একটি ধাঁধা ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে। এসআইআর একটি ‘রুটিন প্রক্রিয়া’, কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে তা রুটিন অর্থাৎ নিয়মিত ভাবে হয়ে আসে। তা হলে, এ বারে এসআইআর-এর জন্য এত বিপুল তাড়াহুড়ো কিসের— যার ফলে মানুষের ভোগান্তির সীমা নেই, আবার ভোগান্তির ভয়ে কিংবা অসহনীয় চাপে একের পর এক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন? বিএলও-দের উপর মরণান্তিক চাপ সত্যিই বিস্ময়ের সীমা ছাড়ায়— কোনও রুটিন প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার জন্য এই দাম কেন দিতে হবে? কেন সময়সীমা বাড়িয়ে পরিস্থিতি সহনীয়তর করা যাবে না? ভোটের আগেই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরিকল্পনা থাকলে কেন তা আগে শুরু হয়নি? নেতাদের ভুল পরিকল্পনার দাম মানুষকে দিতে হবে কেন? কেন পশ্চিমবঙ্গের মতো জনবহুল রাজ্যে ৭.৬৬ কোটি ভোটারের ‘যোগ্যতা’ নির্ধারণের জন্য তিন মাস, ফর্ম বিলি ও ফর্ম পূরণের সময়সীমা দেড় মাসের মধ্যে বেঁধে রাখা হল? এত মানুষের কাছে অল্প সময়ে পৌঁছনোর জন্য কমিশনের বাধ্যবাধকতা, মানুষের উদ্ভ্রান্তি, রাজ্য সরকারের শাসানি— সব মিলিয়ে বিএলও-দের যেন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। ফর্মের মধ্যে নিয়মাবলি পরিষ্কার করে বলে না দেওয়া, বিএলও-দের যথাযথ প্রশিক্ষণ না দেওয়ায় তৈরি হল ভ্রান্তি, বিভ্রান্তি, উদ্বেগ, অনিশ্চিতির তীব্র উদ্বেগ। মৌখিক ঘোষণা আর লিখিত নির্দেশের দূরত্বে তৈরি হল অবিশ্বাসের ঘূর্ণিপাক। সব মিলিয়ে একে কি আর কোনও ‘ধাঁধা’ বলা চলে? না কি, বোঝা গিয়েছে যে এ হল স্বৈরতন্ত্রের প্রতাপজালে দেশকে বাঁধা?
বাস্তবিক, যে দেশে গত এক দশকে বিরোধীদের বারংবার অনুরোধ উপরোধ সত্ত্বেও জনশুমারি, জাতশুমারি কিছুরই প্রয়োজন অনুভব করেনি শাসক গোষ্ঠী, তথ্য-পরিসংখ্যান সংগ্রহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে হঠাৎ ভোটার তালিকা নিয়ে এমন প্রবল (প্রাণঘাতী) তাড়না— এর মধ্যে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি তো আছেই। বস্তু, এসআইআর-এর মধ্যে বিজেপি রাজনীতির স্বার্থ বিজেপি-ই স্পষ্ট করে দিয়েছে। বিহারের বিপুল জয়ের পর বিএলএ-দের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে— নির্বাচনের ফলের সঙ্গে এই কার্যক্রমের সরলরৈখিক সম্পর্কটি এ ভাবেই সরকারি সিলমোহর পেল! তর্কশাস্ত্রের যুক্তিমতে, এনডিএ-শাসিত বিহারে এনডিএ-ই ফিরে আসার পর বিএলও/বিএলএ-রা যে ভাবে ‘দলীয়’ কৃতজ্ঞতার লক্ষ্য হলেন, বিরোধী-শাসিত পশ্চিমবঙ্গের বিএলও-রা এসআইআর-এ চূড়ান্ত সাফল্য দেখালেও তেমনটি হয়ে উঠবেন না। গণতন্ত্রের সরকারি কার্যক্রম এই ভারতে এ ভাবেই দলীয় কার্যক্রমে পরিণত— যাতে সামগ্রিক রাজনৈতিক সমাজ নিষ্ক্রিয় সাক্ষী। এই ব্যাপ্ত অশ্বমেধ যজ্ঞে বিএলও-রা নিতান্ত এলেবেলে বোড়ে— ঐতিহাসিক ভূমিকা বটে।
এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক বিএলও আত্মঘাতের সংবাদ, এবং তাই নিয়ে আক্ষরিক অর্থে বিবমিষা উদ্রেককারী রাজনীতির প্রচেষ্টা। এক দিকে, প্রতিটি আত্মঘাতের কারণ নিশ্চিত ভাবে এসআইআর— এই দাবি তুলে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের শুভাশুভবোধরহিত আস্ফালন আরও এক বার দেখিয়ে দিল তাদের রাজনীতির নিকৃষ্ট ঘরানা। একাধিক ঘটনায় দেখা গেল, তৃণমূলের দাবি আর মৃতের পরিবারের দাবির অমিল। বাস্তবিক, মৃত্যু নিয়ে এই অশালীন চাপান-উতোর ছাড়াই এসআইআর-এর তীব্র প্রতিবাদ করা সম্ভব— কিন্তু বডি-কাউন্টের রাজনীতির অনৈতিকতা তৃণমূল নেতৃত্ব বুঝবেন, আশা করাই ভুল। অন্য দিকে, বিজেপির তরফে আত্মঘাতের সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সংযোগহীনতার চিৎকৃত দাবিও সমধিক বিস্ময়কর। তাঁরা তৃণমূলের দাবিকে নস্যাৎ করে কী বোঝাতে চাইছেন? এই সমগ্র এসআইআর প্রক্রিয়ার অমানবিক চরিত্রটি বোঝা বা বোঝানোর জন্য কি কোনও ‘মৃত্যু’র দরকার? স্পষ্টতই, মানুষের জীবন এই ভারতে রাজনীতির খেলনা মাত্র। মানুষের মৃত্যুও।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)