হাওড়ায় বেআইনি নির্মাণ রুখতে প্রোমোটারদের বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় এফআইআর করার পথ ধরেছে হাওড়া পুরসভা। এখনও অবধি বিয়াল্লিশটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে, সাতাশ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। উত্তর হাওড়ার মালিপাঁচঘরা, শিবপুর, বটানিক্যাল গার্ডেন প্রভৃতি এলাকায় গত তিন বছরে ১৪৫টি বেআইনি নির্মাণ ভেঙেছে হাওড়া পুরসভা। তার পরেও সঙ্কীর্ণ গলিতে সুউচ্চ বহুতল তৈরির বিপজ্জনক, বেআইনি প্রকল্প বন্ধ হয়নি। এখন প্রোমোটারদের জেলে ভরার ব্যবস্থা করবেন বলে বার্তা দিচ্ছেন পুরকর্তারা। ঘটনা হল, এই সিদ্ধান্ত নতুন নয়, ত্রুটিমুক্তও নয়। ২০২৩ সালের পুজোর আগে হাওড়া পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান সুজয় চক্রবর্তী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, অবৈধ নির্মাণ ভেঙে দেওয়ার পরেও যদি কোনও প্রোমোটার বা ঠিকাদার আবার নির্মাণকাজ শুরু করেন, তা হলে এফআইআর করবে পুরসভা। পুজোর পর থেকেই ‘নয়া নীতি’ কার্যকর হবে, এই ছিল সুজয়বাবুর ঘোষণা। এমন কড়া ব্যবস্থার প্রয়োজনও ছিল— ২০২০ সালেই পাঁচ হাজার অবৈধ নির্মাণ শনাক্ত করেছিলেন হাওড়া পুরসভার ইঞ্জিনিয়াররা। কিন্তু দুর্বৃত্ত প্রোমোটারদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার সেই ঘোষণার দু’বছর পরেও দেখা যাচ্ছে, অবৈধ নির্মাণে রাশ টানা যায়নি। কখনও বাড়ির ভাঙা অংশ মেরামত করে উপরে নতুন তলা যোগ করা হচ্ছে। কখনও বা বাড়ির নকশায় পরিবর্তন অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়েছে, এই অজুহাত দিয়ে চার তলা বাড়িকে ছয়-সাত তলা করা হচ্ছে। যার অর্থ, বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে, সময় ও অর্থ খরচ করে পুরসভা বাড়ি ভাঙছে, কিন্তু তাতে লাভ হচ্ছে না। এখন পুরকর্তা ফের প্রোমোটারের বিরুদ্ধে এফআইআর করার হুমকি দিচ্ছেন। প্রশ্ন হল, জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করাও কি ভস্মে ঘি ঢালা হবে না? পুলিশ-আদালতের ভয় দেখালে কি সত্যিই দুর্বৃত্ত প্রোমোটার নিরস্ত হবে? আশঙ্কা হয়, তারা পুলিশের খাতায় ‘পলাতক’ থেকে নিজ এলাকায় কাজ করে যাবে।
পুলিশি ব্যবস্থার প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। অবৈধ নির্মাণ কেবল পুরবিধি লঙ্ঘন করছে না, তা নাগরিকের প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে বার বার। ১৭ মার্চ, ২০২৪ গার্ডেনরিচের আজহার মোল্লা বাগানে একটি অবৈধ বাড়ি ধসে পড়ে তেরো জনের প্রাণ গিয়েছিল। গত বছর অগস্টে হাওড়ার সালকিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক ছাত্রীর মৃত্যুর হয়, ‘হুকিং’ করে টানা বিদ্যুতের তারের কারণে। অগস্ট, ২০১৯ সালকিয়ায় একটি নির্মীয়মাণ অবৈধ বহুতলে খেলতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় এক বালকের। সেখানে বিদ্যুতের মেন লাইন উন্মুক্ত ছিল। কলকাতায় বহু বাড়ি বিপজ্জনক ভাবে হেলে রয়েছে, বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যে কোনও দিন। পশ্চিমবঙ্গের পুরসভাগুলো যেন বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। কোনও দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ঘটলেই পুরকর্তারা তড়িঘড়ি ঘোষণা করে দেন। কখনও পুলিশের ভয় দেখান। কখনও বলেন, নির্মীয়মাণ বাড়ির সামনে লাগানো ‘কিউআর কোড’ স্ক্যান করলেই বোঝা যাবে কোনটা অবৈধ নির্মাণ।
কিন্তু এ সব ব্যবস্থার ফল কী হচ্ছে? নয়া প্রযুক্তি, কড়া প্রশাসন কি থামাতে পারছে অবৈধ নির্মাণ? কটু বাস্তব এই যে, পুরসভা-পুলিশের যে কর্তৃত্ব-ক্ষমতা থাকলে আইন ভাঙতে ভয় পেত প্রোমোটাররা, তা নেই। প্রোমোটার, ঠিকাদার, নির্মাণের উপকরণ জোগানোর ‘সিন্ডিকেট’— সব কিছুর সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দলীয় রাজনীতির। পুর-ইঞ্জিনিয়াররা অবৈধ নির্মাণ ভাঙতে গেলে দলীয় নেতারাই বাধা দিচ্ছেন। কাউন্সিলর বা জেলা পরিষদ সদস্যদের চোখের সামনেই পুকুর বুজিয়ে গড়ে উঠছে অবৈধ নির্মাণ। নাগরিকের আস্থা ফিরে পেতে হলে দোষী প্রোমোটারদের বিরুদ্ধে পুলিশে নালিশ করাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন অবৈধ নির্মাণে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)