—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই এক রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তের সূচনা হয়েছিল। দু’পক্ষের সৈন্যবাহিনী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যুদ্ধের ঘোষণা হবে, এমন সময়ে যুধিষ্ঠির রথ থেকে নামলেন। নিরস্ত্র, একাকী এক রাজা পায়ে হেঁটে চললেন বিপক্ষের সৈন্যের দিকে— ভীষ্ম-দ্রোণ প্রমুখ গুরুজনদের প্রণাম করে যুদ্ধের অনুমতি চাইতে। সে দিন যুধিষ্ঠিরকে আশীর্বাদ করে ভীষ্ম ও দ্রোণ বলেছিলেন, “সকলেই অন্নের দাস, অন্ন কারও দাস নয়।” কথাটি বড়ই দ্যোতনাময়। কেবল কাহিনির প্রেক্ষিতে দেখলে একে মনে হয়, এ হল যুগ-যুগান্তর ধরে চলে-আসা যে কোনও কর্মচারীর আক্ষেপ। যিনি নিয়োগকর্তা, তিনি অন্যায় করছেন, এমনকি মহাপাপ করছেন, তা বুঝেও তাঁর অধীন কর্মীদের তাঁর হয়েই কাজ করতে হয়। তাঁর মস্তিষ্ক যতই বিদ্রোহ করুক, হৃদয় যতই বিষাদগ্রস্ত, ভারাক্রান্ত হোক না কেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের স্বার্থে, তাঁর সম্মান অটুট রাখার জন্য তিনি কাজ করবেন, এই তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা। কেবল প্রশ্নহীন আদেশপালন করলেই হবে না, নিজের সমস্ত শক্তি এবং বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে নিয়োগকর্তার সঙ্কট কাটাতে হবে, তাঁকে অপরাজেয় করে তুলতে হবে। কর্তব্য-বন্ধনে আমাদের এই বন্দিদশার কারুণ্য যেন সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পেয়েছে ভীষ্মের চরিত্রে। ভীষ্ম মহারথ, ন্যায়যুদ্ধে অপরাজেয়, সত্যনিষ্ঠ। তবু এই বীরশ্রেষ্ঠ নিজেকে ‘দাস’ মনে করছেন— কৌরবরা ন্যায়ের পক্ষে নেই জেনেও তাঁদের হয়েই অস্ত্রধারণ করছেন— অন্নঋণের এমনই মহিমা। ‘অন্ন’ বলতে আমরা খাদ্যই বুঝিয়ে থাকি, তবে বৃহৎ অর্থে তা সেই সব কিছু, যা সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। কর্ণ নিজের জন্মপরিচয় জানার পরেও রক্তের বন্ধনের চেয়ে অধিক মর্যাদা দিয়েছেন দুর্যোধনের প্রতি তাঁর বন্ধুত্বের ঋণকে। সে-ও কি অন্নের ঋণ পরিশোধের উদ্দেশ্যেই নয়?
যা গ্রহণ করেছি, তা ফিরিয়ে দিতে হবে, এই ধারণাই রয়েছে সব নৈতিক চিন্তার কেন্দ্রে, মনে করেন দার্শনিকরা। ভাষাতেও তার সূত্র মেলে— ইংরেজি ঔচিত্যবোধক ‘অট’ শব্দটি নাকি এসেছে ঋণবোধক ‘ওউড’ শব্দটি থেকে। সব অনৈতিকতার মূলে রয়েছে অন্যায় দখলদারি, চিন্তার এই সূত্রটি নৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের সেতুবন্ধন করে। এমনকি পরিবেশ সুরক্ষার যুক্তিও খুঁজে পাওয়া যায় এখানে— মাটি, নদী, অরণ্য, জীবজগৎ থেকে যা কিছু গ্রহণ করেছি, তা ফের পূরণ করে দিতে হবে। খানিকটা সেই কারণেই যে নৈতিক সংশয়গুলি চিরকাল মানুষকে দোলাচলে রেখেছে, তার অন্যতম এই প্রশ্ন— আত্মীয়তা, সামাজিকতা বা কাজের সূত্রে যাঁরা ‘স্বপক্ষ,’ তাঁরা অসত্য বলছেন, অন্যায় কাজ করছেন, তা দেখলে কী করা উচিত? যিনি নিজের সম্পদের ভাগ দিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে থেকে তাঁর পরাজয়ের গ্লানি, অপমানের জ্বালা ভাগ করে নেওয়া উচিত? না কি, তাঁকে ত্যাগ করে ন্যায়ের পক্ষে যাওয়াই ধর্ম? অন্যায়ের প্রতিবাদ করা কর্তব্য, অথচ বিপদের মুখে স্বপক্ষ ত্যাগ করাও নিন্দনীয়। বিভীষণ সীতাহরণের প্রতিবাদ করেছিলেন, তবু তাঁর নৈতিক গুণপনার প্রশংসার পরিবর্তে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ কথাটিই বেশি প্রচলিত। ভারতীয় মহাকাব্যগুলি সাক্ষ্য দেবে, নৈতিকতার প্রশ্নের অবস্থান বহু ক্ষেত্রেই সাদা-কালোয় নয়, বরং তার মধ্যবর্তী অনির্দিষ্ট ধূসর অঞ্চলে।
আধুনিক বিশ্বে অবশ্য কর্তৃত্বের ধারণাতেই অনেক নমনীয়তা এসেছে। বাণিজ্যিক সংস্থা বা নির্বাচিত সরকার, সর্বত্র কর্মচারী বা অংশীদারের মতামত যে মূল্যবান, সেই নীতিটি বিধিনিয়মের মধ্যেই প্রোথিত থাকে। বিশেষত গণতন্ত্রের নানা স্তরে কর্মচারীদের পাশাপাশি, নাগরিকেরও অংশীদারি রয়েছে। তবু দেখা যায়, শাসক যে কোনও সমালোচনাকে ‘বিরোধিতা’ বলে দেখেন, কর্মচারীর আপত্তিকে ‘ঔদ্ধত্য’ বলে দেখতে, এবং নাগরিকের সমালোচনাকে ‘অকৃতজ্ঞতা’ বলে দেখাতে তৎপর। এর মূলে রয়েছে অন্নদাসের নৈতিক কর্তব্যের ধারণা। গণতন্ত্রে প্রকৃত নিয়োগকর্তা সাধারণ মানুষ, তাঁদের অর্থেই সরকার চলে, তাঁরাই সরকারকে নির্বাচন করেন, সরকার বস্তুত জনতারই অংশমাত্র। সরকারি পদাধিকারীর প্রতি আনুগত্যের চেয়েও নীতিগত ভাবে অনেক বড় জনতার প্রতি সরকারি কর্মচারীর কর্তব্য। তবু সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে সেই একই সঙ্কট সমান ভাবে অনুভূত হচ্ছে— নিয়োগকর্তার অন্যায়ের প্রতিবাদ, না কি চাকরিতে শৃঙ্খলা, আনুগত্যের যুক্তিতে অন্যায় জেনেবুঝেও নীরবে সরকারের পক্ষ অবলম্বন? অসময়ে পদোন্নতি, অকারণে বিশেষ সুবিধা, এমন প্রলোভনও কৃতজ্ঞতার শৃঙ্খল তৈরি করে সরকারি কাজের নানা স্তরে। স্বাধীন দেশেও শ্বাসরোধ করতে চায় দাসত্বের শৃঙ্খল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy