রাজ্য সরকার বা রাজ্যের শাসকদের মদতপ্রাপ্ত কোনও সংগঠন এসএসসি মামলার রায়ের পুনর্বিবেচনা চেয়ে মোট কত বার আদালতের দ্বারস্থ হল, সে হিসাব সম্ভবত সবারই গুলিয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি ২৬,০০০ শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীর চাকরি বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার যত আবেদন শীর্ষ আদালতে জমা পড়েছিল, আদালত তা একযোগে বাতিল করে দিয়েছে। এই ধারাবাহিক ব্যর্থতা থেকে রাজ্য সরকার যদি এ-হেন চেষ্টার অসারতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারে, তা হলে সবার মঙ্গল। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানও সম্ভবত অস্বীকার করবেন না যে, এসএসসি-কে কেন্দ্র করে তুমুল দুর্নীতি হয়েছিল। এবং, এত দিনে স্পষ্ট যে, সেই দুর্নীতির ফলাফলকে বৈধ করে তোলার যাবতীয় অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এবং সম্ভবত হবেও। কোনও যুক্তিতেই চিঁড়ে ভিজছে না। ফাটা ডিমে তা দিয়ে ফল পাওয়া মুশকিল— বিশেষত, এ ক্ষেত্রে ডিমটি ফাটার পিছনে সরকার এবং শাসকপক্ষের দায় অতি প্রকট। রাজ্য সরকার এবং শাসক দল যা করে চলেছে, এ বার তা থামানো দরকার। স্বীকার করতে হবে যে, এসএসসি কাণ্ডে যা হয়েছে, তা ঘোরতর অন্যায়। এবং, সেই অন্যায়ের দায়ও বহন করতে হবে। যে ২৬,০০০ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের একটি অংশ সম্ভবত সৎ পথেই চাকরি পেয়েছিলেন। রাজ্য প্রশাসনের দোষেই তাঁদের চাকরিও বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না, এ কথাটি স্বীকার করতে হবে। সেই স্বীকারোক্তির রাজনৈতিক প্রত্যাঘাত শাসক দল কী ভাবে সামলাবে, তা দেখা প্রশাসনের কর্তব্য নয়। রাজনীতি থেকে প্রশাসনকে আলাদা না করতে পারলে রাজ্যের কতখানি ক্ষতি হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে তার বৃহত্তর উদাহরণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
সরকারি স্কুলে লেখাপড়া হয়, এমন দাবি গত কয়েক দশকে কেউই করতে সাহস পাননি— কিন্তু, এখন আর সেটুকুও হওয়ার উপায় নেই। শীর্ষ আদালতের অনুমতিক্রমে চাকরিহারাদের মধ্যে যোগ্য প্রার্থীরা ডিসেম্বর অবধি স্কুলে পড়াচ্ছেন। কিন্তু, তাতে এক দিকে স্বভাবতই শিক্ষক-ঘাটতিতে চলা স্কুলের সমস্যা মেটেনি; এবং অন্য দিকে, যে অনিশ্চয়তার মধ্যে এই শিক্ষকরা রয়েছেন, সেই মানসিক অবস্থায় যথাযথ ভাবে পড়ানো অসম্ভব। সামনেই এসএসসি পরীক্ষা— তাঁরা সেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবেন, না কি ক্লাসে পড়াবেন, রাজ্য সরকারের কাছে এ-হেন দ্বন্দ্বের কোনও উত্তর স্বভাবতই নেই। ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন প্যানেল তৈরি করে নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা আদৌ সম্ভব হবে কি না, সে আশঙ্কাও রয়েছে। শাসক দলের অবৈধ খাজনা আদায়ের তাড়না, এবং প্রশাসনের মেরুদণ্ডহীনতা পশ্চিমবঙ্গকে দাঁড় করিয়েছে এক ভয়ঙ্কর খাদের মুখে।
এসএসসি-কাণ্ডের ভূতকে এ বার রাজ্যের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলা দরকার। সরকার ভুল স্বীকার করুক, এবং সেই ভুলকে পিছনে ফেলে নতুন ভাবে গোটা ব্যবস্থাটি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হোক। সরকারি স্কুলশিক্ষায় অবহেলা যে ক্ষতি করে, তার তুলনা মেলা ভার। যাঁদের টাকার জোর আছে, তাঁদের সিংহভাগই ইতিমধ্যে সন্তানকে সরিয়ে নিয়েছেন বেসরকারি স্কুলে। পড়ে রয়েছেন তাঁরাই, যাঁদের সামনে অন্য কোনও পথ নেই— হয় টাকা নেই, নয়তো কাছাকাছির মধ্যে বেসরকারি স্কুল নেই। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মূলত এই প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীরাই। অর্থাৎ, ক্ষতিটি শুধু কিছু ছেলেমেয়ের লেখাপড়া না-শেখারও নয়— যদিও, সে ক্ষতিই সমাজের পক্ষে প্রবল রকম ভয়াবহ— এই ক্ষতি সামাজিক চলমানতার সম্ভাবনার; ক্ষতি বণ্টনের ন্যায্যতার। যার আর্থিক বা সামাজিক ক্ষমতা আছে, একমাত্র তার পক্ষেই শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব হবে, এবং বাকিরা বঞ্চিত হবে উন্নয়নের সম্ভাবনা থেকে, এমন পরিস্থিতি অসহ। শাসক দলের অনাচারের এই খেসারত সমাজকে দিতে হলে তা এক অক্ষমণীয় অন্যায় হবে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই সরকারের চেতনা হোক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)