Advertisement
০৯ মে ২০২৪
BJP

দুঃশাসনের শিকড়

বাহিরের দুনিয়ায় ইদানীং ভারতের নাম প্রায়শই কীর্তিত হইতেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কুকীর্তির কারণে।

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২১ ০৪:৫৮
Share: Save:

রাজধানীর দেওয়ালে সংলগ্ন পোস্টারগুলিতে কোনও গালিগালাজ ছিল না, তিরস্কার ছিল না, এমনকি ধিক্কারও ছিল না। ছিল কেবল একটি প্রশ্ন: মোদীজি, আপনি আমাদের শিশুদের ভ্যাকসিন বিদেশে কেন পাঠাইয়া দিয়াছেন? ইহা কোনও জটিল, দুরূহ, দার্শনিক প্রশ্ন নহে। জীবন এবং মৃত্যুর গহন সম্পর্ক বিষয়ে যমের প্রতি নচিকেতার যে প্রশ্ন, তাহার সহিত এই জিজ্ঞাসার কোনও তুলনা চলে না। নরেন্দ্র মোদী সহজেই ইহার উত্তর দিতে পারিতেন। বলিতে পারিতেন, তাঁহার ভুল হইয়াছিল, অতিমারি যে দ্বিতীয় প্রবাহে এমন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করিতে চলিয়াছে, তাহা তিনি বুঝিতে পারেন নাই। কিংবা জানাইতে পারিতেন, বিভিন্ন দেশে প্রতিষেধক পাঠাইয়া তিনি কূটনীতির বিশ্ববাজারে দেশের এবং আপনার দর বাড়াইতে চাহিয়াছিলেন। অথবা ব্যাখ্যা করিতে পারিতেন, প্রতিষেধক সরবরাহ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পূর্ব-পরিকল্পনার প্রতি তিনি বিশ্বস্ত থাকিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি কোনও উত্তরই দেন নাই। এমনকি ‘উত্তর দিব না’, তাহাও বলেন নাই। তাহার পরিবর্তে এই পোস্টার তৈয়ারি করিবার এবং প্রচার করিবার দায়ে বহু নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনিয়া অনেককে গ্রেফতার করিয়াছে দিল্লি পুলিশ, যে দিল্লি পুলিশকে চালনা করে নরেন্দ্র মোদীর কেন্দ্রীয় সরকার তথা তাঁহার প্রধান সেনাপতি অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।

প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করিলে তাঁহার পুলিশ প্রশ্নকর্তাদের গ্রেফতার করিবে— ইহা গণতন্ত্রের নিয়ম নহে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর ভারতে ইহাই নিয়ম। প্রশ্ন এবং সমালোচনা তাঁহার অবাঞ্ছিত। তাঁহার নীতি: আমি বলিব, সকলে শুনিবে। এই অহঙ্কার দেশের সর্বনাশ করিয়া চলিয়াছে— নোটবন্দির সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় উৎপাত হইতে কোভিড মোকাবিলায় অকল্পনীয় ব্যর্থতা অবধি সর্বনাশের নিরবচ্ছিন্ন অভিযান। সম্প্রতি বারোটি বিরোধী দলের নেতা ও নেত্রীরা কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি লিখিয়া অভিযোগ করিয়াছেন যে, অতিমারির সহিত যুদ্ধে কাহারও কথা না শুনিয়া ভুল পথে চলিয়া সরকার মানুষকে এক ‘প্রলয়ঙ্কর বিপর্যয়’-এর মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছে। তাঁহারা পরিস্থিতির মোকাবিলায় কিছু সুপরামর্শও দিয়াছেন। চিঠির উত্তর মিলে নাই। মিলিবার ভরসাও ক্ষীণ। স্মরণীয়, ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সুচিন্তিত পরামর্শের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর যে প্রতিক্রিয়া মিলিয়াছিল তাহার বিষয়বস্তু ও রুচিবোধ, কোনওটিই উচ্চমানের ছিল না। বস্তুত, ভক্তজনের প্রশস্তি ভিন্ন অন্য যে কোনও প্রতিক্রিয়া বা প্রস্তাবকেই মোদী এবং তাঁহার পারিষদরা অন্যায় আক্রমণ বা অনধিকার চর্চা হিসাবে দেখেন, যে কোনও প্রশ্নেই তাঁহারা বোধ করি ‘অপমানিত’ হন। নিশ্ছিদ্র অহমিকাই যাঁহাদের স্বধর্ম, প্রশ্নবাচী গণতন্ত্র তাঁহাদের বিচারে ‘পরধর্ম ভয়াবহ’ বলিয়া গণ্য হইবে বইকি।

এই অ-গণতান্ত্রিকতা ভারতকে কোথা হইতে কোথায় নামাইয়া আনিয়াছে, তাহা আজ আর বুঝাইয়া বলিবার প্রয়োজন নাই। বাহিরের দুনিয়ায় ইদানীং ভারতের নাম প্রায়শই কীর্তিত হইতেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কুকীর্তির কারণে। মানবাধিকার লঙ্ঘন, বাক্‌স্বাধীনতা হরণ, সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের লাঞ্ছনা, বিরোধী রাজনীতিকদের হেনস্থা ও ভীতিপ্রদর্শন— কুকীর্তির দীর্ঘ তালিকায় স্বৈরাচারের নানা উৎকট নিদর্শন। এই স্বৈরাচার কেবল দুঃশাসনের প্রকরণই নহে, ইহা শাসকদের মজ্জাগত। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যখন জানাইয়া দেন, তাঁহার রাজ্যে কোভিড মোকাবিলা লইয়া অভাব-অভিযোগের কথা প্রচার করিলে শাস্তি দেওয়া হইবে, তখন সেই মজ্জাগত ব্যাধিই প্রকট হয়। তাহার তাড়নাতেই প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করিবার অপরাধে পেয়াদা পাঠানো হয়। বর্তমান শাসকদের চিঠি লিখিয়া এই দুঃশাসনের প্রতিকার হইবার নহে, সেই কথা বিরোধী রাজনীতিকরা জানেন তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP TMC Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE