ষেত্রেই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ হইতে ইহার বিরুদ্ধে একটি শব্দও ব্যয় করা হয় নাই। সেই অসীম প্রশ্রয়ের ধারাটি ভিক্টোরিয়ার অনুষ্ঠানটির পরেও পরিলক্ষিত হইল। বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে স্লোগানের সপক্ষে নানাবিধ কুযুক্তির বন্যা বহাইয়া দিলেন, যাহা কেবল হাস্যকর নহে, অন্যায় এবং বিপজ্জনক।

তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, তাঁহারই উপস্থিতিতে এত কাণ্ড, অথচ সম্পূর্ণ নীরব রহিলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। মুখ্যমন্ত্রী প্রতিবাদে বক্তৃতা দিলেন না, অথচ প্রধানমন্ত্রী ভাব করিলেন, যেন উহা কিছুই নহে! তাঁহার বক্তৃতায় তো নহেই, দেহভঙ্গিতেও সামান্যতম অসন্তোষের চিহ্ন ফুটিল না। অবশ্য ইহাই প্রত্যাশিত। রামমন্দিরের শিলান্যাস পর্বে তাঁহার আভূমি নত হইবার চিত্রটি বলিয়া দিয়াছিল, ধর্মনিরপেক্ষ দেশের শাসকের পদ অলঙ্কৃত করিয়াও তিনি ধর্মীয় পরিচয় ছাড়িতে রাজি নহেন। নিজের দলগত ও ধর্মীয় পরিচয়টিকে পিছনে ফেলিয়া প্রশাসক হিসাবে একটি উচ্চস্তরে উঠিবার সুযোগ মোদী হাতছাড়া করিয়াছেন বহু বার। অথচ সে দিন এই স্লোগানে আপত্তি/প্রতিবাদ করিলে তাঁহারই নম্বর বাড়িত। প্রশাসক হিসাবে তো বটেই। নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধা-প্রদর্শক হিসাবেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE