E-Paper

ছায়া-সন্ধানী

ছায়াঘেরা নগরসভ্যতার রূপরেখাটি ১৮২২ সালে নির্মাণ করেছিলেন স্ট্যামফোর্ড র‍্যাফেলস, যাঁর ছকভাঙা পরিকল্পনার হাত ধরে এক অত্যাধুনিক সিঙ্গাপুরের জন্ম বলে মনে করা হয়।

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৩১

ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি/ আছে আমাদের পাড়াখানি।” আছে, নাকি ছিল? গত কয়েক দশকে যেন মানবসভ্যতা উল্কার বেগে এগিয়েছে। তার সঙ্গেই চলেছে মায়াময় প্রকৃতির রূপখানিকে ছিঁড়েখুঁড়ে চতুর্দিক কংক্রিটে ঢেকে দেওয়ার কুৎসিত প্রচেষ্টা। পরিণতি— পৃথিবী এখন প্রবল জ্বরাক্রান্ত। সবুজের শীতল ছায়া, জলের স্নিগ্ধ পরশখানি হারিয়ে উষ্ণতার সঙ্গে লড়াই করে চলাই ‘আধুনিক’ মানুষের নিয়তি। তবে তার মধ্যেও কিছু দেশ অন্য রকম ভাবে। জ্বরতপ্ত পরিবেশকে, তাকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকা প্রাণগুলিকে শীতল করার উপায় সন্ধান করে অবিরাম। সিঙ্গাপুর যেমন। এক অস্বস্তিকর গরমের দেশ পরিচিতিতে সে সন্তুষ্ট থাকেনি। দীর্ঘ দিন ধরে দেশের প্রতি কোণে সবুজ স্থাপন আর ছায়ার ব্যবস্থা করাকে তারা অগ্রাধিকার দিয়েছে। পরিণামে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ‘ছায়া’র ব্যবস্থাপনা করার স্বীকৃতি পেয়েছে সিঙ্গাপুর।

এই ছায়াঘেরা নগরসভ্যতার রূপরেখাটি ১৮২২ সালে নির্মাণ করেছিলেন স্ট্যামফোর্ড র‌্যাফেলস, যাঁর ছকভাঙা পরিকল্পনার হাত ধরে এক অত্যাধুনিক সিঙ্গাপুরের জন্ম বলে মনে করা হয়। তাঁর নির্দেশ ছিল, প্রত্যেক রাস্তার দু’পাশে একটানা আচ্ছাদন-সহ ‘ফাইভ-ফুট ওয়ে’র ব্যবস্থা রাখার, যাতে রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে পথচারী বাঁচতে পারেন। পরবর্তী কালে প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ-এর নেতৃত্বে ভাবনাটি উন্নততর হয়। অন্দরে, তিনি সিঙ্গাপুরকে গড়ে তোলেন এক ‘শীতাতপনিয়ন্ত্রিত দেশ’ হিসাবে। আর বাইরে, নাগরিকদের জন্য সুবিস্তৃত ছায়ার বন্দোবস্ত করেন। ষাট এবং সত্তরের দশকে সিঙ্গাপুরের সমস্ত ঘরবাড়ি মাথায় উঁচু হতে থাকে, আর তাদের নীচতলাটি খুলে দেওয়া হয় বাতাস খেলার জন্য, যেখানে ক্লান্ত মানুষ দু’দণ্ড জিরিয়ে নেবেন। পরিবেশ আর স্বাচ্ছন্দ্যকে মিলিয়ে-মিশিয়ে এমন সুসংগঠিত, আধুনিক পরিকল্পনার জন্য সিঙ্গাপুরের প্রায় অর্ধেক অংশই আজ ঘাস, ছোট ঝোপ আর বড় পাতার গাছে ঢাকা— যে সব উন্নয়নপ্রেমী মনে করেন শহর সম্প্রসারণের জন্য গাছপালা উপড়ে ফেলা জরুরি, তাঁদের চিন্তায় জল ঢেলেই।

উষ্ণায়নের প্রভাবে প্রতি বছর বিশ্বের তাপমাত্রা যে দুরন্ত গতিতে বাড়ছে, তাতে অন্য দেশগুলিকেও অচিরেই ছায়ার সন্ধান করতে হবে। বদলে যাওয়া জলবায়ুর সঙ্গে লড়াইয়ে এমন দীর্ঘমেয়াদি বিকল্প ভাবনা অত্যন্ত জরুরিও। কিন্তু হাতে-গোনা উন্নত বিশ্বের দেশ ছাড়া বাকিরা সেই পথে ভাবছে কি? ছায়ার বন্দোবস্ত শুধুমাত্র সিঙ্গাপুরের স্থাপত্য-নকশার ধাঁচেই করতে হবে, তেমনটি সব দেশে সম্ভব নয়। ভারতের মতো সুবিশাল, তৃতীয় বিশ্বের দেশে তো নয়ই। কিন্তু রাজপথগুলির দু’ধারে ‘ছায়াবীথি’ নির্মাণ তো অ-সম্ভব নয়। তাতে যে স্নিগ্ধতার ছোঁয়া মেলে, কংক্রিটের আচ্ছাদনও তা জোগাতে পারে না। বড় শহরে, যেখানে বেহিসাবি ‘কংক্রিটায়ন’-এর কারণে গ্রীষ্ম দিনের উচ্চ তাপমাত্রা আটকে পড়ে ‘হিট ট্র্যাপ’ তৈরি করে দেয়, সেখানে রাস্তার দু’পাশে ঘন সবুজের উপস্থিতি নাগরিককে অনেকখানি স্বস্তি দিতে পারে। কিন্তু ভারতের অতি-উন্নয়নপ্রেমী সরকার তা ভাবে না। বরং উন্নয়নের চোটে এখানে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট ঘন অরণ্য উজাড় হয়। পরিণতিতে পাহাড় ধসে পড়ে, গ্রীষ্ম দীর্ঘতর হয়, প্রবল উত্তাপ নিত্যনতুন রেকর্ড গড়ে। ক্লান্ত, অবসন্ন নাগরিকের ছায়ার খোঁজ দীর্ঘতর হয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Singapore Global Warming Civilization

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy